Monday, April 19, 2010
কত কথা বলে রে!
কবি বলেছেন, জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি। জাহান্নামের আগুনে বসে কেউ পুষ্পের হাসি হাসতে পারে কি-না সে নিশ্চয়ই গবেষণার বিষয়। জেলখানায় বসে অপরাধীরা যে দিব্যি পুষ্পের হাসি হাসতে পারে সে নিশ্চয় করে বলে দেওয়া যায়। সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে শাস্তি বিধানের জন্য অপরাধীদের জেলখানায় পাঠানো হয়। বিচারাধীন বা সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীদের জন্য জেলখানা প্রকৃত অর্থে বন্দিশালা হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে সবসময় সেটি হয় না। রোববারের সমকালে এমন এক সন্ত্রাসীর বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে যিনি জেলখানায় বসে ৩১ দিনে ৩০টি সিম বদলে মোবাইল ফোনে ৩,৬০০ মিনিট কথা বলেছেন। বিজ্ঞাপনের ভাষা অনুকরণ করে কেউ পরিহাস করে বলতে পারেন, কত কথা বলে রে! কিন্তু যুক্তি দিয়ে বিচার করতে গেলে বিষয়টা বিস্ময়কর বটে। যারা জেলখানায় থাকেন না, স্বাধীন মানুষ হিসেবে বিচরণ করেন তারা কি চাইলে ৩১ দিনে ৩০টি সিম বদলাতে পারবেন? সিম বিক্রির কড়াকড়ি এখন। চাইলেই কেউ নতুন সিম কিনতে পারে না। পরিচয়পত্র দেখাতে হয়, ছবি জমা দিতে হয়, আঙ্গুলের ছাপ দিতে হয়। মোবাইল কোম্পানিগুলোর ডাটাবেজে নাম ওঠে। পুলিশ চাইলে যে কোনো সময় সিম ক্রেতাদের নাম-পরিচয় নিয়ে তাকে চিহ্নিত করতে পারে। কিন্তু সন্ত্রাসী হাবিবুর রহমান তাজের ক্ষেত্রে এসবের বালাই নেই। প্রশ্ন উঠবে, সিম কেনার এই কড়াকড়ির মধ্যে কীভাবে তিনি এত সিম জোগাড় করলেন? কারা ছবি, পরিচয়পত্র এবং আঙ্গুলের ছাপ দিয়ে তার জন্য সিম জোগাড় করলেন। আর কোন বিক্রেতাই-বা এত সিম সরবরাহ করলেন? এ তো গেল সিমের হিসাব। টকটাইমের হিসাব কে করবে? ৩,৬০০ মিনিট কম সময় নয়। কার সঙ্গে, কাহার সঙ্গে তাজের এত কথা? জেলখানার ভেতরে বসে পুষ্পের হাসি হাসতে হাসতে তিনি কতজনকে হুমকি দিয়েছেন, কতজনের সঙ্গে তদবির করেছেন, কতজনের সঙ্গে নেটওয়ার্ক তৈরি করেছেন তার হিসাব কে দেবে? সাম্প্রতিক সময়ে দেশে মোবাইল ফোনে হুমকি দেওয়ার ঘটনা বেড়ে চলেছে। কিন্তু হুমকি যতটা আসে, হুমকিবিরোধী তৎপরতা ততটা নেই। জানা গেছে, মন্ত্রীকে পর্যন্ত হুমকি দেওয়া হয়েছিল মোবাইল ফোনে। কিন্তু সিম বিক্রির বেলায় বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো। যখন পুলিশ মোবাইল কোম্পানির কাছে হুমকিদাতার নাম-পরিচয় চাইল তখন তারা তা দিতে পারলেন না। সাধারণ মানুষ হুমকি পেলে আর তা পুলিশকে জানালে ব্যবস্থা কেমন নেওয়া হবে তা সহজেই অনুমেয়। আর সন্ত্রাসী যদি পুলিশের নজরদারিতে বসে মানে জেলখানার গোয়েন্দা ও পুলিশের পাহারায় বসে মোবাইল ফোনে হুমকি দেয় তবে আর তাকে ধরবেই-বা কে, আর ধরেই-বা কী হবে? পুলিশ সন্ত্রাসীকে ধরবে, বিচার করবে, শাস্তি দেবে, সন্ত্রাসীর জেল হবে। কিন্তু সন্ত্রাসী নিজেই অনেক ধাপ পেরিয়ে জেলে বসে আছেন। ধরপাকড়ের মিছে মায়ার আর দরকার কী? সন্ত্রাসী তাজ রেকর্ড করেছেন কথা বলায়। অল্প সময়ের মধ্যে এতগুলো সিম ব্যবহার ও এত কথা বলার জন্য তার নাম গিনেজ বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে উঠবে কি-না তা জানার জন্য নিশ্চয়ই সচেতন নাগরিকরা উদ্যোগী হবেন। এমনকি ফোন কোম্পানিগুলো মোবাইল ফোনের বিকাশে তাজের অবদানের জন্য তাকে পুরস্কার দিতে পারে। তাকে নিয়ে বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাণ করে ক্রেতাদের আকর্ষণ করতে পারে। কিন্তু জেলখানা কর্তৃপক্ষ কী বলবে? তারা বলবে, নজরদারি বাড়ানো হচ্ছে, জ্যামার লাগানো হচ্ছে। অসাধু তৎপরতা বন্ধ করার উদ্যোগ আসছে। হচ্ছে হবে করে করে অনেক দিন চলে যাচ্ছে। কিন্তু কাজের বেলা কিছুই হচ্ছে না। জেলখানায় অপরাধীদের স্বাধীনতা কমানো যাচ্ছে না। শোনা যায়, নেশাদ্রব্যের জমজমাট ব্যবসা সেখানে যেমন হয়, তেমনি অস্ত্র বিকিকিনির যোগাযোগও দিব্যি চলে। বেড়ায় যেখানে ক্ষেত খায় সেখানে বেড়া যত উঁচু আর কণ্টকাকীর্ণ হোক ক্ষেত খাবেই। এখন তাই বেড়ার দিকে নজর দেওয়ার সময় এসেছে। কারণ ফস্কা গেরো দিয়ে সন্ত্রাস দূর করা যাবে না। কিন্তু গেরো শক্ত করার দায়িত্ব কার? কে নেবে এ গুরুদায়িত্ব? দায়িত্ব নেওয়ার লোক না থাকলে কথা চলতেই থাকবে। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে জেলখানায় বসেই কথা বলার রেকর্ড বাড়তে থাকবে। আমাদের কিছু করার থাকবে না, শুধুই বলব, কত কথা বলে রে!
Thursday, April 8, 2010
ভাষা বিতর্ক
ফেব্রুয়ারি এলে ভাষা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক বেশ চলে। এবারও তর্ক উঠেছে। তর্কের বিষয় : এফএম রেডিওর ভাষা, টেলিভিশনের নাটকের কথ্য ভাষা ও উচ্চারণ এবং বানান নিয়ে নানা মতকে এক মতে আনার উদ্যোগ। এ নিয়ে সরকারি পর্যায়ে নানা কথাবার্তাও শুরু হয়েছে। টেলিভিশনে টক শো হচ্ছে, সংবাদপত্রে লেখা হচ্ছে। বাংলা একাডেমী বানানরীতির সমতা আনার জন্য শিগগিরই উদ্যোগ নেবে বলে জানা যাচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে ভাষা ব্যবহার ও উচ্চারণ নিয়ে মিডিয়া প্রধানদের সচেতন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শোনা যাচ্ছে, ভাষা নিয়ে নীতিমালাও হবে। মিডিয়ায় নীতিমালা প্রয়োগের ব্যাপারে কর্তাদের আগ্রহের শেষ নেই। চালের দাম বাড়ছে তো বাজারের দিকে তাকানোর দরকার নেই, মিডিয়ায় চালের খবর কীভাবে পরিবেশিত হবে এ নিয়ে সমস্যা। কোর্টে অবাধে জামিন হচ্ছে, অপরাধীরা ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে। কীভাবে কোর্টের সংবাদ পরিবেশন করা হবে এ নিয়ে নীতিমালা দিন, সমাধান হয়ে যাবে। টিভির লাইভ সংবাদ, টক শো নিয়ে নীতিমালা দিতে চান অনেকে, দেনও। মিডিয়ার হেন কোনো বিষয় বোধহয় পাওয়া যাবে না, যা নিয়ে নীতিমালা দিতে চান না কেউ। মিডিয়া যদি নীতিমালা নিতে চাইত তবে মিডিয়া আর মিডিয়া থাকত কি-না সন্দেহ। মিডিয়ার স্বাধীনতা কেমন হতো তখন তাও ভাবার বিষয়।
নীতিমালার তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন বানানবিধি, উচ্চারণবিধি, ভাষাবিধি। এগুলো নিশ্চয় খারাপ জিনিস নয়। পত্রিকাগুলো নিজেদের মতো করে নির্ভুলভাবে খবর ছাপতে চায়, টিভিগুলো নির্ভুল উচ্চারণে বলতে চায়, রেডিওগুলোও হয়তো তেমনটিই চায়। কিন্তু কেউ যদি ভাষা নিয়ে অবশ্যমান্য নীতিমালা তৈরি করে দেয় তবে তো সেটি চাপানো ব্যাপারই হবে। বাংলা একাডেমী যদি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য বানানরীতি দিতে পারে, তবে লোকে নিজের গরজে কিনে নিয়ে সে বানানরীতি মানবে। কিন্তু আদেশ হিসেবে যদি একটি বানানরীতি পত্রিকা অফিসে পাঠিয়ে দেয়, তবে ক'জনের জন্য তা সুখকর হবে তা নিয়ে ভাবা যেতে পারে।
কথা উঠছে, টেলিভিশনের নাটকের ভাষা ও উচ্চারণ নিয়েও। যে নাটকগুলো নিয়ে কথা হচ্ছে সেগুলো বেশ জনপ্রিয়। মান ভাষায় করা নাটক সেগুলোর ধারে-কাছে যেতে পারছে না। এর পেছনের কারণটি খুঁজে বের করা দরকার বিরোধিতা করার আগে। এ নাটকগুলোর ভাষা মুুখের ভাষার খুব কাছাকাছি। বিষয়ও জীবনের নিকটবর্তী। তাই সেগুলো সহজেই গ্রহণ করছেন দর্শকরা। এখন কেউ যদি বলে, ফারুকীর নাটকের চরিত্রদের শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে হবে এবং এ নিয়ে আইন হবে। তবে কে মানবে?
রেডিওর ক্ষেত্রেও তেমন। এ তো সেদিনও ভাবগম্ভীর উচ্চারণের বাংলাদেশ বেতার ছাড়া যখন কোনো দেশীয় রেডিও ছিল না। তখন তো সবাই ভাবতেই বসেছিল রেডিওর যুগ শেষ। কিন্তু এফএম এসে নিঃশেষিত রেডিওকে সবার কানে কানে ঠাঁই করে দিয়েছে। লোকে শুনছে, মজা পাচ্ছে, ব্যবসা হচ্ছে, মিডিয়ার বিকাশ হচ্ছে। এখন কেউ যদি বলে, রেডিওগুলোকে সরকারি বেতারের মতো শুদ্ধ উচ্চারণে ধীরে ধীরে কথা বলতে হবে, তবে কেউ মানবে?
আসলে গেল গেল রব তুলে ভাষা বাঁচানো কঠিন। নীতিমালা করেও বাঁচানো যায় না। ভাষা নদীর মতো। যতক্ষণ সচল আছে ততক্ষণ এক পাড় ভেঙেই চলে আর এক পাড় গড়ে চলে। একদিন এই বাংলা ভাষাও ছিল না। প্রাচীন প্রাচ্য, গৌড়ি প্রাকৃত, গৌড়ি অপভ্রংশ, বঙ্গ কামরূপী হলে বাংলাভাষার জন্ম হয়েছে মাত্র ৬৫০ খ্রিস্টাব্দে। এদের কেউ যদি আইন করে গোঁ ধরে বসত তবে বাংলার জন্মই হতো না। আর বাংলা যদি তার আদিরূপে থাকতে চাইত তবে মানুষ কথাই বলতে পারত না। কারণ, সংস্কৃত, আরবি, ফারসি, ইংরেজি নানা শব্দ নিয়ে আমরা ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছি। নেব না নেব না করলে ভাষা বাঁচে না। কাজে লাগা শব্দ, অভিধানের শব্দের চাইতে অনিবার্য।
রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে গুণীজনদের একসময় মুখের ভাষা চালু করতে আন্দোলন করতে হয়েছিল। সাধুর জায়গায় চলিত ভাষা আসতে পেরেছিল। চলিত ভাষা তো চলিতই। যদি চলিত ভাষাকে থামিয়ে দেওয়া হয় তবে তার নাম থামিত দিতে হয়। ভাষাকে চলতে দিতে হবে মানুষের মধ্যে। মানুষই ঠিক করবে কে বাড়াবাড়ি করছে আর কে ষড়যন্ত্র করছে। কারণ মানুষই ভাষা আন্দোলন করেছে। মানুষই শেষ কথা।
পানি-কাহিনী
স্কুলপাঠ্য ইতিহাসে পানিপথের যুদ্ধের কাহিনী প্রায় সবারই পড়া। সে যুদ্ধের কাহিনী পড়ে পানিপথের যে চিত্র শৈশবে আমাদের কল্পনায় হাজির হয়েছিল তা জলমগ্ন পথই। কিন্তু ক্রমে জানতে পারা গেল, পানিপথ আসলে জলমগ্ন কোনো পথ নয়, বরং হরিয়ানার অপেক্ষাকৃত শুষ্ক একটি এলাকা। অবশ্য এ গল্পটি মোটেই ইতিহাসের নয়, পানিপথেরও নয়। একান্তই পানির কাহিনী।
পানি যে জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ তা কতবার কতভাবে আমরা শুনেছি তার ইয়ত্তা নেই। বেশি শোনা বলেই পানির অপর নাম জীবন আপ্তবাক্যের মর্ম আমাদের কাছে ক্রমেই ক্ষীণ হয়েছে বলেই মনে হয়। নইলে অত্যন্ত মূল্যবান পানি নিয়ে বেহাল দশা আমাদের বিহ্বল করে তুলতে পারত। ঢাকা শহরে পানির দুর্দশা আমাদের পাগলপারা করেও তুলতে পারত; কিন্তু তা করছে না।
কিন্তু সমকালের সোমবারের সংখ্যায় প্রকাশিত একটি ছবি আর একটি খবরে রয়েছে পানি পান করা মানুষের উদ্বিগ্ন, বিহ্বল ও পাগলপারা হয়ে যাওয়ার কথা। ছবিটি সাধারণ। বিক্রির জন্য ওয়াসার পানির লাইন থেকে সরাসরি পানি ভরা হচ্ছে জারে। এই জারই ক্যাপ সহকারে বাহারি নামের বিশুদ্ধ পানি হিসেবে চলে যেত অফিসে, বাসায়। লোকে বিশুদ্ধ পানি হিসেবে কিনে পান করত সে পানি। বিশুদ্ধ পানি স্বাস্থ্যরক্ষা করছে বলে এক ধরনের তৃপ্তিও হয়তো মিলত। কিন্তু বিএসটিআইর টিম যখন ভেজালবিরোধী অভিযানে এমন পানির সন্ধান পেল তখন বিশুদ্ধ পানির ভোক্তাদের একটু ভেবে দেখতে হবে, আসলেই তারা কী খাচ্ছেন? ঢাকা শহরের মানুষ পানি কিনে খেতে শুরু করেছেন বেশি দিন হয়নি। বোতলজাত পানি, জারের পানির আগে শহরের লোকে বিশুদ্ধ পানি কোথায় পেত? চুলায় পানি গরম করে, ছাঁকনি দিয়ে ছেঁকে পান করত। কিন্তু পানি কোম্পানিগুলো বাজারজাত করা শুরু করলে ঘরের চর্চা ঘরে রয়েছে বটে, কিন্তু বাইরে কেনা পানিই মূলত খাচ্ছেন লোকে। বিশ্বাস করেই খাচ্ছেন। বিশ্বাস বড় জিনিস বটে। কিন্তু বিশ্বাস করে দূষিত পানি খেয়ে গুরুতর রোগ বাধালে সেও এক বড় ব্যাপার হয়ে উঠতে পারে। পানি বাণিজ্য লাভজনক। এক পানি বিশুদ্ধ করে বোতল বা জারে পুরে বাজারজাত করার জন্যই ছোট-বড় কত কারখানা গড়ে উঠেছে। এটা জরুরি শিল্প। কিন্তু এ জরুরি শিল্পটি যদি প্রতারণার অভিযোগে অভিযুক্ত হয় তবে তা উদ্বেগের কথা। ভেজালবিরোধী অভিযান আর বিএসটিআই তো যাবে ভেজালকারীদের ধরতে; কিন্তু ভালো পানি-ব্যবসায়ীদের উচিত বাণিজ্যের স্বার্থেই নকল পানি ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। পানি সমিতি আছে কি-না জানি না। থাকলে তারাও ব্যবস্থা নিতে পারে। বহুদিন আগে লালন সাঁই বলেছেন, গর্তে জল ফেললে তা গর্তের জল বলে অভিহিত হয়, আবার কূপে নিলে তাকেই বলা হয় কূপের জল। খুবই দার্শনিক ভাষণ। আমাদের পানি ভেজালকারীরা তেমন ভেবেছেন কি-না জানি না। তবে তাদের জানানো উচিত, ওয়াসার পাইপে থাকলে তা ওয়াসার পানি হয় বটে, কিন্তু জারে ভরলে তা সরাসরি বিশুদ্ধ হয়ে ওঠে না। বিশুদ্ধ পানির জন্য অনেক বিশুদ্ধকরণের নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হয়। আর সেটুকু না মেনে প্রতারণা করলে উপযুক্ত শাস্তি পাওয়া উচিত।
ক্রেতাদেরও উচিত কোন কোম্পানির পানি খাচ্ছেন তা পরখ করে দেখা। মাঝে মাঝে একটু পরীক্ষা করে দেখা। নইলে, বিশ্বাসে বস্তু না মিলে অসুখই মিলবে।
লাল শার্ট
থাইল্যান্ডে সাবেক প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রার সমর্থকদের লাল শার্ট আন্দোলন সবাইকে একটু হলেও তাক লাগিয়ে দিয়েছে। থাকসিন সমর্থকদের প্রতিবাদ নতুন ব্যাপার নয়, মাঝে মাঝেই থাইল্যান্ডের রাস্তায় তাদের প্রতিবাদ-বিক্ষোভ করতে দেখা যায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতির কোনো উন্নতি ঘটে না। হতোদ্যম হয়ে আবারও ঘরে ফিরে যায় আন্দোলনকারীরা। এবারের ঘটনা একটু আলাদা, আন্দোলনকারীদের লাল শার্ট বেশ মনোযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছে। মজার ব্যাপার হলো, লাল শার্ট পরা থাকসিন সমর্থকরা এর আগেও প্রতিবাদ বিক্ষোভ করেছেন। কিন্তু এবার যেন তাদের শার্টের রঙ একটু বেশি চোখে লাগছে সবার। বিক্ষোভের মাত্রা বেশি হচ্ছে বলে নাকি সমর্থকদের গলার জোর বেশি বলে কে জানে। নাকি এবার শার্টের রঙ একটু বেশি লাল। কারণ যাই হোক, সবাই একটু ভাবতে বসেছেন, লাল শার্ট তবে কী মানে বহন করছে? লাল রাজনীতিতে পরিচিত রঙ। বামপন্থিদের রঙ লাল। বামপন্থি লড়াকুদের লালফৌজ বলা হয় অনেক দেশে। আবার কোথাও তারা লাল পতাকা বাহিনী। কিন্তু লাল শার্ট কিছুটা অপরিচিত ধারণা। কিন্তু ইতিহাস বলছে, যতটা অপরিচিত মনে করা হচ্ছে ততটা অপরিচিত নয় লাল শার্ট। উপমহাদেশে লাল শার্ট আন্দোলন হয়েছিল সেই ব্রিটিশ দখলদারিত্বের সময়ে। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের নেতা খান আবদুল গাফফার খান পাঠানদের নিয়ে মহাত্মা গান্ধীর সমর্থনে খোদায়ী খিদমতগার আন্দোলন শুরু করেছিলেন। আর এই আন্দোলনের কর্মীরা লাল শার্ট পরতেন। খান আবদুল গাফফার খানের অনুসারীদের মধ্যে মার্কসবাদের প্রভাব পড়া বিচিত্র কিছু নয়। কিন্তু থাকসিন সমর্থকদের মধ্যে মার্কসবাদ ভর করা একটু অবাক করার ব্যাপার বটে। আন্দোলন ও বিক্ষোভের অনেক রঙ আছে। দেশে দেশে কত রঙিন বিক্ষোভ হচ্ছে। কোথাও কমলা বিপ্লব, কোথাও বা সবুজ বিপ্লব। এই তো বছরখানেক আগে মিয়ানমারে হয়ে গেল বৌদ্ধ ভিক্ষুদের জাফরান আন্দোলন। ভিক্ষুরা মাঠে নেমেছিলেন তাদের চিরপরিচিত জাফরান রঙের পোশাক পরে। সামরিক জান্তা কঠোর হাতে সে বিক্ষোভ দমন করেছিল। কিন্তু মিয়ানমারের মানুষ ও প্রতিবেশীরা ভিক্ষুদের সেই জাফরান মার্চের কথা মনে রেখেছেন। এবার মিয়ানমারের কাছের দেশ থাইল্যান্ডে লাল শার্ট আন্দোলন চলছে। শুধু লাল শার্ট নয়, রক্তাক্ত আন্দোলন হচ্ছে রীতিমতো। প্রাণীরক্ত সংগ্রহ করে বিক্ষোভকারীরা রাস্তায় ঢেলে দিচ্ছেন। এ রক্তস্রোত নিয়ে তারা প্রধানমন্ত্রী অভিজিতের বাসভবন পর্যন্ত গিয়েছেন। রক্ত দিয়ে প্রতিবাদলিপি তৈরি করেছেন, কবিতাও লেখা হয়েছে রক্তাক্ত অক্ষরে। থাকসিন সমর্থকদের প্রতিবাদের ফল কী হবে তা বলা যাচ্ছে না এখনই। বোঝা যাচ্ছে না, তিনি এ প্রতিবাদের পর দেশে ফিরতে পারবেন কি-না। কিন্তু আপাতত আমাদের মনোযোগ শার্টের রঙের দিকে। সিনাওয়াত্রার দল থাই রাক থাই নিষিদ্ধ এখন। গ্রামীণ ও শহুরে গরিবদের মধ্যে জনপ্রিয় হলেও ইতিপূর্বে দলটির সঙ্গে বামপন্থার সংযোগ মেলেনি। রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার আগে সিনাওয়াত্রা ব্যবসায়ী ছিলেন। ব্যবসায়ীদের নিয়ে সংগঠন করেছিলেন। তার দলটি ক্ষমতায় এসে এশিয়ান অর্থনৈতিক সংকট থেকে ব্যবসায়ীদের মুক্ত করেছিল। সুফল পেয়েছিল কৃষকরাও। এর ফল হিসেবে কৃষকদের সমর্থন পাওয়া তার পক্ষে অসম্ভব নয়। কিন্তু দল নিষিদ্ধ হওয়ার পর সিনাওয়াত্রা সমর্থকরা লাল শার্ট পরে বিপ্লবী বনে যাবেন, এ মনে হয় একটু বাড়তি ভাবনা। বিশ্বের উৎসাহী লোকেরা ব্যাংককের লাল শার্টের বিপ্লবীদের দেখছেন। বোঝার চেষ্টা করছেন, এ লাল কেমন লাল। রঙ একটা ব্যাপার বটে। কিন্তু সব সময় রঙের মানে এক হয় না। তাতে অবশ্য ক্ষতি-বৃদ্ধি নেই কিছু। কাজ হলেই হলো। এক রঙের শার্ট পরে যদি প্রতিবাদকারীরা শাসকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে, যদি তাদের ভড়কে দিতে পারে, যদি শাসকরা আলোচনায় বসার প্রস্তাব দেয় তবে ক্ষতি কী? কিন্তু শার্টের লাল যদি সমর্থকদের মনকেও লাল করে দেয় তবে ভাবনার কারণ আছে। থাইল্যান্ডের লাল শার্টের লাল কতটা গাঢ় শেষ পর্যন্ত তা বুঝতে আরও কিছু সময় লাগবে, সন্দেহ নেই।
শেখ ফরিদ
বাংলায় বহুল প্রচলিত একটি প্রবাদ_ 'বগলে ইট, মুখে শেখ ফরিদ।' যেসব লোকের মুখে এক আর মনোবাঞ্ছা আরেক তাদের মনোভাব বোঝাতেই প্রবাদটির উল্লেখ হয়। ইট অবশ্যই পাটকেল জাতীয় বস্তু, যা আক্রমণের কাজে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু শেখ ফরিদ কে? মুখে শেখ ফরিদ বলতে যদি কোনো উত্তম বাণী বা উত্তম মানুষের নাম বোঝানো হয় তবে সেই পুণ্যবান ব্যক্তি কে? একদা বাংলায় সুফি-সাধকদের ব্যাপক আগমন ঘটেছিল। ইতিহাস বলে, বাংলার মানুষ এই সুফিদের হাত ধরেই ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন। আর সুফি ইসলামে শেখ ফরিদ খুব পরিচিত ও প্রিয় নাম। এই সুফি সাধক ও কবির নাম আবু হামিদ বিন আবু বকর ইব্রাহিম। কিন্তু ইরানের নিশাপুরের এই কবি লিখতেন ফরিদউদ্দিন আত্তার নামে। আত্তার মানে ফার্মাসিস্ট। পিতার কাজের সূত্রে তিনি ফার্মাসিস্ট হয়েছিলেন কিন্তু কুফা, মক্কা, দামেস্ক, তুরস্কে ভ্রমণকালে তিনি সুফি শায়খ বা শেখদের সানি্নধ্যে এসে ভাবুক ও কবি বনে যান। ইরান-তুরস্কে তিনি মহত্তম সুফি কবি হিসেবে স্বীকৃত। বাংলাদেশেও ফরিদউদ্দিন আত্তার খুব পরিচিত নাম। তার বই 'তাজকেরাত-উল-আউলিয়া' বাংলায় খুব জনপ্রিয়, বহু ঘরে বইটি গুরুত্বের সঙ্গে পাঠ করা হয়। মজার ব্যাপার, পাখির সঙ্গে ফরিদউদ্দিন আত্তারের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। তার একটি বই 'মানতেক আত তায়ের', বহুল আলোচিত এ বইটি 'কনফারেন্স অব বার্ডস' নামে পরিচিত। বাংলায় এর নাম হবে, 'পাখি সম্মেলন'। যতদূর জানি, সুফি সাধনার উচ্চমার্গীয় এ বইটি বাংলায় অনুবাদিত হয়নি। মানতেক আত তায়েরে ফরিদউদ্দিন আত্তার পাখিদের কথা বলেছেন। হুপি নামে এক পাখির নেতৃত্ব মেনে বিশ্বের পাখিরা একবার তাদের রাজা সিমুর্গের সঙ্গে দেখা করতে যায়। তারা জীবন, জগৎ, সৃষ্টি রহস্য বিষয়ে এবং বিশেষত ভালোবাসা বিষয়ে অপূর্ব সব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়। তাজকেরাত-উল-আউলিয়ার বহুল প্রচারের কথা মনে রাখলে মানতেক আত তায়ের বাংলায় সম্পূর্ণ অপরিচিত বই এ কথা বলা যায় না। হতে পারে, মানতেক আত তায়েরের প্রসঙ্গ থেকেই পাখির নামের সঙ্গে ফরিদউদ্দিন আত্তারের জুড়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে থাকবে। পত্রিকান্তরে শেখ ফরিদের সংবাদ পড়ে তাই একটু চমকে গেলাম। শেখ ফরিদ নামের সঙ্গে শেখ বা শায়খ ফরিদের যোগ থাকা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু তথ্য-যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করা একটু কঠিনই বটে। প্রথম আলো পত্রিকায় গত মঙ্গলবার পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া থেকে তোলা একটি শেখ ফরিদ পাখির ছবি প্রকাশিত হয়েছে। বাংলায় পাখিটির নাম কালা তিতির। কালা তিতির দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পাওয়া যায় বটে, কিন্তু বাংলাদেশে এটি বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতি। বিলুপ্তপ্রায় পাখি হলেও লোকে পাখিটি চেনে এবং স্থানীয় নাম পর্যন্ত জানে। বলা হচ্ছে, ব্ল্যাক প্যাট্রিজ বা ব্ল্যাক ফ্যাংকোলিনই কালা তিতির। কিন্তু তিতির বলতে যে পাখিটিকে বোঝানো হয়, উইকিপিডিয়া বলছে, বুনো টার্কির প্রজাতি হলো সেই পাখি। টার্কি নাকি স্বভাবে খুবই বোকা। কিন্তু তিতির বা প্যাট্রিজ অতিশয় ক্ষিপ্র পাখি হিসেবে পরিচিত। তিতির শিকারের শ্বাসরুদ্ধকর অনেক গল্প আছে, যেখানে দেখতে শান্ত, চিন্তাশীল এ পাখিটির রহস্যময় গতিবিধি ও ক্ষিপ্রতা বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। বাংলায় গল্পকার ও ঔপন্যাসিক শওকত আলী 'প্যাট্রিজ' নামে একটি গল্পে এ পাখির রহস্যময়তা ও ক্ষিপ্রতা নিয়ে একটি চমৎকার গল্প লিখেছেন। কালা তিতিরই প্যাট্রিজ কি-না আর প্যাট্রিজই ওয়াইল্ড টার্কি কি-না আর এসবই শেখ ফরিদ কি-না এ নিয়ে পাখি বিশেষজ্ঞরা নিশ্চয় ভাববেন। আপাতত আমাদের চিন্তা শুধু শেখ ফরিদ নিয়ে। ফরিদউদ্দিন আত্তারের পাখি সম্মেলনে বিশ্বের বহু পাখি যোগ দিয়েছিল। তাদের মধ্যে অতিশয় ভাবুক ও ক্ষিপ্র তিতির বা প্যাট্রিজও হয়তো ছিল। আর হয়তো ভাবুক আচরণের কারণে পাখিটিই বাংলার মানুষের কাছে শেখ ফরিদ আখ্যা পেয়েছিল। অনুমান করে হয়তো আরও নানা কথা বলা যায়, কিন্তু নাম-মাহাত্ম্য আর পাখির প্রকার দুটি ভেদ করতে ভাষাবিদ আর পাখিবিশারদরা এবার একসঙ্গে বসলে আমরা আরও যে মজার অনেক কথা জানতে পারব, তা বলাই বাহুল্য।
অনেক দেরি হয়ে গেছে
প্রফেসর জেমস লাভলক বলেছেন, অনেক দেরি হয়ে গেছে। পৃথিবীকে বাঁচানোর চেষ্টা করে আর ফল হবে না। এখন আমদের একটা কাজই করার আছে, সেটি হলো পৃথিবীর হাতে সবকিছু ছেড়ে দিয়ে বসে থাকতে পারি। দেখতে পারি, সম্পূর্ণ তালগোলহীন নানা জলবায়ু পরিবর্তন সমস্যাকে প্রকৃতি কীভাবে মোকাবেলা করে। এ অবস্থায় মানুষের কী করার আছে? কী আর করা, যখন পারা যায় জীবনকে একটু উদযাপন করে নিতে হবে।
গত ৩ এপ্রিল বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে কথাগুলো বলেছেন প্রফেসর লাভলক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জন হামফ্রিস। লাভলকের এ কথাগুলো গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করেছে বিবিসি ও অন্য মিডিয়াগুলো। প্রায় ধর্মীয় ভবিষ্যদ্বাণীর মতো এ কথাগুলো কেন গুরুত্বপূর্ণ তা জানতে প্রফেসর লাভলককে চিনতে হবে। লাভলকের পরিচয় তিনি পরিবেশবিদ, স্বাধীন বিজ্ঞানী এবং ভবিষ্যদ্বক্তা। থাকেন ইংল্যান্ডের ডেভনে। এসব পরিচয়ের চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে তার একটি তত্ত্ব। গেইয়া তত্ত্বের প্রবক্তা হিসেবে পরিবেশ বিজ্ঞানী, তাত্তি্বকদের কাছে তিনি সুপরিচিত।
আমাদের দেশে গেইয়া তত্ত্ব তেমন পরিচিত না হলেও তত্ত্বটি বিশেষভাবে ভারতবর্ষীয় চিন্তার সঙ্গে মেলে। গেইয়া গ্রিক দেবী। শব্দটির অর্থ ভূমি বা পৃথিবী। পৃথি্বমাতা বলে যে ধারণা আমাদের মিথলজিতে প্রচলিত, তেমনি গ্রিক মিথলজিতেও গেইয়ার কথা বলা হয়েছে। গাইয়া আদি গ্রিক মিথলজির মাদার গডেস বা মাতৃকাদেবী। আদিমকালে বহু সভ্যতায় মাতৃকাদেবীর উদাহরণ মেলে। পৃথিবীর আলো, বাতাস, পানি, মাটি সবই গেইয়ার দেহজাত বলে বিশ্বাস করা হয়। প্রফেসর লাভলক থিওরির নামটি নিয়েছেন এই মাতৃকাদেবীর নাম থেকে। আর তাকে নামটি বেছে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন ঔপন্যাসিক উইলিয়াম গোল্ডিং।
১৯৬০-এর দশকে মঙ্গলগ্রহে প্রাণের সন্ধান নিয়ে নাসার জন্য একটি কাজ করতে গিয়ে প্রফেসর লাভলক গেইয়া থিওরির কথা ভাবেন। সত্তর দশকের শুরুতে বিভিন্ন জার্নালে এ নিয়ে তিনি লিখতে শুরু করেন। এ তত্ত্বের মর্মবাণী হলো, পৃথিবী একটি জৈব একক। এর জীবমণ্ডল, বায়ুমণ্ডল, জলমণ্ডল, ভূমির নিচের পাথর ও খনিজ উপাদান, হিমমণ্ডল সবই পরস্পরের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। এগুলোর মধ্যকার জটিল মিথস্ক্রিয়া জলবায়ু বা বাহ্যিক পরিস্থিতিগুলো তৈরি করে। এ তত্ত্ব অনুসারে পরস্পর নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত এসব উপাদান মিলে পৃথিবীর অস্তিত্বকে সম্ভব করে তুলেছে। বৈজ্ঞানিকভাবে পৃথিবীকে একটি জৈব একক হিসেবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি আদিম হলেও পরিবেশ বিপর্যয়ের নতুন প্রেক্ষাপটে গেইয়া তত্ত্ব বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বিশেষ করে, এ তত্ত্ব মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে ঐকতান সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। কিন্তু মানুষ বহু আগেই প্রকৃতির সন্তান থেকে নিজেকে সভ্যতার জনক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এ সভ্যতা তৈরি করতে তাকে প্রচুর কার্বন তৈরি করতে হয়েছে, প্রকৃতির ওপর অবিবেচনাপ্রসূত হামলা করতে হয়েছে। আর এ হামলা প্রকৃতিকে এমন একটি পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়েছে, গেইয়া থিওরির প্রবক্তা নিজেই বলছেন, সময় শেষ। এখন কী হয় তা বসে বসে দেখা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একদা 'প্রকৃতির প্রতিশোধ'-এর কথা বলেছিলেন। জেমস লাভলকও বলছেন গেইয়ার প্রতিশোধের কথা। তার একটি বইয়ের নাম রিভেঞ্জ অব গেইয়া। জেমস লাভলকের থিওরি থেকে দর্শনের উৎপত্তি হয়েছে। বোঝা যায়, বেশ একটা প্রভাব তৈরি করতে পেরেছিলেন তিনি। মানুষকে নতুন চিন্তা ও জ্ঞানে উদ্বেলিত করতে পেরেছিলেন। কিন্তু জ্ঞানই শেষ কথা নয়, কর্মোদ্যোগ তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। আজকের পৃথিবীতে মানুষ ভালো করেই জানে, তার কারণেই প্রকৃতির এই রুদ্ররোষ। তার কারণেই এত শীত, এত বৃষ্টি, এত খরা, ঘূর্ণিঝড়, সুনামি। কিন্তু বিশ্বের নেতারা যখন একসঙ্গে বসেন তখন তারা সঠিক কর্মোদ্যোগ নিয়ে একমত হতে পারেন না। কারণ পৃথিবী টিকল কি টিকল না সেই বৃহত্তর স্বার্থের চেয়ে নিজেদের উন্নয়ন ও শিল্পায়নের স্বার্থই বড় তাদের কাছে। এখন মানুষ কী করবে? তারা কী হয় দেখবে আর পারলে আনন্দ-আয়োজন করবে প্রফেসর লাভলকের কথামতো? আর উপায় নেই, এ তথ্য মাথায় নিয়ে কি আনন্দ-আয়োজন সম্ভব? নাকি আরেকবার প্রফেসর লাভলককে অনুরোধ করব, দেখুন না, যদি কোনো উপায় থাকে। যদি কিছু করার থাকে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কিছু করার থাকলে সেটি করার জন্য আমাদের নেতারা কি উদ্যোগ নেবেন?
পানি সম্পর্কে দু'একটি কথা যা আমরা জানি
১. পানি অক্সিজেন ও হাইড্রোজেন_ এ দুই মৌল দিয়ে তৈরি।
২. পানি কঠিন, তরল ও বায়বীয়_ এ তিন আকারে থাকতে পারে।
৩. পানিকে যে পাত্রে রাখা হয়, পানি সেই পাত্রের আকার ধারণ করে।
৪. পৃথিবীর তিন ভাগ জল এবং একভাগ স্থল কথাটি সত্য। কিন্তু তিন ভাগ জলের প্রায় ৯৭% সাগরে থাকে। এ পানি খাওয়ার উপযুক্ত নয়। ২.৪% পানি জমাটবদ্ধ হিমবাহ হিসেবে আছে। ০.০০১% পানি মেঘ ও জলীয় বাষ্প হয়ে আছে। মাটির নিচে আছে ১.৬% পানি। নদী, খাল, বিল, পুকুরে আছে ০.০৬% পানি। মাটির নিচের ১.৬% ও নদী, খাল, পুকুরের ০.০৬% পানিই আমরা নাওয়া-খাওয়া, শিল্পকারখানা, কৃষি ইত্যাদিতে ব্যবহার করি।
৫. যে পানি আমরা মাটির নিচ থেকে তুলি বা জলাশয় থেকে নেই সে পানির ৭০% কৃষিকাজে, ২২% শিল্প কারখানায় ও ৮% ঘরে নাওয়া-খাওয়া ও ধোয়ার কাজে ব্যবহৃত হয়।
৬. পানির অপর নাম জীবন। আমাদের দেহ গঠনের মূল উপাদান পানি।
৭. মাটির নিচের পানি দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। নদীর পানি নিয়েও বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে নানা মাত্রার সংঘর্ষ লাগছে। ২০৫০ সাল নাগাদ পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ মানুষ পরিষ্কার পানির উৎস থেকে বঞ্চিত হবে।
৮. মাটির নিচের পানির বিকল্প নদীর পানি। আগামীর পানি সংকট মোকাবেলায় নদীকে দূষণ ও দখলমুক্ত করার যথাযথ উদ্যোগ আমাদের নেই।
৯. মূল্যবান নদীকে আমরা বর্জ্য ও শিল্পবর্জ্য ফেলার কাজে ব্যবহার করি। পৃথিবীর অনেক বড় শহরে বর্জ্য রিসাইক্লিং করা হয়। অনেক শহর বর্জ্য মাটির নিচে পুঁতে ফেলে। আমরা দুটির কোনোটি না করে নদীতে ফেলি।
১০. ঢাকার পানির মূল উৎস এর চারদিকের নদীগুলো। দখলের কারণে নদীগুলো শীর্ণকায় হয়ে গেছে। আর দূষণের কারণে ঢাকার নদীগুলোর পানি ব্যবহার অযোগ্য হয়ে পড়েছে। ব্যবহার অযোগ্য হলেও এই পানিই মূলত ঢাকা শহরে সরবরাহ করা হচ্ছে। এর বাইরে ভূগর্ভস্থ পানি তুলেও তা বিতরণ করা হয়। কিন্তু মাটির নিচের পানির স্তর দ্রুত নিচে নামছে। আগামী দিনগুলোতে হয়তো মাটির নিচের পানি ব্যবহারের চিন্তা আমাদের পরিত্যাগ করতে হবে।
১১. ঢাকা শহরে এখন যে পানি সংকট দেখা দিয়েছে তা বিশুদ্ধ পানির সংকট নয়, মূলত দূষিত পানির সংকট। বিদ্যুৎস্বল্পতার কারণে দূষিত পানির সরবরাহও বিঘি্নত হচ্ছে।
১২. ঢাকা শহরে ওয়াসার সরবরাহ লাইন থেকে পানি সংগ্রহ করে তা ফুটিয়ে পান করা হয়। রান্নার কাজে ব্যবহৃত গ্যাসের সবচেয়ে বড় অংশ পানি বিশুদ্ধ করতেই ব্যয় হয়।
১৩. পানি সমস্যার কারণে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ডায়রিয়া মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
১৪. খবরে জানা গেছে, বিশুদ্ধ মিনারেল ওয়াটার হিসেবে বাংলাদেশে যে পানি বাজারজাত করা হয় তার একটি অংশ স্রেফ ওয়াসার পাইপলাইন থেকে সরাসরি বোতলজাত করা।
১৫. ঢাকা মহানগরীর সংসদ সদস্যরা আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন যে, পানি-সংকটের কারণে বিক্ষুব্ধ হয়ে জনতা রাস্তায় নামতে পারে।
১৬. কিছু কিছু স্থানে জনতা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেছে। বিক্ষোভে তারা শূন্য হাঁড়ি-পাতিল-কলস প্রদর্শন করেছে।
১৭. পানি ব্যবস্থাপনার জন্য ৭ এপ্রিল থেকে রাজধানীর পাম্পগুলোতে সেনা মোতায়েন করা হয়েছে।
১৮. বেশ কয়েক বছর ধরে গরমে পানি সংকটের সময় সেনা মোতায়েনের রেওয়াজ চলে আসছে।
১৯. সুষ্ঠু পানি ব্যবস্থাপনার জন্য নাকি জনবিক্ষোভ দমনের জন্য সেনা মোতায়েন করা হয় সেটি একটি প্রশ্ন।
২০. বর্ষা এলেই পানি সংকটের কথা সবাই ভুলে যাবে।
২১. শহরের জলাবদ্ধতা নিয়ে নতুন ধরনের আলোচনা শুরু হবে।
২২. যে কোনো সংকট মোকাবেলায় আমাদের কোনো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেই।
২৩. বলা হয়, চীনারা নাকি পরিকল্পনা করলে অন্তত ৫০ বছরের জন্য করে। ভারতীয়রা পরিকল্পনা করে পঞ্চবার্ষিক। পৃথিবীর নানা দেশে নানা মাত্রার পরিকল্পনার কথা আমরা জানি। আমরা পারতপক্ষে পরিকল্পনা করি না। পরিকল্পনার আলোচনা করি এক মৌসুমকে সামনে রেখে।
২৪. পানি নিয়ে ভবিষ্যতে আরও যে ভয়াবহ অবস্থা ঘনিয়ে আসছে, তা মোকাবেলার পরিকল্পনা আমাদের নেই।
Mon at 1:08pm
যখন কেউ আপনেরে হাইসা উড়ায়ে দিতে চায় তখন বুঝবেন জিনিশটা হাইসা উড়ায়ে দেওয়ার মতো না বইলাই এমনে উড়ায়ে দিতে চাইতেছে।
Tue at 3:35pm
বিদ্যুত সমস্যা?এইটা তো আমরা করি নাই, ওরা করছে। পানি? এইটা তো আমরা করি নাই ওরা করছে। ওরা আইলেও একই কথা। তাইলে সমস্যাটা করলো কে?
চার হাজার বন্ধু থাকার সুবিধা
চার হাজার বন্ধু থাকার সুবিধা হইলো অন্তত ৫০ জন আপনেরে রিমুভ না দিলে আপনে টেরও পাইবেন না। দুই তিনজন রিমুভ দিয়া গেলে একবছর পর বুঝবেন। এমনও হইতে পারে কোনোদিনও বুঝতে পারলেন না। এইটারে নাম দেওয়া যায়- বন্ধুত্বের গণ্ডার দশা।
তোমার জন্য একটা গিফট খুঁজতে গিয়া
তোমার জন্য একটা গিফট খুঁজতে গিয়া কত যে পেরেশান হইলাম! কিছু তো পছন্দ হয় না। সোনার খনির কাছে সোনা কিংবা সাগরে পানি নিয়া যাওয়ার মানে কী? ...হৃদয় ও আত্মা দেওয়ারও কারণ নাই; এইগুলা তোমার আছে। তাই, তোমার জন্য নিয়া আসলাম একটা আয়না। নিজের চেহারার মধ্যে এখন আমারে দেখো। -জালালুদ্দীন রুমী
Subscribe to:
Posts (Atom)