Friday, January 4, 2013

অতিথি সৎকার

বাঙালি সম্পর্কে যেসব কথা প্রচলিত তার মধ্যে একটি হলো বাঙালির মতো অতিথিবৎসল জাতি খুঁজে পাওয়া ভার। বাঙালি কতটা অতিথিপ্রিয় তা নিয়ে নানা রসিকতাও প্রচলিত। বিশেষত কলকাতার বাঙালিদের অতিথিবাৎসল্য নিয়ে বাংলাদেশের বাঙালিরা প্রায়ই রঙ্গরস করেন। এই রঙ্গরস দেখে মনে হয় বিপুলসংখ্যক বাঙালি হয়তো ততটা অতিথিবৎসল নাও হতে পারেন। তবু অতিথিবৎসল বলে বাঙালির খ্যাতি। বাঙালির ভাষা অবশ্য তার অতিথিবাৎসল্যের পক্ষে যুক্তি দেয় না। ইংরেজি ভাষায় অতিথির প্রতিশব্দ গেস্ট, আর যিনি আতিথ্য দান করেন তার প্রতিশব্দ হোস্ট। মজার ব্যাপার, বাঙালির অভিধানে হোস্ট শব্দটির প্রতিশব্দ নেই। যিনি আতিথ্য দান করেন বললে ঘুরিয়ে বলা হয়। অনেকে আপ্যায়ক বলতে চান। কিন্তু হোস্ট শব্দটির সমার্থক কোনো একক বাংলা শব্দের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া ভার। তাহলে বাঙালির অতিথিবাৎসল্যের ভাষাগত প্রমাণ কী? একথা ঠিক, বাংলায় অনেক বিদেশি শব্দ ঢুকেছে। মজার ব্যাপার, গেস্ট শব্দটি যতটা সহজে ব্যবহৃত হয় তত সহজে হোস্ট শব্দটির ব্যবহার হতে দেখা যায় না। ফারসি থেকে বাংলায় এসেছে মেহমান। বাংলাভাষাভাষী মানুষরা মেহমান শব্দটিও বেশ ব্যবহার করেন। কিন্তু মেজবান অর্থাৎ হোস্ট শব্দটির ব্যবহার এ দেশে নেই। বাংলাদেশের অল্প কিছু অঞ্চলে মেজবান শব্দটির ব্যবহার আছে। কিন্তু ব্যাপক অর্থে মেজবান শব্দটি প্রচলিত হয়নি। তবে কি বাঙালি নিজেকে অতিথি হিসেবে দেখতেই পছন্দ করে, আতিথ্যদানকারী হিসেবে নয়? আর সে জন্যই কি ভাষায় এক কথায় প্রকাশযোগ্য কোনো শব্দই তারা তৈরি করেনি? এ নিয়ে নিশ্চয় সমাজতাত্তি্বক ও ভাষাতাত্তি্বকরা কিছু বলতে পারবেন। আপাতত অতিথি সেবা নিয়ে বাঙালির সংস্কৃতিই আমাদের আলোচ্য। অতিথি সেবায় বাঙালির কুকীর্তির তালিকা দীর্ঘ। যেসব মাইগ্রেটরি বার্ড শীতপ্রধান দেশ থেকে বাংলাদেশে আসে তাদের আদর করে বাঙালি অতিথি পাখি বলে ডাকে। মুসাফির পাখিগুলোকে অতিথি পাখি বলা হচ্ছে তা নিশ্চয় ভালো। কিন্তু আতিথ্য তো দিতে হবে। কিন্তু আতিথ্যের দিকে তেমন মন নেই বাঙালির। তারা অতিথি নিধনে ওস্তাদ। সম্প্রতি অতিথি নিধন ও সৎকারের নানা খবর দেখে মনে হয়, আতিথ্য ব্যাপারটাই এ দেশে দুর্লক্ষ্য। বাংলা একাডেমীর ব্যবহারিক অভিধানে সৎকার শব্দটির যেসব অর্থ দেওয়া আছে সেগুলো হলো সম্মান, সমাদর, খাতির সেবা। সৎকারের আরেক অর্থ অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া, মৃতদেহের শেষকৃত্য। বাঙালি সম্মান বা সমাদর অর্থে পাখির সৎকার করছে বলে মনে হয় না। তারা শেষকৃত্য অর্থেই সৎকার চালাচ্ছে। এমন ঘটলে যে অতিথি আসবে না তা বলাই বাহুল্য। ফলে বাঙালিকে আতিথ্যদানের রীতিটা রপ্ত করতে হবে। পাখিদের দিয়ে শুরু হোক, পরে মানুষের কথা ভাবা যাবে।

No comments:

Post a Comment