নোবেল সাহিত্য পুরস্কার নিয়ে বাঙালির গর্ব, আশাবাদ ও দীর্ঘশ্বাসের শতবর্ষ
পূর্ণ হতে যাচ্ছে আগামী বছর। সাহিত্যমনা বাঙালিকে এইটুকু মনে করিয়ে দেওয়াই
যথেষ্ট। আপনাআপনি মনে পড়ে যাবে ইতিহাসের ঘটনাক্রম। ১৯১৩ বাঙালির জীবনে
গুরুত্বপূর্ণ বছর। দু'বছর আগে বঙ্গভঙ্গ রদ হয়েছে। আপাতত বাঙালির দেশভাগ
ঠেকানো গিয়েছে বটে, কিন্তু ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী একই বছর পাকাপোক্তভাবে কলকাতা থেকে সরে
গিয়েছে নতুন দিল্লিতে। এর মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ ভারতের কেন্দ্র হিসেবে কলকাতা
ছিটকে পড়ল। গভীর হতাশায় নিমজ্জিত হলো বাঙালি। অবশ্য হতাশার সঙ্গে ছিল আশাও।
কেননা, কলকাতাই তখন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্র। স্বাধীন দেশের
স্বপ্নে বিভোর কলকাতায় চলছে স্বদেশি আন্দোলন। এ সময়ই ১৯১৩ সালে, এসেছিল
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল বিজয়ের সংবাদ। ওই সময়ে, হতাশার গভীরে নিমজ্জিত
বাঙালি রবীন্দ্রনাথকে অভিনন্দন জানাবে কি-না তা নিয়ে ছিল দ্বিধান্বিত।
দুর্মুখরা বলেছিলেন, নাকের বদলে নরুণ জুটলো। কিন্তু সাহিত্য সম্পর্কে
ওয়াকিবহাল মানুষমাত্রই জানেন, ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার তাৎপর্য।
বিশ্বসাহিত্য বলে যদি কিছু থাকে, তবে সে সাহিত্যের আসরে ১৯১৩ সালেই
পাকাপোক্ত আসন হয়ে গিয়েছিল বাংলা সাহিত্যের। ১৯১৩ সাল পর্যন্ত ইউরোপের
বাইরে কেউ নোবেল পাননি। বস্তুত এর বহু বছর পরও এশিয়া মহাদেশে নোবেল সাহিত্য
পুরস্কার আসেনি। ১৯১৩ সালের পর থেকে বাঙালি সাহিত্যিক ও পাঠকরা ভেবেছেন,
আমাদের সাহিত্য নোবেল পুরস্কারের মতো আন্তর্জাতিক [ইউরোপীয়?] স্বীকৃতি
পাওয়ার যোগ্য এবং সে পুরস্কার আমাদের আওতার মধ্যে। কিন্তু পুরস্কার মেলেনি
গত ৯৯ বছরে। মিলেছে শান্তি ও অর্থনীতিতে। অমর্ত্য সেন ও মুহাম্মদ ইউনূস
বাঙালির ঝাণ্ডাকে সমুন্নত রেখেছেন। কিন্তু যে সাহিত্য নিয়ে বাঙালির গর্ব,
সে সাহিত্য আর নোবেল অর্জন করতে পারল না। শুধু বাংলা ভাষায় নয়, গত ৯৯ বছরে
ভারতীয় কোনো ভাষায় আর সাহিত্য পুরস্কার আসেনি। নোবেল সাহিত্য পুরস্কার
দেওয়া হচ্ছে ১৯০১ থেকে। মাঝে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪০ থেকে ১৯৪৩_ চার
বছর পুরস্কার দেওয়া হয়নি। সে অর্থে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে ১০৭ বার। আর
রবীন্দ্রনাথের পর পুরস্কার পেয়েছেন জাপানের ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা, ১৯৬৮
সালে। ১৯৯৪ সালে পেয়েছেন জাপানেরই কেনজাবুরো ওয়ে। ২০০০ সালে গাও জিনজিয়ান,
চীনা হলেও যিনি ফরাসি নাগরিক। ২০১২ সালে পেলেন মো ইয়ান। সাকুল্যে এই ৫ জন।
তুরস্ক অর্ধেক এশিয়া অর্ধেক ইউরোপে। সে অর্থে ওরহান পামুককেও এশিয়ার
তালিকায় যুক্ত করা যেতে পারে। হিব্রুভাষী সামুয়েল ইউসুফ আগনন, ইসরায়েলের
অধিবাসী। তার পুরস্কারও এশিয়ার বলে ধরতে হয়। বহু মানুষ, বহু জাতির মহাদেশ
এশিয়া। এখানকার সাহিত্যেরও নানা রঙ। তবুও এখানে পুরস্কারের সংখ্যা
অঙ্গুলিমেয়। এশিয়া বঞ্চিত হয়েছে নিশ্চিত। বঞ্চিত হয়েছে ভারতবর্ষও। ভারতবর্ষ
বৈচিত্র্যে মহাদেশ; জনজাতির ঘনত্বেও। এখানকার সাহিত্যিক ঐতিহ্যের গভীরতাও
সুদূরপ্রসারিত। তবু এখানে রবীন্দ্রনাথের পর নোবেল আসেনি। কিন্তু নোবেলই
সাহিত্যের একমাত্র মাপকাঠি নয়। ভারতীয় বা ভারতীয় বংশোদ্ভূত বহু সাহিত্যিক
এখন বিশ্বসভায় পরিচিত। নোবেল না পেলেও বুকার, পুলিৎজারের মতো পুরস্কার
অহরহই তাদের কপালে জুটছে। ভারতীয় সাহিত্য আলাদা করেই সমালোচকদের মনোযোগ
পায়। সে তুলনায় চীনের ভাগ্য খারাপ। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বশক্তি হিসেবে
চীনের অবাক উত্থানের পরও পাশ্চাত্যে মূলধারার চীনের গুরুত্ব কম।
পাশ্চাত্যের প্রতিষ্ঠানগুলো গুরুত্ব দেয় চীনের ভিন্নমতাবলম্বীদের। দালাই
লামা থেকে লিও জিয়াবো পর্যন্ত নোবেল পুরস্কার মানেই চীনের কাছে একটা
অস্বস্তি, প্রত্যাখ্যান ও হতাশার আয়োজন। চীনারা জানেন, যা কিছু মূলধারার
চায়নিজ, তা কখনোই পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হবে না। ফলে, পুরস্কার নিয়ে
তাদের উৎসাহের কারণ নেই। প্রথম চীনা হিসেবে যিনি নোবেল পেলেন, সেই
ঔপন্যাসিক গাও জিনজিয়ানও চীনের কঠোর সমালোচক। চীন থেকে দূরে সরে গিয়ে ভিন
রাষ্ট্রের অধিবাসী। ফলে তার পুরস্কার চীনকে উৎসবে মাতাতে পারেনি, বরং
বিষণ্ন করে তুলেছে। ১৯৩৮ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন পার্ল এস বাক।
মার্কিনি নারী তিনি। চীনের প্রেক্ষাপটে, সে দেশের কৃষকদের জীবনকাহিনী
চিত্রায়িত করেছিলেন। কিন্তু তার নোবেল প্রাপ্তিও চীন উদযাপন করেনি বা করে
না। সে অর্থে মূলধারার চীনা সাহিত্যের নোবেল জয় এই প্রথম। মো ইয়ানের
মাধ্যমে চীনের নবযাত্রা শুরু হলো। বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্বসভায় এতদিনে
চীনের ভেতরের শক্তি স্বীকৃতি পেল। চীন যে একটি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক
শক্তি_ সে তো জানা সবার। এবার সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক অর্থে তার
পুনরুত্থানের সংবাদও জানতে থাকবে সবাই। মো ইয়ানের নোবেল জয় তাই বিশ্বকে মনে
করিয়ে দিল সেই পুরনো প্রবাদ_ জো জিতা ওহি সিকান্দার_ যে জিতবে সেই
আলেকজান্ডার। চীনের জয়রথ এমনভাবে ছুটছে যে, অচিরে আর সব ক্ষেত্রের মতো সে
দেশের শিল্প-সাহিত্য-চলচ্চিত্র নিয়ে বিশ্বে তুমুল আগ্রহ তৈরি হবে। মো ইয়ান
পথ করে দিলেন।
নোবেল সাহিত্য পুরস্কার ঘোষণার দিনক্ষণ যতই ঘনিয়ে আসে, ততই অস্থিরতা বাড়তে থাকে বিশ্বের সাহিত্যিক-সমালোচক ও পাঠক মহলে। বড় বড় পত্রিকা প্রকাশ্যে তাদের ফেবারিট লেখকদের প্রোফাইল প্রকাশ করতে থাকে। নানা বিচার-বিশ্লেষণ, তত্ত্ব-তালাশ তো থাকেই। কে নোবেল পেতে পারেন_ তা নিয়ে রীতিমতো জুয়া খেলা চলে। এই বিচার-বিশ্লেষণে যিনি সবচেয়ে এগিয়ে ছিলেন, তিনি মো'রই প্রতিবেশী জাপানের হারুকি মুরাকামি। পশ্চিমা পত্রিকাগুলোর প্রিয় তালিকার শীর্ষে মুরাকামির নাম এতবার উচ্চারিত হয়েছে যে, সবাই ধরে নিয়েছিলেন_ জনপ্রিয় ধারার মুরাকামিই পেতে যাচ্ছেন এবারের পুরস্কার। তবে, একটি সত্য সবাই জানেন, নোবেল কমিটি আর পূর্বাভাস দুটি পরস্পরবিরোধী ব্যাপার। পূর্বাভাসে যাদের নাম আসে, তারা পুরস্কার পাবেন_ এমন নিশ্চয়তা কেউ দেয় না। নোবেল কমিটি এ বিষয়ে আরেক কাঠি সরেস। অনেকে বলেন, পূর্বাভাসের বাইরের কাউকে পুরস্কার দিতেই তাদের উৎসাহ বেশি। সে কারণে প্রতি বছরই নতুন নতুন চমক তৈরি হয়। আনপ্রেডিক্টেবল বলে এ পুরস্কার নিয়ে মাতামাতির পরিমাণও একটু বেশি। তবে এবার চমকটা একটু বেশিই হয়ে গেছে। মূলধারার কোনো চীনা লেখক পুরস্কার পেতে পারেন_ এ ধারণাটাই তো এতকাল ছিল না। ফলে, অনেকে ধরেই নিয়েছিলেন, মুরাকামি না হোন_ বব ডিলান, উইলিয়াম ট্রেভর, এলিস মুর্নো, পিটার নাদাস, এন'গুগি ওয়া থিওঙ'ও, ইসমাইল কাদারে, আসিয়া জেবার, ফিলিপ রথ, মিলান কুন্ডেরা, অ্যামোস ওজ কিংবা এ রকমই কেউ একজন পাবেন। কিন্তু পুরস্কারটি চলে গেল অন্যরকম একজনের হাতে। এবং তার জগৎটাও আলাদা।
ইউরোপ ও আমেরিকার বাইরে যারা নোবেল সাহিত্য পুরস্কার পান, তাদের ব্যক্তিপ্রতিভার সঙ্গে একটা মহাদেশীয় ব্র্যান্ডিং যুক্ত হয়। পাশ্চাত্যের লেখকদের বেলায় ব্যক্তিগত কৃতি বড়। অন্যদের বেলায় ব্যক্তিগত কৃতিই বড় হয়ে উঠতে বাধা নেই। কিন্তু তাদের অর্জনের সঙ্গে মহাদেশ যুক্ত হয়ে গোল বাধিয়ে দেয়_ ব্র্যান্ডিংটা আপনাআপনি বাজার পেয়ে যায়। যেমন লাতিন আমেরিকার ক্ষেত্রে আমরা পেয়েছিলাম ম্যাজিক রিয়েলিজম ব্র্যান্ডিং। মার্কেজ থেকে শুরু করে ইয়োসা পর্যন্ত সবাইকে এই ব্র্যান্ডের আওতাভুক্ত হয়ে আলোচিত হয়েছেন। সে আলোচনার সবটাই গ্রহণযোগ্য বা যথোচিত নয়, তবু আলাপ হয়েছে। আফ্রিকার ক্ষেত্রেও ব্র্যান্ডিং আছে। আফ্রিকার সাহিত্য আগাপাশতলা রাজনৈতিক, প্রতিবাদী, নিজস্ব জীবন রীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল। চীনের ক্ষেত্রে এতকাল ভিন্নমতই ছিল ব্র্যান্ড, যেমন এককালে সোভিয়েত ইউনিয়নের লেখকদের ভিন্নমত দিয়ে বিচার করা হতো পশ্চিমে। কিন্তু মো ইয়ান তো ভিন্নমতাবলম্বী নন। ফলে নতুন ব্র্যান্ডের খোঁজ পড়েছে। পুরস্কার পাওয়ার পর তার সম্পর্কে যেসব মন্তব্য পাওয়া যাচ্ছে, তাতে নোবেল পুরস্কার কমিটির মূল্যায়নেরই প্রাধান্য। নোবেল পুরস্কার কমিটি বলেছে, তিনি হেলুসিনেটরি রিয়েলিজমের মারফত লোককথা, ইতিহাস ও সাম্প্রতিকের মেলবন্ধন ঘটান। সমালোচকরা বলছেন, হেলুসিনেটরি রিয়েলিজম আদপে ম্যাজিক রিয়েলিজমেরই জাতভাই। মরিচিকাময় বাস্তবতা ও জাদু বাস্তবতার মধ্যে পার্থক্য কী? বলাবাহুল্য, মো ইয়ান আমাদের দেশের মতো পশ্চিমেও ততটা পঠিত নন। নোবেল পাওয়ার কারণে স্বভাবতই পঠিত হবেন এবং পঠিত হওয়ার পরই তার প্রকৃত পরিচয়টি মিলবে। তবে জিম লিচের মতে, তিনি ফ্রান্জ কাফকা ও জোসেফ হেলারের সমগোত্রীয় লেখক। বহুলভাবে ফকনার ও হেমিংওয়ে দ্বারা অনুপ্রাণিত। প্রত্যাশিতভাবেই আন্তর্জাতিক সাহিত্যের প্রতি মো ইয়ানের তীব্র অনুরাগ। তিনি পরবর্তী প্রজন্মের চীনা লেখকদের আন্তর্জাতিক সাহিত্য পড়ার জন্য উৎসাহ দেন। বিশ্বাস করেন, বিশ্বসাহিত্য বলে একটা সর্বজনমান্য বিষয় আসলেই আছে। মহাকবি গ্যয়টে বিশ্বসাহিত্যের প্রস্তাবনা দিয়েছিলেন আর ২০০৯ সালে গ্যয়টের দেশে গিয়ে বিশ্বসাহিত্য ধারণার প্রতি আস্থা জানিয়েছিলেন মো ইয়ান।
মো ইয়ানের আসল নাম গুয়ান মোয়ে। সানডঙ প্রদেশের গাওমি কাউন্টিতে জন্ম ১৯৫৫ সালে। মো ইয়ান মানে 'কথা বলো না'। চীনের লেখক বলে অনেকের ধারণা, তার এই নাম সেন্সরশিপের প্রতিবাদে রাখা। আসলে বাগ্মিতা ও বাচালতার কারণে নিজের মায়ের সমালোচনার মুখেই তিনি এ নাম নেন। তিনি লিখেছেন, '...শিগগিরই আমি শিখে গেলাম কীভাবে নিজের সঙ্গে কথা বলা যায়। আমি রপ্ত করলাম আত্মপ্রকাশের অসাধারণ রীতি_ মুহুর্মুহু বলতে বাগ্মীতা সহকারে শুধু নয়, এমনকি কবিতাতেও যা প্রকাশিত হতে পারে। একবার মা শুনে ফেলল, আমি গাছের সঙ্গে কথা বলছি। গভীর চিন্তায় পড়ে তিনি বাবাকে বললেন, পুত্রের পিতা, তোমার কি মনে হয় না ওর কোনো সমস্যা হয়েছে? পরে যথেষ্ট বড় হওয়ার পর আমি বড়দের সমাজে ঢুকলাম শ্রমিক ব্রিগেডের একজন সদস্য হিসেবে। তখনও অভ্যাসবশত গরু চরানোর সময় আমি নিজে নিজে কথা বলতাম। এটা আর কোনো সমস্যা তৈরি না করলেও আমার পরিবারে বড় আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়াল। আমার মা অনুরোধ করে বললেন, পুত্র, তুমি কি কখনও কথা বন্ধ করতে পার না? তার মুখভঙ্গিতে আমার চোখে পানি এসে গেল। আমি কথা দিলাম, কথা বন্ধ করব। কিন্তু ওই মুহূর্ত থেকে সব কথাই আমি জমা করেছি ভেতরে, ইঁদুরেরা যেভাবে বাসা ভরিয়ে তোলে নানা কিছুতে। সেটার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তীব্র অনুশোচনা ও উপচেপড়া অনুভব যে, আমি আমার মায়ের অনুজ্ঞাকে অন্তরে জায়গা দিতে পারিনি। এ কারণেই আমি মো ইয়ান বা কথা বলো না শব্দগুলোকে আমার ছদ্মনাম হিসেবে বেছে নিয়েছি।'
মো ইয়ানের লেখা বহুলভাবে পঠিত না হলেও ইংরেজিতে বেশকটি উপন্যাস অনূদিত হয়েছে। নিবিষ্ট অনুবাদক হাওয়ার্ড গোল্ডব্ল্যাট অনুবাদের কাজটি বছরের পর বছর করছেন। মজার ব্যাপার, অনূদিত এসব বই নিয়ে পাশ্চাত্যের পাঠকদের আগ্রহের পেছনে আছে চলচ্চিত্র। মো ইয়ানের উপন্যাস অবলম্বনে প্রস্তুত চলচ্চিত্র দেখে অনেক পাঠক তার সাহিত্যকৃতি বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এখন অবশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে সারাবিশ্বেই পঠিত হবেন মো ইয়ান। সে কারণটি অবশ্যই নোবেল সাহিত্য পুরস্কার।
মো ইয়ান : যদি মুরগি দর্শনধারী হয়, তবে তাকে ঘিরে উৎসাহ সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু যদি ডিমটাই শুধু উজ্জ্বল হয় আর মুরগি অনুজ্জ্বল, তবে মুরগির দিকে তাকিয়ে সময় নষ্ট করার দরকার নেই।
ডঙ কিয়ান :১১ অক্টোবর ২০১২ তারিখে সুইডিশ একাডেমি ঘোষণা করল, মো ইয়ান তার সাহিত্যকর্মের জন্য নোবেল পুরস্কার পেলেন। তাদের দৃষ্টিতে মরিচিকাময় বাস্তবতার মারফত লোককথা, ইতিহাস ও সাম্প্রতিকের মেলবন্ধন ঘটেছে আপনার সাহিত্যে। আপনি কি তাদের মূল্যায়নের সঙ্গে একমত?
মো ইয়ান : আমার মনে হয়, তারা আমার উপন্যাসগুলো অনুধাবন করতে পেরেছেন। আমি জানি না মরিচিকাময় বাস্তবতা ও লোককাহিনীর মিশ্রণ বলে এগুলোকে চিহ্নিত করা যায় কি-না। আমি বরং বলব, এগুলো উপন্যাস, লোককাহিনী, সামাজিক সমস্যা ও ঐতিহাসিক ঘটনাবলিকে একত্রীভূত করেছে। হয়তো এটা আরও সঠিক।
ডঙ কিয়ান : পুরস্কার পাওয়ার পর আপনার অনুভূতি কী হলো?
মো ইয়ান :পুরস্কার পাওয়ার কথা শুনে আমি আনন্দে বিহ্বল এবং একই সঙ্গে ভীত হলাম।
ডঙ কিয়ান : তার মানে আপনি খুশি হয়েছিলেন?
মো ইয়ান : হ্যাঁ, অবশ্যই। বিস্মিত হয়েছিলাম, কারণ আমি পুরস্কারের আশা করিনি। আর খুশি হয়েছি, কারণ শেষ পর্যন্ত আমি পুরস্কার বিজয়ী। আর ভীত হয়েছিলাম, কারণ এখন পর্যন্ত আমি জানি না কীভাবে কী করব! আমি জানি না, পুরস্কার পাওয়ার ফলে আমার দিকে আরও বেশি মানুষ তাকিয়ে থাকবে কি-না আর তারা আমার ভুল খুঁজে বের করবে কি-না। এসব নিয়েই আমি ভীত।
ডঙ কিয়ান :আপনার কাজগুলো অন্য ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বই আকারে প্রকাশিতও হয়েছে। আপনার কি মনে হয়, অনূদিত হওয়া সত্ত্বেও এগুলো আপনার আইডিয়াকে পাঠকের কাছে পেঁৗছে দিতে সক্ষম?
মো ইয়ান :এটা নিশ্চিত করার কোনো উপায় নেই। পাঠকরা সবখানেই এক রকম। কেউ আমরা লেখা পছন্দ করবে, কেউ করবে না। আমি তাদের বাধ্য করতে পারব না। ফলে, প্রত্যেক লেখক নিজের পাঠককে বেছে নেয়।
ডঙ কিয়ান :আপনার প্রস্তুতি পর্ব কেমন ছিল?
মো ইয়ান :আমি সবসময় বড়দের বলা গল্পগুলো শুনতাম। রূপকথা, ইতিহাস, যুদ্ধের গল্প, মহানায়কদের গল্প, বিপর্যয়ের গল্প।
ডঙ কিয়ান :এগুলো লেখায় কাজে লেগেছে?
মো ইয়ান :এগুলোই আমার লেখার উৎস। আমি এ গল্পগুলোর সবটাই আমার উপন্যাসে ব্যবহার করেছি। বহু যুগের গ্রামীণ জীবন আমার লেখার মহাফেজখানা হিসেবে কাজ করেছে। লেখক না হলে এগুলোর কোনো গুরুত্বই খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু একজন লেখক হিসেবে আমার কাছে এগুলো অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান। আমার মতে, এসবের জন্যই আমার উপন্যাস অন্যদের থেকে আলাদা। ক্ল্যাসিক সাহিত্য পড়ে বড় হলে আমি হয়তো মো ইয়ান হতে পারতাম না।
ডঙ কিয়ান :আপনার বইয়ের বিক্রি তো দারুণভাবে বেড়ে গেছে।
মো ইয়ান :এটা অস্বাভাবিক। কিছুদিন পর আবার সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
ডঙ কিয়ান :আপনি কি খুশি নন? এ তো আপনার আয় বাড়িয়ে দেবে।
মো ইয়ান :উপন্যাসের বিক্রি বেড়ে গেলে আমি নার্ভাস বোধ করি। যত বাড়ে ততই আমার ভয় ধরে যায়। অনেক পাঠক হয়তো মনে করবেন, নোবেল পুরস্কার পাওয়া লেখকের বই ভালোর মধ্যে ভালো; সর্বশ্রেষ্ঠ। তারা যদি বই পড়ে হতাশ হন_ এই ভয়ে আমি শঙ্কিত।
ডঙ কিয়ান :আপনার নোবেল প্রাপ্তি কি চীনা সাহিত্যে নতুন করে আলো ফেলবে, নাকি সবকিছুই আবার আগের অবস্থায় ফিরে যাবে?
মো ইয়ান :শিগগিরই এটা শেষ হয়ে যাবে। লোকে আবার পুরনো পথে ফিরে যাবে।
ডঙ কিয়ান :আপনার কি মনে হয়, আরও বেশি মানুষ সাহিত্য নিয়ে উৎসাহী হবে?
মো ইয়ান :পরিবর্তনটা অল্প সময়ের জন্য। ধীরে ধীরে এই পরিবর্তন অপসৃত হবে। সবাই সামনে এগুবে জীবনের স্বাভাবিক রীতি অনুসারে।
নোবেল সাহিত্য পুরস্কার ঘোষণার দিনক্ষণ যতই ঘনিয়ে আসে, ততই অস্থিরতা বাড়তে থাকে বিশ্বের সাহিত্যিক-সমালোচক ও পাঠক মহলে। বড় বড় পত্রিকা প্রকাশ্যে তাদের ফেবারিট লেখকদের প্রোফাইল প্রকাশ করতে থাকে। নানা বিচার-বিশ্লেষণ, তত্ত্ব-তালাশ তো থাকেই। কে নোবেল পেতে পারেন_ তা নিয়ে রীতিমতো জুয়া খেলা চলে। এই বিচার-বিশ্লেষণে যিনি সবচেয়ে এগিয়ে ছিলেন, তিনি মো'রই প্রতিবেশী জাপানের হারুকি মুরাকামি। পশ্চিমা পত্রিকাগুলোর প্রিয় তালিকার শীর্ষে মুরাকামির নাম এতবার উচ্চারিত হয়েছে যে, সবাই ধরে নিয়েছিলেন_ জনপ্রিয় ধারার মুরাকামিই পেতে যাচ্ছেন এবারের পুরস্কার। তবে, একটি সত্য সবাই জানেন, নোবেল কমিটি আর পূর্বাভাস দুটি পরস্পরবিরোধী ব্যাপার। পূর্বাভাসে যাদের নাম আসে, তারা পুরস্কার পাবেন_ এমন নিশ্চয়তা কেউ দেয় না। নোবেল কমিটি এ বিষয়ে আরেক কাঠি সরেস। অনেকে বলেন, পূর্বাভাসের বাইরের কাউকে পুরস্কার দিতেই তাদের উৎসাহ বেশি। সে কারণে প্রতি বছরই নতুন নতুন চমক তৈরি হয়। আনপ্রেডিক্টেবল বলে এ পুরস্কার নিয়ে মাতামাতির পরিমাণও একটু বেশি। তবে এবার চমকটা একটু বেশিই হয়ে গেছে। মূলধারার কোনো চীনা লেখক পুরস্কার পেতে পারেন_ এ ধারণাটাই তো এতকাল ছিল না। ফলে, অনেকে ধরেই নিয়েছিলেন, মুরাকামি না হোন_ বব ডিলান, উইলিয়াম ট্রেভর, এলিস মুর্নো, পিটার নাদাস, এন'গুগি ওয়া থিওঙ'ও, ইসমাইল কাদারে, আসিয়া জেবার, ফিলিপ রথ, মিলান কুন্ডেরা, অ্যামোস ওজ কিংবা এ রকমই কেউ একজন পাবেন। কিন্তু পুরস্কারটি চলে গেল অন্যরকম একজনের হাতে। এবং তার জগৎটাও আলাদা।
ইউরোপ ও আমেরিকার বাইরে যারা নোবেল সাহিত্য পুরস্কার পান, তাদের ব্যক্তিপ্রতিভার সঙ্গে একটা মহাদেশীয় ব্র্যান্ডিং যুক্ত হয়। পাশ্চাত্যের লেখকদের বেলায় ব্যক্তিগত কৃতি বড়। অন্যদের বেলায় ব্যক্তিগত কৃতিই বড় হয়ে উঠতে বাধা নেই। কিন্তু তাদের অর্জনের সঙ্গে মহাদেশ যুক্ত হয়ে গোল বাধিয়ে দেয়_ ব্র্যান্ডিংটা আপনাআপনি বাজার পেয়ে যায়। যেমন লাতিন আমেরিকার ক্ষেত্রে আমরা পেয়েছিলাম ম্যাজিক রিয়েলিজম ব্র্যান্ডিং। মার্কেজ থেকে শুরু করে ইয়োসা পর্যন্ত সবাইকে এই ব্র্যান্ডের আওতাভুক্ত হয়ে আলোচিত হয়েছেন। সে আলোচনার সবটাই গ্রহণযোগ্য বা যথোচিত নয়, তবু আলাপ হয়েছে। আফ্রিকার ক্ষেত্রেও ব্র্যান্ডিং আছে। আফ্রিকার সাহিত্য আগাপাশতলা রাজনৈতিক, প্রতিবাদী, নিজস্ব জীবন রীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল। চীনের ক্ষেত্রে এতকাল ভিন্নমতই ছিল ব্র্যান্ড, যেমন এককালে সোভিয়েত ইউনিয়নের লেখকদের ভিন্নমত দিয়ে বিচার করা হতো পশ্চিমে। কিন্তু মো ইয়ান তো ভিন্নমতাবলম্বী নন। ফলে নতুন ব্র্যান্ডের খোঁজ পড়েছে। পুরস্কার পাওয়ার পর তার সম্পর্কে যেসব মন্তব্য পাওয়া যাচ্ছে, তাতে নোবেল পুরস্কার কমিটির মূল্যায়নেরই প্রাধান্য। নোবেল পুরস্কার কমিটি বলেছে, তিনি হেলুসিনেটরি রিয়েলিজমের মারফত লোককথা, ইতিহাস ও সাম্প্রতিকের মেলবন্ধন ঘটান। সমালোচকরা বলছেন, হেলুসিনেটরি রিয়েলিজম আদপে ম্যাজিক রিয়েলিজমেরই জাতভাই। মরিচিকাময় বাস্তবতা ও জাদু বাস্তবতার মধ্যে পার্থক্য কী? বলাবাহুল্য, মো ইয়ান আমাদের দেশের মতো পশ্চিমেও ততটা পঠিত নন। নোবেল পাওয়ার কারণে স্বভাবতই পঠিত হবেন এবং পঠিত হওয়ার পরই তার প্রকৃত পরিচয়টি মিলবে। তবে জিম লিচের মতে, তিনি ফ্রান্জ কাফকা ও জোসেফ হেলারের সমগোত্রীয় লেখক। বহুলভাবে ফকনার ও হেমিংওয়ে দ্বারা অনুপ্রাণিত। প্রত্যাশিতভাবেই আন্তর্জাতিক সাহিত্যের প্রতি মো ইয়ানের তীব্র অনুরাগ। তিনি পরবর্তী প্রজন্মের চীনা লেখকদের আন্তর্জাতিক সাহিত্য পড়ার জন্য উৎসাহ দেন। বিশ্বাস করেন, বিশ্বসাহিত্য বলে একটা সর্বজনমান্য বিষয় আসলেই আছে। মহাকবি গ্যয়টে বিশ্বসাহিত্যের প্রস্তাবনা দিয়েছিলেন আর ২০০৯ সালে গ্যয়টের দেশে গিয়ে বিশ্বসাহিত্য ধারণার প্রতি আস্থা জানিয়েছিলেন মো ইয়ান।
মো ইয়ানের আসল নাম গুয়ান মোয়ে। সানডঙ প্রদেশের গাওমি কাউন্টিতে জন্ম ১৯৫৫ সালে। মো ইয়ান মানে 'কথা বলো না'। চীনের লেখক বলে অনেকের ধারণা, তার এই নাম সেন্সরশিপের প্রতিবাদে রাখা। আসলে বাগ্মিতা ও বাচালতার কারণে নিজের মায়ের সমালোচনার মুখেই তিনি এ নাম নেন। তিনি লিখেছেন, '...শিগগিরই আমি শিখে গেলাম কীভাবে নিজের সঙ্গে কথা বলা যায়। আমি রপ্ত করলাম আত্মপ্রকাশের অসাধারণ রীতি_ মুহুর্মুহু বলতে বাগ্মীতা সহকারে শুধু নয়, এমনকি কবিতাতেও যা প্রকাশিত হতে পারে। একবার মা শুনে ফেলল, আমি গাছের সঙ্গে কথা বলছি। গভীর চিন্তায় পড়ে তিনি বাবাকে বললেন, পুত্রের পিতা, তোমার কি মনে হয় না ওর কোনো সমস্যা হয়েছে? পরে যথেষ্ট বড় হওয়ার পর আমি বড়দের সমাজে ঢুকলাম শ্রমিক ব্রিগেডের একজন সদস্য হিসেবে। তখনও অভ্যাসবশত গরু চরানোর সময় আমি নিজে নিজে কথা বলতাম। এটা আর কোনো সমস্যা তৈরি না করলেও আমার পরিবারে বড় আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়াল। আমার মা অনুরোধ করে বললেন, পুত্র, তুমি কি কখনও কথা বন্ধ করতে পার না? তার মুখভঙ্গিতে আমার চোখে পানি এসে গেল। আমি কথা দিলাম, কথা বন্ধ করব। কিন্তু ওই মুহূর্ত থেকে সব কথাই আমি জমা করেছি ভেতরে, ইঁদুরেরা যেভাবে বাসা ভরিয়ে তোলে নানা কিছুতে। সেটার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তীব্র অনুশোচনা ও উপচেপড়া অনুভব যে, আমি আমার মায়ের অনুজ্ঞাকে অন্তরে জায়গা দিতে পারিনি। এ কারণেই আমি মো ইয়ান বা কথা বলো না শব্দগুলোকে আমার ছদ্মনাম হিসেবে বেছে নিয়েছি।'
মো ইয়ানের লেখা বহুলভাবে পঠিত না হলেও ইংরেজিতে বেশকটি উপন্যাস অনূদিত হয়েছে। নিবিষ্ট অনুবাদক হাওয়ার্ড গোল্ডব্ল্যাট অনুবাদের কাজটি বছরের পর বছর করছেন। মজার ব্যাপার, অনূদিত এসব বই নিয়ে পাশ্চাত্যের পাঠকদের আগ্রহের পেছনে আছে চলচ্চিত্র। মো ইয়ানের উপন্যাস অবলম্বনে প্রস্তুত চলচ্চিত্র দেখে অনেক পাঠক তার সাহিত্যকৃতি বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এখন অবশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে সারাবিশ্বেই পঠিত হবেন মো ইয়ান। সে কারণটি অবশ্যই নোবেল সাহিত্য পুরস্কার।
মো ইয়ান নোবেল পাওয়ার পর চীনের রাষ্ট্রীয়
টেলিভিশন সিসিটিভির রিপোর্টার ডঙ কিয়ান তার একটি সাক্ষাৎকার নেন।
সাক্ষাৎকারটির ট্রান্সস্ক্রিপ্ট ছাপা হয়েছে ডায়না ডেইলিতে। সেটির ভাষান্তর পড়ুন।
ডঙ কিয়ান :আমার সবসময় মনে হয়, লেখকরা মুরগির মতো আর তাদের সৃষ্টি ডিমের
মতো। ডিম খাওয়ার সময় আমরা ভাবি না_ মুরগিটি দেখতে কেমন। কিন্তু এখন তো
সোনালি ডিমের প্রসঙ্গ। সবাই এখন সোনালি ডিম পাড়া মুরগি নিয়ে উৎসাহী। আপনার
দিকে সবার দৃষ্টি।মো ইয়ান : যদি মুরগি দর্শনধারী হয়, তবে তাকে ঘিরে উৎসাহ সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু যদি ডিমটাই শুধু উজ্জ্বল হয় আর মুরগি অনুজ্জ্বল, তবে মুরগির দিকে তাকিয়ে সময় নষ্ট করার দরকার নেই।
ডঙ কিয়ান :১১ অক্টোবর ২০১২ তারিখে সুইডিশ একাডেমি ঘোষণা করল, মো ইয়ান তার সাহিত্যকর্মের জন্য নোবেল পুরস্কার পেলেন। তাদের দৃষ্টিতে মরিচিকাময় বাস্তবতার মারফত লোককথা, ইতিহাস ও সাম্প্রতিকের মেলবন্ধন ঘটেছে আপনার সাহিত্যে। আপনি কি তাদের মূল্যায়নের সঙ্গে একমত?
মো ইয়ান : আমার মনে হয়, তারা আমার উপন্যাসগুলো অনুধাবন করতে পেরেছেন। আমি জানি না মরিচিকাময় বাস্তবতা ও লোককাহিনীর মিশ্রণ বলে এগুলোকে চিহ্নিত করা যায় কি-না। আমি বরং বলব, এগুলো উপন্যাস, লোককাহিনী, সামাজিক সমস্যা ও ঐতিহাসিক ঘটনাবলিকে একত্রীভূত করেছে। হয়তো এটা আরও সঠিক।
ডঙ কিয়ান : পুরস্কার পাওয়ার পর আপনার অনুভূতি কী হলো?
মো ইয়ান :পুরস্কার পাওয়ার কথা শুনে আমি আনন্দে বিহ্বল এবং একই সঙ্গে ভীত হলাম।
ডঙ কিয়ান : তার মানে আপনি খুশি হয়েছিলেন?
মো ইয়ান : হ্যাঁ, অবশ্যই। বিস্মিত হয়েছিলাম, কারণ আমি পুরস্কারের আশা করিনি। আর খুশি হয়েছি, কারণ শেষ পর্যন্ত আমি পুরস্কার বিজয়ী। আর ভীত হয়েছিলাম, কারণ এখন পর্যন্ত আমি জানি না কীভাবে কী করব! আমি জানি না, পুরস্কার পাওয়ার ফলে আমার দিকে আরও বেশি মানুষ তাকিয়ে থাকবে কি-না আর তারা আমার ভুল খুঁজে বের করবে কি-না। এসব নিয়েই আমি ভীত।
ডঙ কিয়ান :আপনার কাজগুলো অন্য ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বই আকারে প্রকাশিতও হয়েছে। আপনার কি মনে হয়, অনূদিত হওয়া সত্ত্বেও এগুলো আপনার আইডিয়াকে পাঠকের কাছে পেঁৗছে দিতে সক্ষম?
মো ইয়ান :এটা নিশ্চিত করার কোনো উপায় নেই। পাঠকরা সবখানেই এক রকম। কেউ আমরা লেখা পছন্দ করবে, কেউ করবে না। আমি তাদের বাধ্য করতে পারব না। ফলে, প্রত্যেক লেখক নিজের পাঠককে বেছে নেয়।
ডঙ কিয়ান :আপনার প্রস্তুতি পর্ব কেমন ছিল?
মো ইয়ান :আমি সবসময় বড়দের বলা গল্পগুলো শুনতাম। রূপকথা, ইতিহাস, যুদ্ধের গল্প, মহানায়কদের গল্প, বিপর্যয়ের গল্প।
ডঙ কিয়ান :এগুলো লেখায় কাজে লেগেছে?
মো ইয়ান :এগুলোই আমার লেখার উৎস। আমি এ গল্পগুলোর সবটাই আমার উপন্যাসে ব্যবহার করেছি। বহু যুগের গ্রামীণ জীবন আমার লেখার মহাফেজখানা হিসেবে কাজ করেছে। লেখক না হলে এগুলোর কোনো গুরুত্বই খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু একজন লেখক হিসেবে আমার কাছে এগুলো অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান। আমার মতে, এসবের জন্যই আমার উপন্যাস অন্যদের থেকে আলাদা। ক্ল্যাসিক সাহিত্য পড়ে বড় হলে আমি হয়তো মো ইয়ান হতে পারতাম না।
ডঙ কিয়ান :আপনার বইয়ের বিক্রি তো দারুণভাবে বেড়ে গেছে।
মো ইয়ান :এটা অস্বাভাবিক। কিছুদিন পর আবার সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
ডঙ কিয়ান :আপনি কি খুশি নন? এ তো আপনার আয় বাড়িয়ে দেবে।
মো ইয়ান :উপন্যাসের বিক্রি বেড়ে গেলে আমি নার্ভাস বোধ করি। যত বাড়ে ততই আমার ভয় ধরে যায়। অনেক পাঠক হয়তো মনে করবেন, নোবেল পুরস্কার পাওয়া লেখকের বই ভালোর মধ্যে ভালো; সর্বশ্রেষ্ঠ। তারা যদি বই পড়ে হতাশ হন_ এই ভয়ে আমি শঙ্কিত।
ডঙ কিয়ান :আপনার নোবেল প্রাপ্তি কি চীনা সাহিত্যে নতুন করে আলো ফেলবে, নাকি সবকিছুই আবার আগের অবস্থায় ফিরে যাবে?
মো ইয়ান :শিগগিরই এটা শেষ হয়ে যাবে। লোকে আবার পুরনো পথে ফিরে যাবে।
ডঙ কিয়ান :আপনার কি মনে হয়, আরও বেশি মানুষ সাহিত্য নিয়ে উৎসাহী হবে?
মো ইয়ান :পরিবর্তনটা অল্প সময়ের জন্য। ধীরে ধীরে এই পরিবর্তন অপসৃত হবে। সবাই সামনে এগুবে জীবনের স্বাভাবিক রীতি অনুসারে।
No comments:
Post a Comment