Thursday, June 7, 2012

ডায়মন্ড জুবিলি

ব্রিটেনের রানীর সিংহাসনে আরোহণের ষাট বছর পূর্তিতে রীতিমতো এক বিশাল উৎসব হয়ে গেল ব্রিটেনে। একদা যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যেত না, সে সাম্রাজ্যের অংশ ছিল বাংলাদেশও। আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে সে সাম্রাজ্যের হাত থেকে মুক্তি অর্জন করেছে এ অঞ্চলের মানুষ। কিন্তু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বহু চিহ্ন এখনও রয়ে গেছে এখানে। আমাদের আইন-আদালত, রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায় যেমন; সংস্কৃতি-শিক্ষা-স্থাপত্য-যোগাযোগেও তেমন। যত দূরেই ভাবি না কেন, সাম্রাজ্যের স্মৃতিচিহ্নগুলো ক্ষণে ক্ষণে এসে তাদের অস্তিত্ব জাহির করে। সাম্রাজ্যের তিক্ত স্মৃতি আওড়ে মুখে বিপ্লবী বুলি কপচে আমরা সাম্রাজ্যের সব দাগ দূর করতে চাই বটে, কিন্তু বাস্তবে তেমন উদ্যোগ দেখা যায় না। তবু কালের ধুলায় অনেক কিছুর মতো সাম্রাজ্যের স্মৃতিতেও ধুলা পড়েছে। যদি এ সবকিছু বাদ দিয়ে আমাদের মানস গঠনের কথা মনে রেখে সাম্রাজ্যের দিকে তাকাই, তবে ব্রিটিশ রাজা-রানীরাই আমাদের দেখা শেষ রাজা-রানী। সে রাজা-রানীদের প্রতি একটি সহজাত বিস্ময়-শ্রদ্ধা-ভয়-ভক্তি থাকাটাই স্বাভাবিক। যদি সেটুকুও না থাকে, তবে একেবারে সর্বসাম্প্রতিক রাজনীতির কথাই তোলা যাক। আন্তর্জাতিক ক্ষমতাবিন্যাসে যুক্তরাজ্যের অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের ঠিক পরেই। আমাদের নীতিনির্ধারণে তাদের প্রত্যক্ষ হোক, কি পরোক্ষ_ একটা ভূমিকা আছেই। সে কারণে এসব দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের আমরা শ্রদ্ধা-ভক্তি করি। ব্রিটেনের রানী হিসেবে দ্বিতীয় এলিজাবেথ শ্রদ্ধা-ভক্তি পান। বস্তুত তার ক্ষেত্রে পুরনো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের স্মৃতি, কমনওয়েলথ বর্তমানের ব্রিটেন সব মিলেমিশে একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। শুধু রানী কেন, পুরো রাজপরিবারের প্রতিই একটা আকর্ষণ চারদিকে খেয়াল করি। এ দেশে ব্রিটিশ রাজপরিবারের বিদ্রোহী বধূ প্রিন্সেস ডায়ানা কেমন জনপ্রিয় ছিলেন, তা মনে করা যেতে পারে। এই সেদিন ডায়ানার ছেলে উইলিয়ামের বিয়েতে বাংলাদেশে কেমন আগ্রহ তৈরি হয়েছিল, সেও মনে পড়ে। তুলনায় রানী এলিজাবেথের সিংহাসনে আরোহণের ষাট বছর কিন্তু একটু নীরবেই চলে গেল। ব্রিটেনে বসবাসরত বাঙালিরা ঠিকই ফুর্তি করেছেন; ব্রিটিশদের সঙ্গে আনন্দ-উৎসবে মেতেছেন। ঢাকায়ও উৎসবের ছিটেফোঁটা লাগেনি, তা নয়। কিন্তু টেলিভিশনের সামনে বসে বিয়ে দেখার রুদ্ধশ্বাস আয়োজনের সঙ্গে এর তুলনা চলে না। উইলিয়াম আর কেটের বিয়ের সময় অনেকেই মন্তব্য করেছিলেন, রূপকথা শুনতে যে কারণে আমরা ভালোবাসি, সে কারণেই ব্রিটিশরা রাজা-রানীর এই ঐতিহ্য সযত্নে টিকিয়ে রেখেছে। শুধু যে টিকিয়ে রেখেছে, তা নয়। এদের নিয়ে রীতিমতো সুখেই আছে তারা। দেশে চলছে দারুণ গণতন্ত্র। আধুনিক জীবনযাপন পদ্ধতি। কিন্তু ঐতিহ্যটাও দিব্যি রেখে দেওয়া হয়েছে। মাথায় তুলে রাখা হয়েছে জীবন্ত জাদুঘর। রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক প্রধানের পদ তো দরকার। রানীতে খারাপ কী? রানী এখনও 'নাইট' উপাধি দিচ্ছেন। কমনওয়েলথে অনেক উদ্যোগ বাস্তবায়িত হচ্ছে। এমন অনেক কিছুই হচ্ছে গণতান্ত্রিক সরকারের তরফে, কিন্তু নাম ফলছে রানীর। তবে ব্রিটেনে রানীর একটা ধর্মীয় ভূমিকাও আছে। ইউরোপীয় গণতান্ত্রিক দেশগুলো নিজেদের ধর্মীয় পরিচয় লুকিয়ে রাখতে বেশ পারদর্শী। কিন্তু তাদের উৎসব আয়োজন খেয়াল করলে বোঝা যায়, ধর্মের একটা সম্মোহন আছে সেখানে। আনুষ্ঠানিক ধর্মে রানীর উচ্চ স্থান আছে। তবে ধর্মীয় কারণেই যে তারা উৎসবে মাতে_ সে দোষ তাদের দেওয়া যাবে না। ভিড়ের অনেক মুখ আছে, যারা স্রেফ উৎসবের জন্যই উৎসবে মেতেছে_ স্পষ্ট বোঝা যায়। আবার অনেকেই সাম্রাজ্যের স্মৃতিলিপ্ত। তাদের চোখেমুখে রানী ও রাজতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তি ও ভালোবাসা। আর ইতিহাস তো মানুষকে বিস্মিত করে। ইতিহাস যদি সামনে এসে দাঁড়ায় তবে হতচকিত না হয়ে উপায় কী? তাই ইতিহাসের রাজা-রানী ও রাজকন্যা-রাজপুত্ররা বর্তমান পর্যন্ত টিকে থাকলে তো অসুবিধা কোথায়?

No comments:

Post a Comment