উৎসবের ক্ষেত্রে শহর-গ্রাম বিভাজন আছে কি? কোনটি শহরের উৎসব আর কোনটি
গ্রামের সেটি সহজে চিনে নেওয়ার কোনো সহজ উপায় কী? শহর ও গ্রামের উৎসবের
পার্থক্য বুঝতে সবচেয়ে ভালো উদাহরণ বোধহয় পহেলা বৈশাখ। কৃষিজীবী বাঙালি
বহুযুগ ধরে গ্রামীণ উৎসব হিসেবে বাংলা বছরের প্রথম দিন উদযাপন করে আসছে।
গ্রামের মানুষের কাছে নতুন বছর মানেই চৈত্রসংক্রান্তি, গ্রামীণ মেলা,
হালখাতাসহ নানা আয়োজন। সে উৎসবই শহরে আসার পর নতুন এক রূপ নিয়েছে। শহরে
কৃষিকেন্দ্রিক আচার খুঁজতে যাওয়ার চেষ্টা করা বৃথা। এখানে এসে উৎসবে যুক্ত
হয়েছে বৃক্ষমূলে শহুরে গানের আসর, পান্তা-ইলিশের বাহার। কখন হয়েছে সে খবর
অনেকেই রাখে বটে; কিন্তু কীভাবে হয়েছে সে খবর অল্প লোকই রাখে। এখন পহেলা
বৈশাখ বললে গ্রামীণ কোনো মেলা নয়, বরং শহরের জমজমাট রাজপথের ছবিটাই সবার
আগে ভাসে। ঢাকা থেকে বড় শহরগুলোতে বৈশাখের উৎসব ছড়াচ্ছে। এমনকি গ্রামের
উৎসব গ্রামে ফিরে যাচ্ছে শহুরে আদলে। যুগে যুগে উৎসবের রূপবদল ঘটে যায়
এভাবেই। পহেলা বৈশাখ একটি উদাহরণ; কিন্তু বাংলাদেশের শহুরে বাঙালির উৎসব
শুধু পহেলা বৈশাখ নয়। ফেব্রুয়ারিতে বইমেলাসহ মাসজুড়ে নানা আয়োজনে_ পহেলা
ফাল্গুনে, ২৬ মার্চে, ১৬ ডিসেম্বরে শহুরে বাঙালিই মূলত বাঁধভাঙা উৎসবে পথে
নামে। তুলনা করতে গেলে এমন গ্রামীণ উৎসবের খবর কি মিলবে? সারাদেশে
স্থানীয়ভাবে কত কিছুই হয়। সারাদেশের মানুষ পালন করে এমন গ্রামীণ উৎসব কই।
একথা সত্য, উৎসব আয়োজন ও পালনে এগিয়ে থাকে শহরবাসী। শহরের মানুষেরা
সেক্যুলার উৎসবকেই আপন করে নিয়েছে। ফলে এ উৎসবগুলো ক্রমে জমজমাট হয়ে উঠছে।
ধর্মীয় উৎসবের বেলায় কী ঘটছে? দুই ঈদে বরাবরের রীতি হলো, শহরের লোকেরা
গ্রামে যাবে। ঈদ তাই একান্তই গ্রামপ্রধান। যত আয়োজন গ্রামে। নাই নাই করেও
শহরে তো কম মানুষ থাকে না। তাদের উৎসব কোথায়? শহরে অনেক মানুষ থাকলেও
অধিকাংশের যেন মন ভার। ঘরে ফিরতে না পারার বেদনা পুরো শহরকেই আচ্ছন্ন করে
রাখে। রাস্তাঘাট ম্লান, বিষণ্ন, ফাঁকা। কোথাও উৎসবের আলো নেই। বিপণিবিতান
বন্ধ। যাওয়ার জায়গা নেই, উৎসবে মেতে উঠবার অবকাশ নেই। সামান্য যা আছে তাও
লোকে লোকারণ্য। যারা শহরে থেকে যান তাদের জন্য বড় কোনো আয়োজন হতে পারে না?
উৎসব যদি শুধু টিভির মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে তবে আর উৎসব থাকে কী করে?
ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে, ঢাকার কোটি মানুষ চাইলেও ঈদের আগে ঢাকা ছাড়তে
পারবেন না। বহু মানুষকে শহরেও ঈদ করতে হবে। ভবিষ্যতে এ সংখ্যা বাড়বে বৈ
কমবে না। শহরের মানুষ কি মুখভার করে ঈদ করবে বরাবরের মতো? শহরের ঈদকে কি
উপভোগ্য করা যায় না? শহরের মানুষ সেক্যুলার উৎসবগুলোতে প্রাণ খুলে অংশ নেন।
ধর্মীয় উৎসবগুলোতে তেমন হলে অসুবিধা কী? ধর্মীয় উৎসবগুলোতে শহর জমজমাট হলে
অনেকে উল্টো গ্রাম থেকে শহরে আসবে ঈদ করতে। প্রিয়জনের সঙ্গে মিলতে মানুষ
গ্রামে যায়, প্রিয়জনরা কি একই কাজ করতে ঢাকা আসতে পারেন না? অবশ্যই পারেন।
কেউ কেউ আসেন না, তাও নয়। সংখ্যাটা কম। সংখ্যাটা বাড়লে ক্ষতি কি? তাতে
অন্তত একটা ভারসাম্য তৈরি হবে।
No comments:
Post a Comment