Thursday, April 8, 2010
পানি-কাহিনী
স্কুলপাঠ্য ইতিহাসে পানিপথের যুদ্ধের কাহিনী প্রায় সবারই পড়া। সে যুদ্ধের কাহিনী পড়ে পানিপথের যে চিত্র শৈশবে আমাদের কল্পনায় হাজির হয়েছিল তা জলমগ্ন পথই। কিন্তু ক্রমে জানতে পারা গেল, পানিপথ আসলে জলমগ্ন কোনো পথ নয়, বরং হরিয়ানার অপেক্ষাকৃত শুষ্ক একটি এলাকা। অবশ্য এ গল্পটি মোটেই ইতিহাসের নয়, পানিপথেরও নয়। একান্তই পানির কাহিনী।
পানি যে জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ তা কতবার কতভাবে আমরা শুনেছি তার ইয়ত্তা নেই। বেশি শোনা বলেই পানির অপর নাম জীবন আপ্তবাক্যের মর্ম আমাদের কাছে ক্রমেই ক্ষীণ হয়েছে বলেই মনে হয়। নইলে অত্যন্ত মূল্যবান পানি নিয়ে বেহাল দশা আমাদের বিহ্বল করে তুলতে পারত। ঢাকা শহরে পানির দুর্দশা আমাদের পাগলপারা করেও তুলতে পারত; কিন্তু তা করছে না।
কিন্তু সমকালের সোমবারের সংখ্যায় প্রকাশিত একটি ছবি আর একটি খবরে রয়েছে পানি পান করা মানুষের উদ্বিগ্ন, বিহ্বল ও পাগলপারা হয়ে যাওয়ার কথা। ছবিটি সাধারণ। বিক্রির জন্য ওয়াসার পানির লাইন থেকে সরাসরি পানি ভরা হচ্ছে জারে। এই জারই ক্যাপ সহকারে বাহারি নামের বিশুদ্ধ পানি হিসেবে চলে যেত অফিসে, বাসায়। লোকে বিশুদ্ধ পানি হিসেবে কিনে পান করত সে পানি। বিশুদ্ধ পানি স্বাস্থ্যরক্ষা করছে বলে এক ধরনের তৃপ্তিও হয়তো মিলত। কিন্তু বিএসটিআইর টিম যখন ভেজালবিরোধী অভিযানে এমন পানির সন্ধান পেল তখন বিশুদ্ধ পানির ভোক্তাদের একটু ভেবে দেখতে হবে, আসলেই তারা কী খাচ্ছেন? ঢাকা শহরের মানুষ পানি কিনে খেতে শুরু করেছেন বেশি দিন হয়নি। বোতলজাত পানি, জারের পানির আগে শহরের লোকে বিশুদ্ধ পানি কোথায় পেত? চুলায় পানি গরম করে, ছাঁকনি দিয়ে ছেঁকে পান করত। কিন্তু পানি কোম্পানিগুলো বাজারজাত করা শুরু করলে ঘরের চর্চা ঘরে রয়েছে বটে, কিন্তু বাইরে কেনা পানিই মূলত খাচ্ছেন লোকে। বিশ্বাস করেই খাচ্ছেন। বিশ্বাস বড় জিনিস বটে। কিন্তু বিশ্বাস করে দূষিত পানি খেয়ে গুরুতর রোগ বাধালে সেও এক বড় ব্যাপার হয়ে উঠতে পারে। পানি বাণিজ্য লাভজনক। এক পানি বিশুদ্ধ করে বোতল বা জারে পুরে বাজারজাত করার জন্যই ছোট-বড় কত কারখানা গড়ে উঠেছে। এটা জরুরি শিল্প। কিন্তু এ জরুরি শিল্পটি যদি প্রতারণার অভিযোগে অভিযুক্ত হয় তবে তা উদ্বেগের কথা। ভেজালবিরোধী অভিযান আর বিএসটিআই তো যাবে ভেজালকারীদের ধরতে; কিন্তু ভালো পানি-ব্যবসায়ীদের উচিত বাণিজ্যের স্বার্থেই নকল পানি ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। পানি সমিতি আছে কি-না জানি না। থাকলে তারাও ব্যবস্থা নিতে পারে। বহুদিন আগে লালন সাঁই বলেছেন, গর্তে জল ফেললে তা গর্তের জল বলে অভিহিত হয়, আবার কূপে নিলে তাকেই বলা হয় কূপের জল। খুবই দার্শনিক ভাষণ। আমাদের পানি ভেজালকারীরা তেমন ভেবেছেন কি-না জানি না। তবে তাদের জানানো উচিত, ওয়াসার পাইপে থাকলে তা ওয়াসার পানি হয় বটে, কিন্তু জারে ভরলে তা সরাসরি বিশুদ্ধ হয়ে ওঠে না। বিশুদ্ধ পানির জন্য অনেক বিশুদ্ধকরণের নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হয়। আর সেটুকু না মেনে প্রতারণা করলে উপযুক্ত শাস্তি পাওয়া উচিত।
ক্রেতাদেরও উচিত কোন কোম্পানির পানি খাচ্ছেন তা পরখ করে দেখা। মাঝে মাঝে একটু পরীক্ষা করে দেখা। নইলে, বিশ্বাসে বস্তু না মিলে অসুখই মিলবে।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment