শীত বাংলাদেশে উৎসবের ঋতু। আগে উৎসব ছিল প্রধানত গ্রামকেন্দ্রিক। এখন
গ্রামের মেলা, পুতুল নাচ, যাত্রার শীতকালীন আয়োজনগুলোয় ভাটা পড়েছে। গ্রামের
মানুষ যেমন জীবন ধারণের প্রয়োজনে শহরে স্থানান্তরিত হয়েছে, তেমনি গ্রামের
উৎসবগুলোও রূপ ও রঙ পরিবর্তন করে শহরে এসেছে। যেমন পহেলা বৈশাখের ক্ষেত্রে
সত্যি, তেমনি সত্যি বাণিজ্যমেলা ও বইমেলার ক্ষেত্রেও। বছরের শুরুতে
বাণিজ্যমেলা রাজধানীবাসীর জন্য রীতিমতো উৎসবের আমেজ নিয়ে আসে। কেনাকাটার
ধুম পড়ে যায়। রাজধানীর বাইরে থেকেও অনেকে বাণিজ্যমেলাকে উপলক্ষ করে ঢাকায়
আসেন। বাণিজ্যমেলা শেষ হতে না হতেই আসে বইমেলা। ফেব্রুয়ারির এই অমর একুশে
বইমেলাই এদেশে একমাত্র বইকেন্দ্রিক বড় উৎসব। পাশ্চাত্যের দেশগুলোয় বই নিয়ে
আয়োজন প্রতিদিন লেগে থাকে। সেখানকার অধিবাসীরা চলার পথে, অবসরে, ছুটিতে
বইয়ের সঙ্গ পছন্দ করেন। প্রযুক্তির বিপুল বিকাশের মধ্যেও সেখানে বই পড়ার
সংস্কৃতি ফিকে হয়ে যায়নি। আধুনিক প্রযুক্তি নিয়ে আমরা মাঝে মাঝে হা-হুতাশ
প্রকাশ করি, কিন্তু বই পড়া নিয়ে আমাদের প্রকৃত দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করি না।
আমাদের দেশে কেউ চলতি পথে পড়বে বলে বই বহন করছে এমন দৃশ্য দেখা যায় না কেন,
সে প্রশ্ন কি আমরা করি? পাশ্চাত্যে হয়তো বই পড়ার সংস্কৃতিতে ভাটা পড়েছে,
কিন্তু আমাদের দেশে সে সংস্কৃতি কখনও গড়েই ওঠেনি। ইতিহাসে এমন কোনো
স্বর্ণযুগের উল্লেখ পাওয়া যায় না যখন আমাদের দেশে সাধারণের মধ্যে জ্ঞান ও
বিদ্যাচর্চার প্রাচুর্য দেখা দিয়েছিল। আধুনিক যুগেও এমন কোনো নজির নেই।
এদেশে এখনও জনসংখ্যার অর্ধেকই সাক্ষরতার বাইরে। যারা সাক্ষর, তাদের অনেকেই
পড়ার অভ্যাসের মধ্যে নেই। যে ছোট অংশটি উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত, তাদের কতজন
বিদ্যাচর্চার সঙ্গে জড়িত সে প্রশ্নও মাঝে মাঝে ওঠে। শিক্ষিত লোকেরা যদি
পড়াশোনা ও জ্ঞানচর্চার সঙ্গে সম্পর্ক না রাখেন তাহলে সম্পর্ক রাখবেন কে?
বইয়ের সঙ্গে শোচনীয় এই সম্পর্কের কারণে বই নিয়ে আমাদের প্রায় একমাত্র
আয়োজনে পরিণত হয়েছে ফেব্রুয়ারির বইমেলা। এ মেলার সঙ্গে বিপণনের সম্পর্ক
রয়েছে। বই প্রকাশের সম্পর্ক রয়েছে। রয়েছে ভাষা নিয়ে আমাদের জাতিগত আবেগের
সম্পর্কও। কিন্তু সেই আবেগ কি আমাদের জ্ঞানগত উত্থানে প্রেরণা জোগাতে
পেরেছে? ফেব্রুয়ারি মাস গেলে বই বিক্রি কতটা হয় সে খবর কি রাখার অবকাশ আছে
আমাদের? ফেব্রুয়ারি গেলে লেখক-প্রকাশকরা কী করেন সে খবরই বা কে রাখে।
পাশ্চাত্যের পত্রপত্রিকাগুলোয় প্রতিদিনই বই নিয়ে কোনো না কোনো আয়োজনের খবর
থাকে। ইলেকট্রনিক মিডিয়া লেখক ও বইকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে অনুষ্ঠান প্রচার
করে। কিন্তু আমরা শুধু ফেব্রুয়ারিতেই সেটা করি। এটি বলে দেয়_ ফেব্রুয়ারি
নিয়ে আমাদের আন্তরিক চেষ্টা সত্ত্বেও এটি একটি মৌসুমি আয়োজন। আমাদের সারা
বছরের চিন্তাচর্চার সঙ্গে এর সম্পর্ক সামান্যই। শীতকাল উৎসবের মৌসুম বলেই
হয়তো বইমেলা জমজমাট হয়। কিন্তু এ মেলা কি পাঠকের সঙ্গে বইয়ের সম্পর্ক তৈরি
করতে যথেষ্ট অবদান রাখতে পারছে? প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা জরুরি। আর জরুরি
বই নিয়ে আমাদের অনীহা দূর করা। অগ্রগতির জন্য যে প্রজ্ঞা দরকার তা বই থেকেই
আসতে পারে, সেটি যেন আমরা ভুলে না যাই।
No comments:
Post a Comment