Thursday, June 14, 2012

আতিশয্য

আমরা কিছু ব্যাপারে বাড়াবাড়ি পছন্দ না করলেও অনেক কিছুতে আতিশয্য বেশ পছন্দ করি। উদাহরণ হিসেবে আসে শ্রদ্ধা নিবেদনের প্রসঙ্গ। পৃথিবীব্যাপী শ্রদ্ধা নিবেদনের একটা নিজস্ব ভাষা আছে। শহীদদের স্মরণের জন্য শহীদ মিনার বা স্মৃতিস্তম্ভে গিয়ে ফুল বা মোমবাতি দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদনের রেওয়াজ সর্বত্রই প্রচলিত। নানা দেশের আচার দেখে সে সম্পর্কে কিছু ধারণা করা চলে। টেলিভিশনে দেখি, লোকে একটা ফুল বড়জোর এক গোছা ফুল হাতে করে স্মৃতিস্তম্ভে হাজির হয়। ফুলটুকু রেখে নীরবে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে ফিরে আসেন। আমাদের দেশেও শ্রদ্ধা নিবেদনের রীতি আছে। শহীদ মিনার ও স্মৃতিসৌধে আমরাও যাই। তবে এই যাওয়ার মধ্যে ব্যক্তিগত কোনো 'যাত্রা' আছে কি-না সন্দেহ। শুধু রাজনৈতিক দলগুলোকে দোষ দিয়ে লাভ নেই_ হরেদরে আমরা সবাই মিছিল করে দলবল নিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে যাই। একটি-দুটি ফুলে আমাদের প্রাণের নিবেদন সম্পূর্ণ হয় না। পারলে যেন বাগান উপড়ে নিয়ে যাই। বড় একটা ফুলের তোড়ায় সংগঠনের নাম লিখে হুড়োহুড়ি করে সেটি বেদিতে স্থাপন করতে গিয়ে রীতিমতো যুদ্ধ লেগে যায়। শ্রদ্ধা নিবেদনের চাইতে ছবি তোলাটাই তখন মুখ্য উদ্দেশ্য। টিভিতে সরাসরি সম্প্রচারের সুবাদে দেখেছি, ফুল দেওয়ার হুড়োহুড়ির মধ্যে নিরুপায় হয়ে কেউ কেউ বেদিতে ফুল ছুড়ে মারছেন। শুধু যে জাতীয় অনুষ্ঠানগুলোতে এমন হয় তা নয়। বিশিষ্ট কেউ মারা গেলে মরদেহ যখন শহীদ মিনারে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন শ্রদ্ধা নিবেদনের ওই একই রীতির অনুবর্তন ঘটে। বাঁধাই করা বড় তোড়া কফিনের ওপর না দিলে ঠিক যেন শ্রদ্ধা নিবেদন সম্পূর্ণ হয় না। একটি-দুটি ফুল কারও হাতে থাকলে হয়তো তাকে দীনহীন মনে করা হয়। অ্যাপলের কর্ণধার স্টিভ জবস মারা যাওয়ার পর দেখেছিলাম ভক্তরা একটি-দুটি ফুল স্টিভ জবসের ছবির সামনে রেখে দিয়েছেন। কেউবা অ্যাপলের কোনো গেজেট রেখে সম্মান দেখিয়েছেন। শ্রদ্ধ নিবেদনের জন্য মরদেহটাই সামনে রাখার খুব দরকার কারও পড়েনি। কিন্তু আমাদের এখানে মরদেহ উপস্থিত থাকবেই। আর তাতে মিছিল করে ফুলের বড় তোড়া দেওয়াটাই রেওয়াজ। এতে করে ফুল ব্যবসায়ীদের লাভ হয় বটে, কিন্তু অন্তরের শ্রদ্ধা কি যথার্থরূপে প্রকাশিত হয়? এ তো গেল ফুলের কথা। ভাষার কথা তুললে আরও নানা আতিশয্য চোখে পড়বে। বিশেষণ ছাড়া আমাদের অন্তরের শ্রদ্ধা ঠিক প্রকাশিত হয় না। তাও একটি-দুটি বিশেষণে কাজ চলে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশেষণের বন্যা বইয়ে দেওয়াই রেওয়াজ। বড় নেতা-নেত্রীদের ক্ষেত্রে বিশেষণেরও আবার প্রকারভেদ এমনকি দলও আছে। একজনকে এক বিশেষণে অভিহিত করলে অন্যজনকে ভিন্ন বিশেষণে অভিহিত করতে হবে। পাতিনেতাদের ক্ষেত্রেও বিশেষণের কমতি নেই। তাদের অনুসারীরাও বিশেষণ ঠিকই বের করে নেন। বিশেষণের এমনই আবশ্যকতা যে, কেউ যদি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামের আগে কবিগুরু বা বিশ্বকবি না লেখেন তবে ভাবা হতে পারে যে, তাকে অসম্মান করা হলো। অন্য বড় ব্যক্তির বেলাতেও একই অবস্থা। কেউ মারা গেলে, তিনি অবশ্যই বিশিষ্ট। লেখক হলে বিশিষ্ট লেখক, উকিল হলে বিশিষ্ট উকিল। বলা হয়ে থাকে, যার তেমন কোনো পরিচয় স্পষ্ট নয় তার জন্য বরাদ্দ বিশিষ্ট সমাজসেবক। আগে মৃত্যু সংবাদে সম্ভ্রান্ত বংশের কথা হরদম লেখা হতো। ইদানীং বংশের প্রকোপ কিছুটা কমেছে। কিন্তু একদিকে কমলে অন্যদিকে আতিশয্য বাড়তেই থাকে। সংকটটা কোথায় সেটি নিয়ে ভাবা যেতে পারে। হয়তো পরিমিতি বোধের অভাব আমাদের আছে। অথবা হয়তো কোনো ক্ষেত্রে সেটি রপ্তই হয়নি। নয়তো, এটাই আমাদের সংস্কৃতি। আমরা যখন কাউকে সম্মান করি তখন তাকে বিশিষ্ট বানিয়েই সম্মান করি। আর যখন কাউকে অসম্মান করতে হয় তখন তাকে তার আসন থেকে নামিয়ে গালি না দিয়ে হালকা কথার যুক্তিতে অপমান করতেও পারি না।

No comments:

Post a Comment