তেল ও জল যে কারণে
মিশ খায় না,
ঠিক একই কারণে গণতন্ত্রের
সঙ্গে রাজতন্ত্রের মেলবন্ধন ঘটার কথা নয়। শাসন-রীতি হিসেবে দুটি পরস্পরবিরোধী। রাজা বা রানী থাকলে গণতন্ত্র থাকার কথা নয়। আবার গণতন্ত্র থাকলে রাজা-রানী থাকার কথা নয়। কিন্তু পৃথিবীর নানা বৈচিত্র্যের মধ্যে এও এক বৈচিত্র্য যে, একই রাষ্ট্রে গণতন্ত্র ও রাজতন্ত্রও মিলেমিশে পারস্পারিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতেই টিকে থাকতে পারে। এমন বেশ কিছু উদাহরণ পাওয়া যাবে। কিন্তু এক্ষেত্রে ব্রিটেন বোধ হয় শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। ব্রিটিশ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বহুল প্রশংসিত। বিশ্বব্যাপী একে আদর্শ ব্যবস্থা হিসেবেই দেখা হয়। আর রাজতন্ত্রের বেলাতেও ব্রিটেন আদর্শ। এমন আড়ম্বড়পূর্ণ, বহুল আলোচিত রাজতন্ত্রও
বোধ হয় পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া ভার। ব্রিটিশরা বহু পূর্বে
তেল ও জল আলাদা পাত্রে রাখার ব্যবস্থা করেছে। রাজারটা রাজাকে, গণতন্ত্রেরটা
মন্ত্রিসভাকে বিলি-ব্যবস্থা করে দিয়েছে। শাসন,
প্রশাসন ও পরিচালনার
সঙ্গে রাজা-রানীর সম্পর্ক নেই। সেসব কাজ করেন নির্বাচিত
জনপ্রতিনিধিরাই। রাজতন্ত্রের কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকতা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। রাজতন্ত্র আনুষ্ঠানিকতা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকলেও, আনুষ্ঠানিকতার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। রাজতন্ত্র ব্রিটিশদের কাছে চলমান রূপকথা। গণতন্ত্রের সুখ ও স্থিতিকে
রূপকথার সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েছে তারা। রানীর সিংহাসনে আরোহণের
ষাট বছর পূর্তি তারা এমনভাবে পালন করে যে, দুনিয়া পুরনো সাম্রাজ্যের স্মৃতি মনে করতে বাধ্য হয়। আবার রাজপরিবারের ছেলেমেয়ের বিয়ে এমন ঘটা করে পালন করে যে, দুনিয়া রুদ্ধশ্বাসে তা দেখতে বাধ্য হয়। প্রিন্স আর প্রিন্সেসদের নিয়ে মিডিয়া সবসময়ই সরগরম। প্রিন্সেস কেট সন্তানসম্ভবা হয়ে কিছুদিন আগেই মিডিয়াকে একদফা নাড়া দিয়েছেন। বিষয় দেখে মনে হয়, যুক্তরাষ্ট্রের যেমন হলিউডের রূপকথার জগৎ, যুক্তরাজ্যের তেমনি রাজতন্ত্র। রাজপরিবার একদা সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করত, এখন সে পরিবারের অনেক সদস্য জনগণের হৃদয়-সম্রাট হওয়ার সাধনায়
রত। প্রিন্সেস ডায়ানার কথা এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ
করা যায়। তবে, হৃদয়-সম্রাট হয়েও ক্ষমতার দ্বন্দ্বে তাদের কখনও লিপ্ত হতে দেখা যায় না। কেননা,
আনুষ্ঠানিক রাজতন্ত্রের
আনুষ্ঠানিকতায় ক্ষমতা কম নয়। ব্রিটেনে রানীর ভূমিকা
আনুষ্ঠানিক। রানী এলিজাবেথ কাগজে-কলমে রাজ্যের সাংবিধানিক
প্রধান। শুধু ব্রিটেন নয়, সার্বভৌম ১৬টি রাজ্যের প্রধান তিনি। ৫৪ সদস্যবিশিষ্ট কমনওয়েলথ সংঘেরও প্রধান তিনি। আর রানীই চার্চ অব
ইংল্যান্ডের সুপ্রিম গভর্নর, বিশ্বাসের রক্ষক। বলতে গেলে ধর্মীয় দিক থেকেও তিনি প্রধান ব্যক্তি। এমন একজন ব্যক্তি আনুষ্ঠানিক দায়িত্বে থাকলেও শাসনকার্যে নাক
গলাবেন না-
তা কি হয়? আমাদের দেশে হয়তো হয় না, কিন্তু ব্রিটেনে হয়। হয় বলেই,
গণতন্ত্রের সঙ্গে রাজতন্ত্রের মৌতাত চলছে প্রশুহীনভাবে। রীতি অনুসারে রানী কখনোই মন্ত্রিসভার বৈঠকে যান না। এবার একটু ব্যতিত্রক্রম ঘটল। ১৭৮১ সালের পর প্রথম কোনো রাজা বা রানী মন্ত্রিসভার বৈঠকে গেলেন। ব্রিটেনে রাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের মধ্যে একটা বৈপরীত্য আছে। রাজতন্ত্র যেখানে আড়ম্বর আর আনুষ্ঠানিকতায়
ভরা, গণতন্ত্র সেখানে ততটাই অনানুষ্ঠানিক আর সাধারণ। রানী মন্ত্রিসভায় গেলে কী ঘটে- সে দৃশ্যটা দেখার জন্যই টেলিগ্রাফ পত্রিকার
অ্যালবাম দেখছিলাম। ১০ নম্বর ড্রাউনিং স্ট্রিটে কোনো সাজ সাজ
রব নেই। রানী এলিজাবেথ আসবেন, না হরিপদ কেরানী আসবেন, তা ১০ নম্বরের সাদামাটা দরজাটি দেখে বোঝার
উপায় নেই। একান্তই রানী আসবেন, তাই খুঁজে পেতে একটা লালগালিচা বিছানো হয়েছে। নীল পোশাকে সজ্জিত রানীকে ১০ নম্বরের গোড়ায় মাথা নুইয়ে স্বাগত
জানালেন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন। ভেতরে নিয়ে মন্ত্রীদের
সঙ্গে পরিচয় করালেন। তারপর সোজা মন্ত্রিসভার বৈঠক। সেখানে রানীর জন্য নেই কোনো সিংহাসন; চেয়ারে নেই আলাদা কোনো আড়ম্বর। সবার চেয়ার সমান। প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারও আর সবার মতো। আর সে চেয়ার একদিকে আলাদা করে বসানোও নয়। অল্প আলাপ-আলোচনার পর মন্ত্রীরা তাকে উপহার দিলেন, একসঙ্গে বসে ছবি তুললেন। ব্যস। পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম
হেগ এবার রানীকে বিদায় জানাতে বেরুলেন ১০ নম্বর থেকে। এত বছর পর রানী এলেন মন্ত্রিসভায়, কিন্তু কোনো আড়ম্বর ছাড়াই সব শেষ হয়ে গেল। তারপরও গণমাধ্যম বলছে, রানীকে উষষ্ণ আতিথেয়তা দিয়েছে মন্ত্রিসভা। উষষ্ণতা কি তাহলে তাদের হৃদয়ে ছিল? হতে পারে। আমাদের দেশে এমন সাদামাটা দৃশ্যই রূপকথার মতো শোনায়। সিংহাসন,
আড়ম্বর, আনুষ্ঠানিকতা, হায়ারার্কি, প্রটোকলের এমন বাড়বাড়ন্ত এখানে যে, মনে হতে পারে রাজতন্ত্র আমাদের নেই বটে কিন্তু প্রকৃত রাজতন্ত্র দেখতে হলে ব্রিটেন নয়, আমাদের দেশেই আসতে হবে।
No comments:
Post a Comment