Thursday, July 8, 2010

একটি সিমের করুণ কাহিনী


রেডিওতে 'বন্ধ কেন বন্ধু?' বা বন্ধ সিম চালু করার কোনো বিজ্ঞাপন হলেই আমার খুব আনন্দ হয়। মনে হয় এই বুঝি সময় হয়ে এলো, হয়তো এবার পুরনো কাগজের জটলার মধ্যে একটা হলুদ খামের ভেতর আমার অনিশ্চিত জীবনের অন্ত ঘটতে যাবে হয়তো এবার। কিন্তু না। আমার কথা হয়তো মনে নেই, শান্তর। ভুলে গেছে। শান্তকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। প্রায় দুই বছর হতে চলল, আমি অচল হয়ে পড়ে আছি। প্রথমবার খুব বিরক্ত হয়েছিল। জরুরি অবস্থার সময়ের কথা। সরকার থেকে ঘোষণা দেওয়া হলো বাধ্যতামূলকভাবে সবাইকে সিম রেজিস্টার করতে হবে। একটার পর একটা ডেট ঘোষণা হলো, সময় বাড়তে থাকল, কিন্তু শান্ত কিছুতেই সময় পাচ্ছিল না। প্রতিদিনের অফিস, বাসার কাজ, রাস্তায় কেটে যাওয়া অনেক সময় হিসাব করে শেষ দিনটাতেও সময় করে উঠতে পারল না। শান্ত ভাবছিল, হয়তো তার সিমটা বন্ধ হবে না। তার এই ভাবনার পেছনে একটা যুক্তি ছিল। আমাকে যেদিন কিনে আনে, সেদিন পরিচয়পত্রের ফটোকপি, ছবি, টিপসই দিয়ে সব তথ্য দিয়ে এসেছিল। দোকানের লোকেরা বলছিল, এ তথ্য মোবাইল অপারেটরদের কাছে গেলে তবেই আপনার সংযোগ চালু হবে। শান্ত ভাবছিল, সরকারের লোকেরা মোবাইল অপারেটরদের কাছে খুঁজলে নিশ্চয়ই তারা সংরক্ষিত তথ্য তাদের দেবে। কিন্তু শান্তর ভাবনাটা মিলল না। শেষ তারিখ যাওয়ার দু'দিন পর আমি বন্ধ হয়ে গেলাম। সকালবেলা ইনকামিং-আউটগোয়িং বন্ধ হওয়ার পর শান্ত একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেল। তার পস্তানো দেখে আমারও কান্না পাচ্ছিল। আমার ভেতর যত নম্বর সংরক্ষিত ছিল, তার সবই হয়তো পাওয়া যাবে কিন্তু আমাকে কেন্দ্র করে যে নেটওয়ার্ক তা আর মিলবে না। বারবার বলছিল। টিঅ্যান্ডটি থেকে একে-ওকে ফোন করে জেনে নিচ্ছিল কোনোভাবে আর বন্ধ হওয়া সিম চালু করা যায় কি-না। না কেউ-ই কোনো সমাধান দিতে পারছিল না। সকলে বলছিল, দেখো হয়তো আবার ডেট বাড়াবে। না আর ডেট বাড়াল না। আমার মৃত্যু হলো। একটা হলুদ খাম হলো আমার কফিন। খুব যত্ন করে জরুরি কিছু কাগজপত্রের নিচে রেখে দিল আমাকে। নতুন করে একটা সিম কিনে আমার জায়গায় স্থান দিল। আমার ফোনবুকটা ধীরে ধীরে টুকে নিলো সে সিমে। আমি সেই হলুদ খামের ভেতর থেকে দু'বছর ধরে অপেক্ষা করছি। যখনই বিজ্ঞাপন দেয় পুরনো সিম চালু করার, একটা আশা জাগে। ভাবি, এই অফারটা কেমন। নিবন্ধনহীন সিম কি অ্যাকটিভ করা যাবে? শান্তর কি মনে পড়বে আমার কথা? কিন্তু কোনো কিছুই ঘটে না। ড্রয়ারের ভেতর থেকে তবু ভাবতাম, দেশের ভালোর জন্যই আমি মরে আছি। আমি মরে আছি কিন্তু দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে তো এখন সমস্ত সিমের তথ্য আছে। তারা চাইলেই যে কোনো অপরাধীর সিম শনাক্ত করে তাকে ধরতে পারে। কিন্তু তা হয়নি। শান্ত একদিন খুব উত্তেজিতভাবে বলছিল, তাতেই শুনে ফেললাম তথ্য। মন্ত্রীকে ফোনে হুমকি দেওয়ার পর নাকি সিমের লোককে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মোবাইল কোম্পানি, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কেউ তথ্য বের করতে পারছে না। শান্তই বলছিল, সিম নিবন্ধনে এত কড়াকড়ির পরও কেন সন্ত্রাসীরা ফোনে চাঁদা দাবি করছে? মোবাইলের অপরাধ বেড়েই যাচ্ছে? সিম নিবন্ধনে আসলেই কি কোনো কাজ হয়? আসলেই কোটি কোটি সিমের তথ্য সংরক্ষণ করে প্রয়োজনমতো সেখান থেকে কোনো তথ্য বের করার ব্যবস্থা কি আমাদের আছে? শান্ত আমার কথা বলছিল না। কিন্তু আমার কথা হয়তো তার মনের গভীরে কোথাও লুুকিয়ে ছিল। তাই একটু অভিযোগের সুরেই বলছিল কথাগুলো। বলছিল, রাষ্ট্র নাকি নাগরিকদের ওপর নজরদারি করতেই চায়। তাই বৈধ-অবৈধ বিভিন্ন পথে নাগরিকদের ফোনে আড়িপাতে, গতিবিধি নজরদারি করে। কিন্তু তাই বলে নিয়মিত বিরতিতে সিম নিবন্ধনের মতো উদ্যোগ নিয়ে একেবারে কোটি মানুষকে হেনস্তা করার উদ্যোগ বোধহয় খুব কম দেশেই আছে। নজরদারির জন্য রাষ্ট্রকে সচেতন হতে হয়। গোড়ায় ব্যবস্থা নিতে হয়। মোবাইল ফোন কেনাকাটার সময় কড়াকড়ি আরোপ করলেই হয়। এত বছরেও যখন মূল জায়গাটাকে ঠিক করা গেল না, তখন শুধু সিম নিবন্ধন করে কী লাভ? শান্তর বলছিল, নতুন করে সিম নিবন্ধনের কথা শুনে। আমি শান্তর এই নতুন তথ্য শুনে আশঙ্কায় স্থবির হয়ে গেলাম। এবার হয়তো আমার মতোই মরে যাবে অসংখ্য সিম। কিন্তু তার বিনিময়ে কি রাষ্ট্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারবে। অপরাধীদের ধরার একটা নির্ভরশীল ব্যবস্থা কি এবার হবে?

No comments:

Post a Comment