Friday, July 9, 2010

দর্শক সারি

পত্রপত্রিকায় এবারের বিশ্বকাপকে অঘটনের বিশ্বকাপ বলা হচ্ছে। একটি-দুটি নয়, অসংখ্য অঘটনের জন্ম দিয়ে বিশ্বকাপ এখন ফাইনালে। বিশ্বকাপ ফাইনালে গেলেও আমাদের দেশের দর্শকদের অনেকেই ফাইনাল পর্যন্ত আগ্রহ ধরে রাখতে পারছেন না। কারণ, একে একে টপ ফেভারিটরা বিদায় নিয়েছে। ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার বিদায়ের পর থেকে সবাই বলাবলি করছিল, বিশ্বকাপ অন্তত বাংলাদেশে শেষ। বাসাবাড়ির ছাদে তাকালে বোঝা যায় কথাটির তাৎপর্য। আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিলের পতাকার ফাঁকে দু'একটি জার্মানি বা ইংল্যান্ডের পতাকা ছিল বটে। কিন্তু স্পেন আর নেদারল্যান্ডসের পতাকা পেতে হলে দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্য নিতে হবে। কিন্তু মজার ব্যাপার, এ দুটি দেশই এখন ফাইনাল খেলবে। এখন ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার জাতীয় পতাকাগুলো উড়ছে অবহেলায়। এভাবে উড়তে উড়তে বর্ষাতেই ফিকে হয়ে আসবে ওগুলোর রঙ, ছিঁড়ে যাবে একসময়। চার বছর পর আবার হয়তো পতাকাগুলোর কথা মনে পড়বে ভক্তদের। পাড়ায় পাড়ায়, ঘরে ঘরে আবার আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, জার্মানি, ইংল্যান্ডের সমর্থক গোষ্ঠী তৈরি হবে। মনে পড়বে মেসি, কাকাদের কথাও। ভক্তদের বিড়ম্বনার পাশে বিজ্ঞাপনদাতাদের বিড়ম্বনাও কম নয়। পোস্টার বিক্রেতাদের বাজারে পসার কমবে সন্দেহ নেই, পতাকা বিক্রেতাদের বাজারও মন্দা যাবে। কিন্তু লাখ টাকা খরচ করে যারা বিজ্ঞাপন বানিয়ে রেডিও-টিভিতে প্রচার করতে শুরু করেছিলেন তাদের কী হবে? এখন বিজ্ঞাপনগুলোর কিছু সম্প্রচারিত হচ্ছে। শুনে বা দেখে বোঝা যাচ্ছে, ইতিমধ্যে এগুলো ইনভ্যালিড হয়ে গেছে। ভক্তদের পটাতে এ বিজ্ঞাপনগুলো তৈরি হয়েছিল। কিন্তু ভক্তরা পটার আগেই বিদায় নিয়েছে প্রিয় দলগুলো। ফলে এখন ইনভ্যালিড বিজ্ঞাপন বিশেষ টীকাভাষ্য সহকারেই পড়া বা শোনা চলে। বাণিজ্যে দোষ নেই, ভক্ত হওয়াতেও দোষ নেই, ফুটবল নিয়ে এক মাস ধরে যে মধুর বিতর্ক হলো, তাতে তো কোনো দোষই নেই। তাহলে দোষটা কোথায়? দোষ হলো, আমাদের অবস্থানে। বাজারের একটা নিজস্ব নিয়মের কথা বলেন অর্থনীতিবিদরা। বাজারে চাহিদা থাকলে নাকি জোগান আসে। কিন্তু অর্থনীতির এ হিসাব হয়তো ফুটবলের বেলায় খাটে না। বাংলাদেশে মানুষের মধ্যে ফুটবলপ্রেম অকল্পনীয়। আমাদের দর্শকরা নাকি ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার দর্শকদের চেয়ে অনেক কাঠি এগিয়ে। আমাদের বিজ্ঞাপনদাতা, পৃষ্ঠপোষক, মিডিয়া থেকে শুরু করে সবাই ফুটবলবান্ধব। শোনা যায়, রাষ্ট্রনেতারা ফুটবল-অন্তঃপ্রাণ। মাঠ আছে, বল আছে, সবই আছে, শুধু খেলা নেই। খেলা নেই বললে একটু বাড়িয়ে বলা হবে। খেলাও আছে। কিন্তু সে খেলা নিয়ে বিশ্বের দরবারে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। ছোটখাটো গেমসে আমরা কুপোকাত হয়ে ফিরে আসি। ফলে বিশ্বকাপ আমাদের কাছে অনেক দূরের ব্যাপার। প্রশ্ন এখানেই। ফুটবলের এমন জনপ্রিয়তা দেখে কি আমাদের খেলার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের মধ্যে কিছু বোধোদয় হয় না? চার বছর পর কেন আমাদের মনে পড়বে এই খেলার কথা? কেন আজ থেকেই আমরা শুরু করব না। কেন স্কুল থেকে খেলোয়াড় বাছাই করে আমাদের দেশেও ফুটবল নিয়ে একটা হেস্তনেস্ত হবে না? কেন আজ নয়, কাল নয়, বিশ বছর পরও আমরা বিশ্বকাপে খেলতে পারব না? প্রশ্নগুলো এখানেই। এককালে আমাদের মোহনবাগান ছিল, মোহামেডান ছিল, ইস্ট বেঙ্গল ছিল, আবাহনী ছিল। কিন্তু এখন এ ঐতিহ্যের কী হাল তা নিয়ে ভাবতে হবে। অবস্থা দেখে অনেকেই বলেন, আমরা এক নিষ্ক্রিয় জাতিতে পরিণত হয়েছি। বিশ্বের দরবারে আমাদের অবস্থান কোথায়? প্রধানত ভোক্তার আসনে। লোকে জিনিস বানায় আমরা কিনি, আবিষ্কার করে আমরা চেয়ে থাকি, লোকে উন্নতি করে আমরা বিস্মিত হই। বিদেশ আমাদের কাছে সুন্দর, দেশের চেয়ে। কিন্তু দেশকেও যে সুন্দর করা যায়, সে ভাবনা আমাদের নেই। এই নিষ্ক্রিয় দশায় খেলার বেলায়, আমাদের আসনও শুধু দর্শক সারিতে। আমরা খেলতে পারি না, মাঠে আমাদের খেলোয়াড় নেই। শুধু দর্শকের আসনে বসে হাহুতাশ করা, উল্লাস করা ছাড়া যেন কোনো কর্তব্য নেই আমাদের। কিন্তু কেন নেই? আমরা কি এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে পারি না?

No comments:

Post a Comment