সাকুল্যে যে দুটি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রত্যক্ষ সীমান্ত তার একটি ভারত
অন্যটি মিয়ানমার। যোগাযোগের নানা মাত্রার কারণে প্রতিবেশী হিসেবে ভারতের
অস্তিত্ব প্রতিনিয়তই আমরা টের পাই কিন্তু মিয়ানমার যেন সীমান্তে থেকেও
বহুদূর। অথচ, ঐতিহাসিকভাবে মিয়ানমার অর্থাৎ বার্মার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক
অনেক গভীর। বাংলার কবিরা একদা আরাকান রাজসভার সমর্থন নিয়ে সাহিত্যচর্চা
করতেন। বহুকাল বাঙালি অভিবাসীরা বার্মাকে বসবাসের জন্য পছন্দ করেছে।
সীমান্তে দুই দেশের সম্পর্ক কখনও অম্ল কখনও মধুর। মিয়ানমারের শাসকদের চাপে
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ এখন বাংলাদেশে আশ্রিত। আছে নানা রকমের
অনুমোদিত ও অননুমোদিত বাণিজ্য সম্পর্কও। এত নিকটবর্তী যে প্রতিবেশী তার
সম্পর্কে খোঁজ পেতে আমাদের নির্ভর করতে হয় পাশ্চাত্যের সংবাদমাধ্যমের ওপর।
বলতে গেলে ভৌগোলিক দূরত্ব কম হলেও মানসিক দূরত্ব যেন কয়েক হাজার
কিলোমিটার। অবশ্য এর জন্য মিয়ানমার কম দায়ী নয়। দীর্ঘদিন রুদ্ধশ্বাস সামরিক
শাসনাধীন মিয়ানমার প্রতিবেশীদের সঙ্গে রহস্যময় সম্পর্কে আবদ্ধ ছিল। বলা
হয়ে থাকে, বাংলাদেশের সরকারগুলো মিয়ানমারের সামরিক শাসনের প্রতি
মোটামুটিভাবে সহানুভূতিশীল ছিল। তবে দুই দেশের জনগণের মধ্যে প্রকৃত সম্পর্ক
কী তা বলা মুশকিল। বাংলাদেশেও বহু মানুষ মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্কিত। এ
দেশে অং সান সু চির বিপুল জনপ্রিয়তা। অবশ্য এ জনপ্রিয়তা প্রতিবেশী দেশের
গণতান্ত্রিক নেত্রীর জন্য নাকি পাশ্চাত্যের পছন্দনীয় আইকনের প্রতি তা বলা
মুশকিল। কাছে থেকে দূরের এ দেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অতীতে যা-ই থাকুক,
ভবিষ্যতে প্রতিবেশী হিসেবে সে দেশ যে এশিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে
তা ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। মিয়ানমার সম্প্রতি তার দেশের দরজা খুলেছে। সে
দেশের প্রেসিডেন্ট থান শোয়ে দরজা দিয়ে বেরিয়ে নানা দেশে যাচ্ছেন যেমন,
তেমনি নানা দেশের রাষ্ট্রনেতারা সে দেশে প্রবেশও করছেন। আগে নানা রকম
নিষেধাজ্ঞা ছিল। অং সান সু চির মুক্তির পর ধীরে ধীরে নিষেধাজ্ঞা উঠতে শুরু
করেছে। নানা রকমের বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপিত হচ্ছে, বিনিয়োগের নতুন সম্ভাবনা
তৈরি হচ্ছে। বস্তুত, মিয়ানমারের দিকে দৃষ্টি এখন সবার। আগে কোনো কোনো দেশ
গোপনে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক রাখত। সু চির মুক্তির পর আড়ালের দরকার পড়ছে
না। এখন মিয়ানমারকে দেখে অনেকেই অবাক হচ্ছেন। যতটা খারাপ ভাবা গিয়েছিল
ততটা খারাপ নয় মিয়ানমারের অবস্থা। বরং দক্ষিণ-দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় একটি বড়
শক্তি হয়ে ওঠার যথেষ্ট সম্ভাবনা দেশটির আছে। থান শোয়ে বড় ধরনের পরিবর্তন
এনেছেন। গণতন্ত্রের যাত্রা অব্যাহত থাকলে সু চির নেতৃত্বে দেশটি যে
আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক পর্যায়ে বড় গুরুত্ব পাবে সন্দেহ নেই। চীনের সঙ্গে
মিয়ানমারের সম্পর্ক আগে থেকেই উষ্ণ। সু চি মুক্তির পর প্রথম থাইল্যান্ড
গেলেন। থাইল্যান্ডে যাওয়ার আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ব্যবসায়ীদের বিশাল বহর
নিয়ে গিয়ে একগুচ্ছ চুক্তি করলেন মিয়ানমারের সঙ্গে। সু চিকে আমন্ত্রণ
জানালেন। চীন, ভারত, থাইল্যান্ড বাদ দিলে মিয়ানমারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ
প্রতিবেশী বাংলাদেশ। মিয়ানমারে যখন পরিবর্তনের হাওয়া, তাকে কেন্দ্র করে যখন
নানামুখী তোড়জোড় তখন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ কোথায়? বাংলাদেশের
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ডিসেম্বরে মিয়ানমার সফর করেছেন। কিন্তু
বাণিজ্য, বিনিয়োগসহ দ্বিপক্ষীয় বিষয়গুলো নিয়ে আলাপ-আলোচনা ও চুক্তি বেশি
আগায়নি। অং সান সু চি যদি বাংলাদেশে আসেন, তাকে সাদরে বরণ করে নেবে
বাংলাদেশের জনগণ। যাওয়া-আসায় কার্পণ্য চলবে না। মিয়ানমারের সঙ্গে পুরনো,
জটিল ও রহস্যময় সম্পর্কের ইতি টানতেই হবে। দুই দেশের বিবাদগুলো মিটিয়ে ফেলে
সামনে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগে আমরা যদি পিছিয়ে পড়তেই থাকি তবে সম্পর্কটা শেষ
পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?
No comments:
Post a Comment