বাল্মীকি রামায়ণে লক্ষ্মণ-রেখার উল্লেখ নেই। উত্তর ভারতে বহুল প্রচলিত
রামচরিতমানসের অরণ্যকাণ্ডেও লক্ষ্মণ-রেখার উল্লেখ পাওয়া যায় না। কিন্তু
রামচরিতমানের লঙ্কাকাণ্ডে রানী মান্দোদরী রাজা রাবণকে এই বলে তিরস্কার
করেছেন যে, রাবণের বীরত্বের দাবি সম্পূর্ণ ফাঁপা। কেননা তিনি রামচন্দ্রের
ছোট ভাই লক্ষ্মণের আঁকা ছোট একটি রেখা অতিক্রম করার সাহস পাননি। বস্তুত মূল
রামায়ণে লক্ষ্মণ-রেখার উল্লেখ না থাকলেও পরবর্তীকালের রামায়ণে অরণ্যকাণ্ডে
লক্ষ্মণ-রেখার প্রসঙ্গ গুরুত্ব সহকারে উলি্লখিত হয়েছে। লক্ষ্মণ-রেখার
উল্লেখ পরবর্তীকালে বহুবার বহুভাবে হয়েছে। কিছুদিন আগে ভারতের সুপ্রিম
কোর্ট গণমাধ্যমকে এই বলে সতর্ক করে দিয়েছেন যে, আদালতের সংবাদ প্রকাশ করতে
গিয়ে গণমাধ্যম যেন লক্ষ্মণ-রেখার কথা বিস্মৃত না হয়। বস্তুতপক্ষে, ভারতে
রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে প্রায়ই লক্ষ্মণ-রেখার কথা উলি্লখিত হয়। আধুনিক রাষ্ট্রে
সরকার, সেনাবাহিনী, গণমাধ্যম, আদালত, সংসদ, আমলাতন্ত্রসহ সকলেরই নিজ নিজ
এলাকা ও এখতিয়ার থাকে। এই চৌহদ্দি কোনো কারণে কেউ লঙ্ঘন করলে রাষ্ট্রীয়
আধুনিক রাষ্ট্রের সমতার নীতিতে ব্যত্যয় ঘটে। রাষ্ট্রের কোনো একটি অঙ্গ
নিজের অতিরিক্ত শক্তি প্রকাশে প্রলুব্ধ হয়ে সফল হলে তাতে রাষ্ট্রের
দুর্বলতা প্রকাশিত হয়। ফলে রাষ্ট্রের ব্যাপারে সীমা ও সীমা লঙ্ঘনের কথা মনে
করিয়ে দিতে লক্ষ্মণ-রেখার উল্লেখ ভারতে হরহামেশা দেখতে পাওয়া যায়। আমাদের
দেশে রামায়ণ কাব্য হিসেবে জনপ্রিয় হলেও এই মহাকাব্যে খুঁটিনাটি বিষয়গুলো
ততটা পরিচিত নয়। তাই এখানে প্রাসঙ্গিক হলেও লক্ষ্মণ-রেখার উল্লেখ সেভাবে
দেখতে পাওয়া যায় না। রামায়ণে রাবণ যখন সীতাকে অপহরণের পরিকল্পনা আঁটেন, তখন
তিনি রাক্ষস মারিচের সহায়তা কামনা করেন। মারিচ স্বর্ণমৃগের রূপ ধরেন।
স্বর্ণমৃগ সীতার সামনে উপস্থিত হয়ে তাকে প্রলুব্ধ করে। সীতা রামচন্দ্রকে
বলেন, তাকে ওই স্বর্ণহরিণ এনে দিতে হবে। রামচন্দ্র বুঝতে পারেন ওটি মায়ামৃগ
এবং অশুভ সংকেত। তারপরও সীতার অনুরোধে তাকে ওই মায়ামৃগ অর্থাৎ মারিচের
পশ্চাদ্ধাবন করতে হয়। হরিণের পিছু ধাওয়া করে যাওয়ার বহু পরেও যখন রামচন্দ্র
ফিরছিলেন না তখন সীতা লক্ষ্মণকে বলেন, তিনি যেন ভাইয়ের খোঁজে বের হন।
কিন্তু সীতার নিরাপত্তার দায়িত্ব লক্ষ্মণের। তিনি কীভাবে তাকে অরক্ষিত রেখে
ভাইকে খুঁজতে যাবেন? সীতার নিরাপত্তার জন্য লক্ষ্মণ গৃহের চারদিকে একটি
রেখা অঙ্কন করলেন। এই রেখা অতিক্রম করার চেষ্টা করলে যে কেউ আগুনে ভস্মীভূত
হবে। লক্ষ্মণ-রেখার নিরাপত্তায় সীতাকে রেখে লক্ষ্মণ ভাইয়ের খোঁজে বের
হলেন। লক্ষ্মণ চলে যাওয়ার পর ভিখারির বেশে রাক্ষসরাজ রাবণ সেখানে উপস্থিত
হলেন এবং সীতার কাছে ভিক্ষা প্রার্থনা করলেন। ভারতীয় ঐতিহ্যে অতিথি দেব
ভবাঃ। অর্থাৎ অতিথি ঈশ্বরের প্রতিনিধি। ফলে তাকে অগ্রাহ্য করা কঠিন।
পুরাণকাররা বলেন, সীতা তখন অন্যমনস্ক ও উদ্বিগ্নও ছিলেন। ফলে লক্ষ্মণের
নিষেধ বিস্মৃত হয়ে তিনি রেখাটি অতিক্রম করে ফেলেন। সীতা রেখার নিরাপত্তা
বেষ্টনী অতিক্রম না করে ভিক্ষা দিতে গেলে রাবণ তাকে বলেন, বেষ্টনীর ভেতরে
থেকে ভিক্ষা দিলে দাতা সানন্দে ভিক্ষা দিচ্ছেন কি-না তা স্পষ্ট হয় না। এ
কারণেও সীতা লক্ষ্মণ-রেখা অতিক্রম করে তাকে ভিক্ষা দিতে যান। সীতা
লক্ষ্মণ-রেখা অতিক্রম করিবামাত্র রাবণ তাকে অপহরণ করেন। পুষ্পকরথে করে
লঙ্কা নগরীতে নিয়ে অন্তরীণ করেন। সীতা অপহরণের পর রামচন্দ্রের লঙ্কা অভিযান
শুরু হয়।
No comments:
Post a Comment