Friday, December 21, 2012

গণতন্ত্র ও রাজতন্ত্র :: মাহবুব মোর্শেদ


তেল ও জল যে কারণে মিশ খায় না, ঠিক একই কারণে গণতন্ত্রের সঙ্গে রাজতন্ত্রের মেলবন্ধন ঘটার কথা নয়শাসন-রীতি হিসেবে দুটি পরস্পরবিরোধীরাজা বা রানী থাকলে গণতন্ত্র থাকার কথা নয়আবার গণতন্ত্র থাকলে রাজা-রানী থাকার কথা নয়কিন্তু পৃথিবীর নানা বৈচিত্র্যের মধ্যে এও এক বৈচিত্র্য যে, একই রাষ্ট্রে গণতন্ত্র ও রাজতন্ত্রও মিলেমিশে পারস্পারিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতেই টিকে থাকতে পারেএমন বেশ কিছু উদাহরণ পাওয়া যাবেকিন্তু এক্ষেত্রে ব্রিটেন বোধ হয় শ্রেষ্ঠ উদাহরণব্রিটিশ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বহুল প্রশংসিতবিশ্বব্যাপী একে আদর্শ ব্যবস্থা হিসেবেই দেখা হয়আর রাজতন্ত্রের বেলাতেও ব্রিটেন আদর্শএমন আড়ম্বড়পূর্ণ, বহুল আলোচিত রাজতন্ত্রও বোধ হয় পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া ভারব্রিটিশরা বহু পূর্বে তেল ও জল আলাদা পাত্রে রাখার ব্যবস্থা করেছেরাজারটা রাজাকে, গণতন্ত্রেরটা মন্ত্রিসভাকে বিলি-ব্যবস্থা করে দিয়েছেশাসন, প্রশাসন ও পরিচালনার সঙ্গে রাজা-রানীর সম্পর্ক নেইসেসব কাজ করেন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাইরাজতন্ত্রের কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকতা পর্যন্ত সীমাবদ্ধরাজতন্ত্র আনুষ্ঠানিকতা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকলেও, আনুষ্ঠানিকতার কোনো সীমা-পরিসীমা নেইরাজতন্ত্র ব্রিটিশদের কাছে চলমান রূপকথাগণতন্ত্রের সুখ ও স্থিতিকে রূপকথার সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েছে তারারানীর সিংহাসনে আরোহণের ষাট বছর পূর্তি তারা এমনভাবে পালন করে যে, দুনিয়া পুরনো সাম্রাজ্যের স্মৃতি মনে করতে বাধ্য হয়আবার রাজপরিবারের ছেলেমেয়ের বিয়ে এমন ঘটা করে পালন করে যে, দুনিয়া রুদ্ধশ্বাসে তা দেখতে বাধ্য হয়প্রিন্স আর প্রিন্সেসদের নিয়ে মিডিয়া সবসময়ই সরগরমপ্রিন্সেস কেট সন্তানসম্ভবা হয়ে কিছুদিন আগেই মিডিয়াকে একদফা নাড়া দিয়েছেনবিষয় দেখে মনে হয়, যুক্তরাষ্ট্রের যেমন হলিউডের রূপকথার জগৎ, যুক্তরাজ্যের তেমনি রাজতন্ত্ররাজপরিবার একদা সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করত, এখন সে পরিবারের অনেক সদস্য জনগণের হৃদয়-সম্রাট হওয়ার সাধনায় রতপ্রিন্সেস ডায়ানার কথা এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়তবে, হৃদয়-সম্রাট হয়েও ক্ষমতার দ্বন্দ্বে তাদের কখনও লিপ্ত হতে দেখা যায় নাকেননা, আনুষ্ঠানিক রাজতন্ত্রের আনুষ্ঠানিকতায় ক্ষমতা কম নয়ব্রিটেনে রানীর ভূমিকা আনুষ্ঠানিকরানী এলিজাবেথ কাগজে-কলমে রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধানশুধু ব্রিটেন নয়, সার্বভৌম ১৬টি রাজ্যের প্রধান তিনি৫৪ সদস্যবিশিষ্ট কমনওয়েলথ সংঘেরও প্রধান তিনিআর রানীই চার্চ অব ইংল্যান্ডের সুপ্রিম গভর্নর, বিশ্বাসের রক্ষকবলতে গেলে ধর্মীয় দিক থেকেও তিনি প্রধান ব্যক্তিএমন একজন ব্যক্তি আনুষ্ঠানিক দায়িত্বে থাকলেও শাসনকার্যে নাক গলাবেন না- তা কি হয়? আমাদের দেশে হয়তো হয় না, কিন্তু ব্রিটেনে হয়হয় বলেই, গণতন্ত্রের সঙ্গে  রাজতন্ত্রের মৌতাত চলছে প্রশুহীনভাবেরীতি অনুসারে রানী কখনোই মন্ত্রিসভার বৈঠকে যান নাএবার একটু ব্যতিত্রক্রম ঘটল১৭৮১ সালের পর প্রথম কোনো রাজা বা রানী মন্ত্রিসভার বৈঠকে গেলেনব্রিটেনে রাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের মধ্যে একটা বৈপরীত্য আছেরাজতন্ত্র যেখানে আড়ম্বর আর আনুষ্ঠানিকতায় ভরা, গণতন্ত্র সেখানে ততটাই অনানুষ্ঠানিক আর সাধারণরানী মন্ত্রিসভায় গেলে কী ঘটে- সে দৃশ্যটা দেখার জন্যই টেলিগ্রাফ পত্রিকার অ্যালবাম দেখছিলাম১০ নম্বর ড্রাউনিং স্ট্রিটে কোনো সাজ সাজ রব নেইরানী এলিজাবেথ আসবেন, না হরিপদ কেরানী আসবেন, তা ১০ নম্বরের সাদামাটা দরজাটি দেখে বোঝার উপায় নেইএকান্তই রানী আসবেন, তাই খুঁজে পেতে একটা লালগালিচা বিছানো হয়েছেনীল পোশাকে সজ্জিত রানীকে ১০ নম্বরের গোড়ায় মাথা নুইয়ে স্বাগত জানালেন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনভেতরে নিয়ে মন্ত্রীদের সঙ্গে পরিচয় করালেনতারপর সোজা মন্ত্রিসভার বৈঠকসেখানে রানীর জন্য নেই কোনো সিংহাসন; চেয়ারে নেই আলাদা কোনো আড়ম্বরসবার চেয়ার সমানপ্রধানমন্ত্রীর চেয়ারও আর সবার মতোআর সে চেয়ার একদিকে আলাদা করে বসানোও নয়অল্প আলাপ-আলোচনার পর মন্ত্রীরা তাকে উপহার দিলেন, একসঙ্গে বসে ছবি তুললেনব্যসপররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম হেগ এবার রানীকে বিদায় জানাতে বেরুলেন ১০ নম্বর থেকেএত বছর পর রানী এলেন মন্ত্রিসভায়, কিন্তু কোনো আড়ম্বর ছাড়াই সব শেষ হয়ে গেলতারপরও গণমাধ্যম বলছে, রানীকে উষষ্ণ আতিথেয়তা দিয়েছে মন্ত্রিসভাউষষ্ণতা কি তাহলে তাদের হৃদয়ে ছিল? হতে পারেআমাদের দেশে এমন সাদামাটা দৃশ্যই রূপকথার মতো শোনায়সিংহাসন, আড়ম্বর, আনুষ্ঠানিকতা, হায়ারার্কি, প্রটোকলের এমন বাড়বাড়ন্ত এখানে যে, মনে হতে পারে রাজতন্ত্র আমাদের নেই বটে কিন্তু প্রকৃত রাজতন্ত্র দেখতে হলে ব্রিটেন নয়, আমাদের দেশেই আসতে হবে

No comments:

Post a Comment