পশ্চিমে হলুদ রঙকে কিছুটা নেতিবাচক হিসেবেই দেখা হয়। হলুদ সেখানে বিবর্ণতার
প্রতীক, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্ষতিকর রঙ বলেও বিবেচিত। ইয়েলো জার্নালিজম
কথাটির উদ্ভব পশ্চিমে। কেন খারাপ সাংবাদিকতাকে ইয়েলো জার্নালিজম বলা হয়?
উত্তরে একজন প্রখ্যাত সাংবাদিক বলেছিলেন, ইয়েলো জার্নালিজম ইয়েলো বলেই
ইয়েলো। বোঝা যায়, এ রঙটার প্রতিই এক ধরনের বিরাগ আছে। পশ্চিমে কেউ হলুদ
জামা পরে বেরোলে তাকে দর্শকদের কাছে ম্লান বলে মনে হতে পারে। রঙের যেমন
দেশকাল আছে, তেমনি রাজনীতিও আছে। সংস্কৃতিভেদে রঙের প্রতি মানুষের সাড়া
দেওয়ার ক্ষেত্রেও পার্থক্য আছে। আমাদের দেশে অপরাধী বা খারাপ লোকের কালো
হাত ভেঙে দেওয়ার স্লোগান ওঠে সচরাচর। কালো অমঙ্গলের প্রতীক এখানে? কালো
কীভাবে অমঙ্গলের প্রতীক হয়ে উঠল? এর পেছনে কোনো বর্ণবাদী ইতিহাস নেই তো?
সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর ব্র্যান্ড কালার লাল। লাল বিপ্লবের রঙ, তাই এসব
দেশের পতাকায় লাল থাকবেই। যে কোনো রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে লাল রঙের ব্যবহার
অবশ্যম্ভাবী। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ও লালের দেখাদেখি ইসলামী বিপ্লবের দেখাও
মিলেছে নানা দেশে। সেসব দেশে সবুজের ছড়াছড়ি। সবুজ হয়ে উঠেছে ইসলামী
বিপ্লবের প্রতীক। ভারতীয় উপমহাদেশ ঐতিহ্যগতভাবেই রঙিন ভূখণ্ড। এখানকার
প্রকৃতিতে হাজারো রঙের খেলা। ধারণা করা যায়, অতীতে এ দেশে কালো রঙ নেতিবাচক
বলে বিবেচিত হতো না। সাদা, হলুদ, সবুজও নয়। যে হলুদ পাশ্চাত্যে নেতিবাচক
রঙ বলে বিবেচিত, এ দেশে তা রীতিমতো উৎসবের প্রতীক। আমাদের দেশে বিয়ের আগে
গায়ে হলুদ দেওয়ার রেওয়াজ। হলুদ এখানে জীবন ও উর্বরতারও প্রতীক। বিয়ে বা
জন্মসংক্রান্ত নানা আচারে হলুদের ব্যবহার সে কথাই মনে করিয়ে দেয়। শুধু
বিয়েতেই নয়, নানা ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে হলুদ রঙের ছড়াছড়ি পড়ে যায়।
ফাল্গুনের প্রথম দিন মেয়েরা হলুদ শাড়ি পরে বের হয়। ছেলেরাও কম যায় না। কেউ
হলুদ পোশাক পরে বেরোলে খুব উজ্জ্বল ও আনন্দিত মনে হয় তাকে। ফলে হলুদ এখানে
ইতিবাচক সংকেতই দেয়। কিন্তু আমাদের প্রকৃতিতে হলুদ কোথায়? দিগন্তজোড়া সবুজ
আমাদের আছে। ধানক্ষেত যখন পরিপকস্ফ হয়ে ওঠে, তখন হলুদাভ রঙ ধারণ করে বটে
কিন্তু সে তো ধানগাছের জীবনের অন্তিম অবস্থাকেই নির্দেশ করে। বসন্তে গাছের
পাতা হলুদ হয়ে ঝরে যায়। নতুন কচি পাতা জাগে। হলুদ ফুলও তো ফোটে কত গাছে।
কিন্তু দিগন্ত বিস্তৃত হলুদ কোথায় আমাদের দেশে? দিগন্ত বিস্তৃত
শর্ষেক্ষেতের মাঠের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে কি এ প্রশ্ন করা সম্ভব? শীতকাল এলে
কি হলুদ রঙ না দেখে থাকা সম্ভব এই বাংলায়? শর্ষেক্ষেতে এখন ফুল ফোটার সময়।
ফুল মানেই শুধু বর্ণ নয়, গন্ধেরও মৌতাত। মৌমাছি শর্ষে ফুল থেকে মধু নিয়ে
মৌচাক ভরে ফেলে। আর বসন্তে সে মধুই হয়ে ওঠে মিষ্টি। মৌমাছি মধু নেয়,
কিন্তু মানুষ কী নেয়? হলুদ শর্ষে ফুল উৎসবের বার্তা নিয়ে আসে। আর ক'দিন
পরেই যে উৎসবে উৎসবে মেতে উঠবে সবাই সে কথাই হয়তো এ রঙ বলে যায়। অবশ্য
শহরের জীবনে হলুদ কেন কোনো রঙই নেই। শহরে বসে বড়জোর চোখে শর্ষে ফুল দেখা
সম্ভব। চোখে শর্ষে ফুল দেখলে কি বিভ্রম হয়? যদি না-ই হবে তবে এমন কথা কেন
তৈরি হলো?
No comments:
Post a Comment