Wednesday, July 7, 2010

ঢাকার রাস্তা ও শুল্কমুক্ত গাড়ি

'রাস্তা ব্যবস্থাপনা' বলে যদি কোনো শাস্ত্র থাকে আর সে শাস্ত্রে যদি ঢাকার রাস্তা ব্যবস্থাপনার কথা পড়ানো হয় তবে সেটি নিশ্চিতভাবেই পৃথিবীর জটিলতম একটি শাস্ত্র হবে। কোটি লোকের ঘনবসতিপূর্ণ শহর ঢাকা। এত লোকের চলাচলের জন্য যে রাস্তা দরকার তা ঢাকায় নেই। এত লোকের বাসস্থানের জন্য যে বাড়ি দরকার তাও নেই। এমনকি বাজার-ঘাটের জন্য যে ব্যবস্থা দরকার তাও নেই। ফলে, বাসস্থান কমিয়ে রাস্তা বাড়ানোর উপায় যেমন নেই, তেমনি রাস্তা কমিয়ে বাসস্থান করার উপায়ও নেই। ফলে ভূমিতে যে পরিমাণ রাস্তা, বাসস্থান, শিল্প-কারখানা আর বাজার-ঘাট আছে তা বোধকরি কোনো বৈপ্লবিক উদ্যোগ ছাড়া একই রকম থাকবে। শহরে উড়াল পথ হতে পারে, পাতাল পথ হতে পারে, পাতাল রেলও হতে পারে। কিন্তু সেসবের দেখা কবে মিলবে সে কথা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না। ফলে যে পথ আমাদের আছে, সে পথটুকুকেই মিলেমিশে ব্যবহার করা ছাড়া আপাতত আমাদের হাতে কোনো উপায় নেই। কিন্তু মিলেমিশে ব্যবহার করার কোনো মানসিকতা আমাদের আছে কি-না তা নিয়ে ভাবা যেতে পারে। জ্যামে আটকে গেলে, সামনে-পেছনে একবার তাকালেই বোঝা যায় রাস্তার সমস্যাটা কী? অভিজাত সড়ক হলে তো কথাই নেই, আমসড়কেও অধিকাংশ যানই প্রাইভেট। রাস্তায় প্রাইভেট কারের প্রাচুর্য নিশ্চয়ই আমাদের সমৃদ্ধির প্রতীক। কিন্তু বিপুল কার যখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা অলস জ্যামে আটকে থাকে তখন সেটা আমাদের অসহায়ত্বের প্রতীক হয়ে ওঠে। আর যখন জ্যামের মধ্যেই গাদাগাদি লোকে ঠাসা লক্কর-ঝক্কর বাসের পাশে এক-দু'জন লোক বহনকারী প্রাইভেট কার দাঁড়িয়ে থাকে তখন সেটা বৈষম্যের প্রতীক যেমন তেমনি আমাদের অপরিণামদর্শী-অপরিকল্পনারও প্রতীক। পৃথিবীর কোনো স্বাভাবিক শহরে এত বেশি প্রাইভেট কার আর এত কম জনপরিবহন থাকতে পারে না। আমরা অবাধে প্রাইভেট কার বাড়তে দিয়েছি। যারা একটু আরামে কাজে যেতে চান তাদের চলার কোনো ব্যবস্থাই এ শহরে নেই। ফলে তারা নিরুপায় হয়ে প্রাইভেট কারের দিকেই ঝুঁকবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কারে কারে অবস্থা এমন জায়গায় গিয়ে ঠেকেছে যে, এ শহরে যার প্রাইভেট কার নেই তার জন্য চলাফেরা ভীষণ কষ্টকর। অবস্থা এমন জায়গায় ঠেকার পর আমাদের নীতিনির্ধারকরা রাস্তা থেকে গাড়ি কমানোর উপায় নিয়ে ভাবছেন। রাস্তা থেকে নতুন গাড়ি উচ্ছেদ করা কঠিন বটে, তাই পুরনো গাড়ি উচ্ছেদের কথা শোনা যাচ্ছে। আর গ্যাসের দাম কম বলে যেহেতু গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে, সে জন্য গ্যাসের দাম দ্বিগুণ করার কথাও ভাবা হচ্ছে। প্রশ্ন হলো, তাতে কি গাড়ির সংখ্যা কমবে? মানুষ বাড়তি দামের গ্যাসেই গাড়ি চালাবে। কিন্তু কেউ যদি শুভ চিন্তা করে গাড়ি ছেড়ে আবার পাবলিক পরিবহনের দ্বারস্থ হন তাকে কি আমরা সুসংবাদ দিতে পারব কোনো? না। তার জন্য আপাতত কোনো সুসংবাদ নেই। রাস্তায় নতুন বাস নামবে, সরকারি ব্যবস্থাপনায় দ্রুত পরিবহনের ব্যবস্থা হবে, টিকিট কেটে লোকে আরামে গন্তব্যে যেতে পারবে_ এসব যেন ক্রমাগত অতিভাবনার বিষয়ে পরিণত হচ্ছে। ঢাকার রাস্তায় বের হয়ে একটি দুঃস্বপ্নযাত্রা করা ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই। এমন দুঃস্বপ্নের সিরিজের মধ্যে একটি সুসংবাদ পাওয়া গেল সোমবারের পত্রিকায়। প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রীদের শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানির প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন। প্রথমত, এটি ঢাকার রাস্তার জন্য সুসংবাদ। একটি প্রাইভেট কার রাস্তায় না নামলেও সেটি সুখের খবর। পাশাপাশি, এই শুল্কমুক্ত গাড়ি ও তার অবৈধ বিকিকিনি যে মন্ত্রী-এমপিদের জীবনে কী উপদ্রব বয়ে আনে তা তো গত জরুরি সরকারের আমলে আমরা দেখেছি। ফলে এমন সিদ্ধান্তের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে সাধুবাদ জানাতে হয়। মন্ত্রীরা না পারলেও এমপিরা ঠিকই গাড়ি আনতে পারবেন। এমপিদের গাড়ি আনার ব্যবস্থাটি বন্ধ করতে পারলে, এমপিদের একটু কষ্ট হতো বটে কিন্তু তিন শতাধিক গাড়ির হাত থেকে ঢাকা বাঁচতে পারত। ঢাকার নিরীহ রাস্তাগুলোর দিকে তাকিয়ে প্রধানমন্ত্রী যদি আরও কিছু গাড়ি সাশ্রয়ের ব্যবস্থা করেন তবে পথ
ও পথিক উভয়েই তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে, এটা নিশ্চিত করে বলা যায়।

No comments:

Post a Comment