অগ্রজ এক কবি অনুজ কবির কবিতার আলোচনায় লিখছেন_ কবিতায় ছন্দের প্রখরতা আছে,
উপমা ও শব্দ প্রয়োগে নতুনত্বও আছে কিন্তু 'দাহ' নাই। আলোচনাটি পড়তে পড়তে
দাহ শব্দটায় এসে থমকে দাঁড়াতে হলো। দাহ বলতে কবি কী বলেছেন বুঝতে চাইলাম।
সাহিত্যে অনেক কথাই আকারে-ইঙ্গিতে, আরেঠারে হয়। সাধারণ কথার মধ্যেও থাকে
দ্ব্যর্থকতা। খুব সিরিয়াস ভঙ্গির বর্ণনার মধ্য দিয়ে কেউ হয়তো পরিহাসই করতে
চাইছেন, কিংবা দেখা যায় পরিহাস করতে করতে পাঠককে কাঁদিয়ে চলেছেন ক্রমাগত।
যেমন একজন লেখক একটি উপন্যাসের আলোচনা করতে গিয়ে লিখলেন_ আখ্যান অত্যন্ত
শক্তিশালী, চরিত্র চিত্রণ ভালো, কাহিনীর পরম্পরাও সঠিকভাবে অনুসৃত হয়েছে
কিন্তু কাব্যগুণে কমতি আছে। পড়ে কেউ বাঁকা প্রশ্ন করতেই পারেন_ উপন্যাসে
কাব্যগুণ থাকবে কেন? কাব্যগুণ প্রসঙ্গে একজন অভিজ্ঞ সাহিত্যিককে বলতে
শুনেছি, সাহিত্যের যে কোনো আঙ্গিকই কাব্য। এটা নাকি অনেকটা তরকারির লবণের
মতো। রান্না যত ভালো হোক, যত পুষ্টিকর হোক, পরিবেশন যত সুন্দর হোক না কেন
লবণের মাত্রা ঠিক না থাকলে চূড়ান্ত বিচারে রান্নাকে ভালো বলা যায় না।
সাহিত্যেও তেমনি লাবণ্য_ অর্থাৎ কাব্যগুণ।
লবণ বা লাবণ্যের মতো কি কোনো আবশ্যিক ব্যাপার দাহ বা দহন? দহন যদি না থাকে তবে কি কবিতা অপূর্ণ থেকে যায়? হয়তো তা-ই। কবিতায় দাহ থাকে যখন সমাজ-সংসারের আগুন কবিকে স্পর্শ করে। কবি দগ্ধ হন বলেই কবিতায় দাহ প্রকাশিত হয়। সবচেয়ে প্রখর অনুভূতি-সম্পন্ন বলে কবিদের দগ্ধ হতেই হয়। অথচ বিদগ্ধদের তালিকায় কবিদের নাম সবসময় পেছনের সারিতে। কথায় কথায় আমরা বিদগ্ধ শব্দটা ব্যবহার করি। কালে কালে শব্দটা এমন অর্থ পেয়েছে যে, কবিকে নয়_বরং প্রাবন্ধিককে বিদগ্ধ বলার রেওয়াজ চালু হয়ে গেছে। বলা যায়, বিদগ্ধ শব্দটাই যথেষ্ট দগ্ধ নেই আর। ফলে, বিদগ্ধ হওয়া দূরের কথা, প্রাবন্ধিক কখনো দগ্ধ হন কি-না তা নিয়েও সংশয় আছে। কিন্তু তাকে বিদগ্ধ বলাই রেওয়াজ। কিন্তু প্রকৃত অর্থে যদি দগ্ধ বা বিদগ্ধ কোনো মানবগোষ্ঠীর উল্লেখ করা হয় তবে তাতে কবিদের রাখতেই হবে। ফলে, কবি যখন বলেন, কবিতায় তিনি দাহ ব্যাপারটি খুঁজে পাচ্ছেন না তখন বুঝতে হবে আবশ্যিক উপাদানেরই কমতি পড়েছে। তবে, 'দাহ' কবিতায় একটা অনুভূতি মাত্র নাকি অনিবার্য গন্তব্য সেটি ভিন্ন তর্ক।
আমাদের এক কবি পরবর্তী প্রজন্মের আরেক কবির কবিতায় আবিষ্কার করেছিলেন তাকিয়ে দেখার আনন্দ। বস্তুবিশ্বের দিকে তাকিয়ে থেকে কি আনন্দ লাভ সম্ভব_ যদি বিস্ময়, আবিষ্কার, ভালোবাসা এমনকি ঘৃণাও না থাকে? কবির চোখের সামনে যদি ক্রমাগত অনূদিত না হতে থাকে রহস্যের পৃষ্ঠাগুলো তবে কেবলই তাকিয়ে থেকে তিনি আনন্দ পেতে পারেন কিংবা সেই তাকিয়ে দেখার আনন্দ প্রকাশ করতে পারেন?
অনেকেই মনে করেন, কবিতার মূল শক্তি ভালোবাসা, ঘৃণা, বিস্ময় ও আবিষ্কার। জীবনের চিরচেনা দৃশ্যের গভীর থেকে অনির্ণেয়-অনির্দেশ্য আরেক সত্য আবিষ্কারের মধ্যেই কবিতার জন্ম। ফলে, কবিকে চেনা জগতের দিকেই বিস্ময় নিয়ে তাকাতে হয়। দেখা বস্তুকেই নতুন করে দেখতে হয়। জানা বস্তুকে নতুন করে জানতে হয়। স্থিতিশীল পৃথিবী অস্থিতিশীল হয়ে যায় তার ভাবনার জগতে। পায়ের নিচে ফুটপাথ বদল হয়ে যায়। যাকে ভালোবাসা যায় না তাকে ভালোবাসতে হয়, যাতে ঘৃণা করা যায় না তাকে ঘৃণা করে দেখতে হয়। বিদগ্ধ কবিমাত্রই চেনা জগতের মধ্যেই এমন আরেক জগতকে চিনিয়ে দেন। সকলে একদিন না একদিন স্বীকার করতে বাধ্য হয় যে তারা এ জগৎকে এভাবে আর কখনোই জানেননি, দেখেননি কিংবা আস্বাদন করেননি।
কবিতাকে পিঠ দেখিয়ে যদি আখ্যানের দিকে তাকাই তবে কী ঘটে? আখ্যানের জন্ম কোথায়, কীভাবে, কোন অনুভূতি থেকে? কেউ কেউ বলেন, আখ্যানের জন্ম স্বর্গে। মানুষের স্বর্গবিচ্যুৎ হওয়ার কিছু আগে। যখন আদি মানব ভাবছেন, শয়তানের প্ররোচনায় তিনি নিষিদ্ধ ফলটি খাবেন কি খাবেন না, তখনই তার চিন্তার সমান্তরালে একটি আখ্যানের জন্ম হয়েছে। এজন্যই অনেকে আখ্যানকেই 'দ্বিধা' বলে আখ্যায়িত করেন। বস্তুত, আদি মানবের অন্তরের সেই দ্বিধা শুধু স্বর্গ থেকে মানুষকে বিচ্যুৎ করলো না, জন্ম হলো আরও অনেক দ্বিধার। স্বর্গের বাইরে আরেক জগৎ সৃষ্টি হলো। ফলে, যদি প্রশ্ন ওঠে কথাসাহিত্যের আদিমতম অনুভূতির নাম কী? তবে অনেকেই সঠিকভাবে বলবেন 'দ্বিধা'। পরবর্তীকালে আমরা দেখবো, আখ্যানগুলো কাব্যের ওপর ভর দিয়ে এগিয়ে চলেছে কিন্তু দ্বিধান্বিত মানুষের সঙ্গে ঘন ঘন শয়তানের দেখা হচ্ছে। ভালো ও মন্দ, কল্যাণ ও অকল্যাণ, পাপ ও পুণ্যের মধ্যে তীব্র যুদ্ধ লেগেছে। অভিধানে আছে, দ্বিধা অর্থ_ দুই ধারা, দুই ভাগে, দুই রকমে বা রীতিতে। দ্বিধার পরেই যে শব্দটি বসে তার নাম বিভক্ত। দ্বিধা মানে দোটানা, সংশয়, সংকোচ, ইতস্তত ভাব। আদি মানবের দ্বিধাজনিত একটি সিদ্ধান্ত থেকে দুটি জগতের জন্ম হলো_ একটি স্বর্গ, আরেকটি পৃথিবী। পৃথিবীর দ্বিধাজনিত কর্মকাণ্ড থেকে এলো কৃতকর্মের প্রসঙ্গ। জন্ম হলো নরক। আমরা দেখবো, সাহিত্যে বারবার শয়তানের সঙ্গে দেখা হচ্ছে মানুষের। গ্যয়টের ফাউস্ট কাব্যে মহামতি ফাউস্টের সঙ্গে দেখা হচ্ছে মেফিস্টোফেলিসের। মেফিস্টোফেলিসের প্ররোচনায় আত্মবিক্রয়ে রাজি হয়ে যাচ্ছেন জ্ঞানী ফাউস্ট পর্যন্ত। ক্রিস্টোফার মার্লোর ডক্টর ফস্টাসের কাহিনীও অনুরূপ। এরপর আমরা দেখবো, হ্যামলেটের মধ্যে দ্বিধার তীব্র ও গভীর বসতি তৈরি হচ্ছে। প্রেতাত্মা মারফত হ্যামলেট জেনে যাচ্ছেন, তার পিতার হত্যাকারী আসলে তার চাচা ক্লদিয়াস। হত্যা পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত তার মা গারট্রুডও। এই সত্য জেনে হ্যামলেটের মধ্যে প্রবল হচ্ছে প্রতিশোধ বোধ। কিন্তু প্রতিশোধ কীভাবে নেবেন তিনি? আসলেই কি নেবেন? হ্যামলেট দ্বিধাগ্রস্ত। দ্বিধা তাকে ক্রমশ আত্মমুখী, নির্জন করে তুলছে।
লক্ষ্য করবো, দ্বিধার মতো মানবিক এক অনুভূতির প্রেক্ষাপট তৈরি করার জন্য আমাদের সেরা লেখকদের অনেকেই দারস্থ হয়েছেন শয়তান বা প্রেতাত্মা বা দুষ্ট লোকের। কেন? শয়তানের প্ররোচনা ছাড়া কি মানুষের মনে দ্বিধার জন্ম হতে পারত না? তখন বিশ্বাস ছিল, অপশক্তির প্ররোচনা ছাড়া দ্বিধার জন্ম হতে পারে না। কেননা দ্বিধা হলো মানুষের অসুখ। দ্বিধার বিপরীত অনুভূতির নাম একাগ্রতা। একান্তই স্বর্গীয় এ অনুভূতির বাইরে দাঁড়িয়ে যখন কেউ ভাবে সামনে দুটো পথের কোন দিকে যাবে তখন শয়তান ছাড়া আর কে তাকে প্ররোচনা জোগাবে? কার এত গরজ?
কথিত আছে মুক্তা হলো ঝিনুকের দুরারোগ্য ব্যাধি। রোগগ্রস্ত হলে ঝিনুকের মধ্যে মূল্যবান রত্ন_ মুক্তার উন্মেষ ঘটে। তেমনি দ্বিধা নামক অসুখ থেকে পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছে আখ্যান, কথাসাহিত্য। উপন্যাসের লেখকরা যেন হ্যামলেটের মতোই ভাগ্যবিড়ম্বিত ও দ্বিধান্বিত। সত্য জেনে কীভাবে তার প্রতিবিধান করবেন, ভাবছেন হ্যামলেট। কিন্তু লোকে ভাবছে, হ্যামলেটের আত্মমগ্নতা আসলে গভীর প্রেমের ফসল। অন্যদিকে, লেখককে কেউ প্ররোচনা দেয় না, কিন্তু লেখক তার অভিজ্ঞতা ও অন্তর্দৃষ্টিতে দগ্ধ হয়ে জেনে যান কী কেন কীভাবে। কার্য ও কারণ একই সঙ্গে। তিনি যখন রচনা করেন আখ্যান, তখন সেখানে সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে ন্যায়-অন্যায়, সত্য-অসত্য, কল্যাণ-অকল্যাণের মধ্যে যুদ্ধ বেধে যায়। কখনও কখনও মনে হয়, আখ্যানকার যেন বা অন্যায়ের প্রতিনিধি, কখনও বা ন্যায়ের। এই যে বিদ্যমান সত্য থেকে বিচ্ছিন্ন করে নতুনভাবে সত্য নির্মাণের প্রক্রিয়া_ এরই নাম উপন্যাস। উপন্যাস মাত্রই বিনির্মাণ। উপন্যাসিক ঘটনাবলিকে উপন্যাস্ত করেন। বিদ্যমান বিন্যাস বা ন্যাস থেকে ঘটনা ও চরিত্রাবলিকে অন্যত্র প্রতিস্থাপন করে নানা দিক থেকে দেখে তিনি ঘটনাবলিকে নতুন করে পরখ করেন। সত্যাসত্য পুনর্নির্ণয় করে। ফলে, কেউ যদি বলেন ঔপন্যাসিকের মূল হাতিয়ার ভাষা। তবে তিনি ঠিক বলছেন। কেউ যদি বলেন_ আখ্যান, চরিত্র, বর্ণনা, ঘটনাবলীর উত্থান-পতন তবে তাও সত্য। কিন্তু ঔপন্যাসিকের মূল অবলম্বন অবশ্যই দ্বিধা। আমরা শেক্সপিয়ারের নাটকগুলোর আখ্যানের দিকে খেয়াল করলে দেখব_ তিনি মুখ্যত মানব চরিত্রের দ্বিধা নিয়েই কাজ করেছেন। আধুনিকতম কোনো উপন্যাসের মূল সুরও যদি খেয়াল করতে চাই তবে দেখব সেখানেও এক অনিবার্যভাবে দ্বিধাই সক্রিয়। টু বি অর নট টু বি... প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আয়োজন চলছে সর্বত্র। ফলে, লেখককে কেউ যদি 'দ্বিধার কারবারি' বলেন তবে তাকে দোষ দেওয়া যাবে না। ক্ষেত্রবিশেষে এমনও খুঁজে পাওয়া যেতে পারে যে, লেখক নিজেই নিজেকে দ্বিধার কারবারি আখ্যা দিচ্ছেন। তবে অতি সাম্প্রতিক দ্বিধার সঙ্গে পূর্বতন দ্বিধার মৌলিক কিছু পার্থক্য আছে। আগের আখ্যানগুলোতে প্ররোচক বা অনুঘটকের কাজ করত ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী শয়তান। কখনও প্রেতাত্মা বা দুষ্ট লোকেও পাপটি জাগিয়ে তুলত। কিন্তু কালের বিবর্তনে আমরা দেখব, প্রেক্ষাপট থেকে শয়তান অন্তর্হিত হয়েছে। মানুষের মনে দ্বিধা আপনা-আপনি জাগছে। মানুষ নিজেই খুলতে পারছে নিজের সামনে দুটি পথ। কোনটি বেছে নিয়ে এগোবে সে সিদ্ধান্তও একান্তই তার।
বাংলা ভাষায় খুব সুন্দর একটি কথা আছে, দ্বিধান্বিত পরিস্থিতি বোঝাতে_ দুই নৌকায় পা। দুই নৌকায় পা দিলে নাকি দুর্ঘটনার সমূহ আশঙ্কা। কিন্তু যদি প্রশ্ন করা হয়, কার নেই দুই নৌকায় পা? তবে উত্তর মেলা ভার। কেননা, সকলেরই পা দুই নৌকায়। ইতি আর নেতির নৌকা তো আছেই। আছে বুদ্ধি ও আবেগের নৌকাও। কেউ কেউ বলেন, বুদ্ধি দিয়ে নয়, অন্তরাত্মার পরামর্শ মেনে চলো। কেউ বা বলেন, আবেগ দিয়ে নয় বুদ্ধি দিয়ে বিচার করো। এই পৃথিবীতেই আমরা দেখছি, হাজার হাজার মানুষ ভবিষ্যৎ চিন্তা না করে ট্যাঙ্কের সামনে নেমে পড়ছে খালি হাতে যুদ্ধ করতে। কিংবা দেখছি বছরের পর বছর সামরিক শাসনের জাঁতাকলে জর্জরিত হয়েও কেউ পথে নামছে না। কখন কীভাবে কেন নামবে সে হিসাব মিলছে না তাদের। আবেগে যে নেমে পড়ছে রাস্তায় তাকে ঠিক বলবো নাকি তাকে ঠিক বলব যে বুদ্ধি দিয়ে চলতে চলতে বসে পড়ছে রাস্তায়? মূল্যবোধ ও বাস্তবতার দুই নৌকাও তো আছে। মূল্যবোধ বলে এটা করো, বাস্তবতা বলে বিপদ হতে পারে। প্রবৃত্তি বলে, নাও। নীতি বলে নিও না। প্রয়োজন বলে চলো, আদর্শ বলে থামো। দ্বিধা মানুষের দুরারোগ্য এক ব্যাধি। জোসেফ ক্যাম্পবেল লিখেছিলেন, মানুষের কী করা উচিত তা জানতে হলে বাইবেল পড়ূন। আর মানুষ কী করছে তা জানতে হলে পড়ূন সংবাদপত্র। ধর্মগ্রন্থগুলো বলে, ধর্মপথে চললে সে পথের একাগ্রতাই মানুষকে নিয়ে যাবে সেই স্বর্গে, যেখান থেকে সে বিচ্যুৎ হয়েছিল দ্বিধার খেসারত দিতে গিয়ে। কিন্তু স্বর্গে ফিরে যাবার ইচ্ছা কি সত্যিই মানুষের আছে? দুই নৌকা থেকে পা উঠিয়ে একটি নৌকা বেছে নেবার সামর্থ্য অর্জন করতে পারবে কি মানুষ কখনও? দ্বিধাহীনতা মানুষকে মানবোত্তীর্ণ করে বটে, কিন্তু দ্বিধা ছাড়া মানুষ হয় না। সত্যি কথা বলতে, দ্বিধা না থাকলে পৃথিবীই হতো না। দ্বিধা আছে বলেই, আছে_ পৃথিবী, সভ্যতা, যুদ্ধ, গ্গ্নানি, নশ্বরতা, পাপ, কামনা, প্রবৃত্তি। আর আছে কথাসাহিত্য।
লবণ বা লাবণ্যের মতো কি কোনো আবশ্যিক ব্যাপার দাহ বা দহন? দহন যদি না থাকে তবে কি কবিতা অপূর্ণ থেকে যায়? হয়তো তা-ই। কবিতায় দাহ থাকে যখন সমাজ-সংসারের আগুন কবিকে স্পর্শ করে। কবি দগ্ধ হন বলেই কবিতায় দাহ প্রকাশিত হয়। সবচেয়ে প্রখর অনুভূতি-সম্পন্ন বলে কবিদের দগ্ধ হতেই হয়। অথচ বিদগ্ধদের তালিকায় কবিদের নাম সবসময় পেছনের সারিতে। কথায় কথায় আমরা বিদগ্ধ শব্দটা ব্যবহার করি। কালে কালে শব্দটা এমন অর্থ পেয়েছে যে, কবিকে নয়_বরং প্রাবন্ধিককে বিদগ্ধ বলার রেওয়াজ চালু হয়ে গেছে। বলা যায়, বিদগ্ধ শব্দটাই যথেষ্ট দগ্ধ নেই আর। ফলে, বিদগ্ধ হওয়া দূরের কথা, প্রাবন্ধিক কখনো দগ্ধ হন কি-না তা নিয়েও সংশয় আছে। কিন্তু তাকে বিদগ্ধ বলাই রেওয়াজ। কিন্তু প্রকৃত অর্থে যদি দগ্ধ বা বিদগ্ধ কোনো মানবগোষ্ঠীর উল্লেখ করা হয় তবে তাতে কবিদের রাখতেই হবে। ফলে, কবি যখন বলেন, কবিতায় তিনি দাহ ব্যাপারটি খুঁজে পাচ্ছেন না তখন বুঝতে হবে আবশ্যিক উপাদানেরই কমতি পড়েছে। তবে, 'দাহ' কবিতায় একটা অনুভূতি মাত্র নাকি অনিবার্য গন্তব্য সেটি ভিন্ন তর্ক।
আমাদের এক কবি পরবর্তী প্রজন্মের আরেক কবির কবিতায় আবিষ্কার করেছিলেন তাকিয়ে দেখার আনন্দ। বস্তুবিশ্বের দিকে তাকিয়ে থেকে কি আনন্দ লাভ সম্ভব_ যদি বিস্ময়, আবিষ্কার, ভালোবাসা এমনকি ঘৃণাও না থাকে? কবির চোখের সামনে যদি ক্রমাগত অনূদিত না হতে থাকে রহস্যের পৃষ্ঠাগুলো তবে কেবলই তাকিয়ে থেকে তিনি আনন্দ পেতে পারেন কিংবা সেই তাকিয়ে দেখার আনন্দ প্রকাশ করতে পারেন?
অনেকেই মনে করেন, কবিতার মূল শক্তি ভালোবাসা, ঘৃণা, বিস্ময় ও আবিষ্কার। জীবনের চিরচেনা দৃশ্যের গভীর থেকে অনির্ণেয়-অনির্দেশ্য আরেক সত্য আবিষ্কারের মধ্যেই কবিতার জন্ম। ফলে, কবিকে চেনা জগতের দিকেই বিস্ময় নিয়ে তাকাতে হয়। দেখা বস্তুকেই নতুন করে দেখতে হয়। জানা বস্তুকে নতুন করে জানতে হয়। স্থিতিশীল পৃথিবী অস্থিতিশীল হয়ে যায় তার ভাবনার জগতে। পায়ের নিচে ফুটপাথ বদল হয়ে যায়। যাকে ভালোবাসা যায় না তাকে ভালোবাসতে হয়, যাতে ঘৃণা করা যায় না তাকে ঘৃণা করে দেখতে হয়। বিদগ্ধ কবিমাত্রই চেনা জগতের মধ্যেই এমন আরেক জগতকে চিনিয়ে দেন। সকলে একদিন না একদিন স্বীকার করতে বাধ্য হয় যে তারা এ জগৎকে এভাবে আর কখনোই জানেননি, দেখেননি কিংবা আস্বাদন করেননি।
কবিতাকে পিঠ দেখিয়ে যদি আখ্যানের দিকে তাকাই তবে কী ঘটে? আখ্যানের জন্ম কোথায়, কীভাবে, কোন অনুভূতি থেকে? কেউ কেউ বলেন, আখ্যানের জন্ম স্বর্গে। মানুষের স্বর্গবিচ্যুৎ হওয়ার কিছু আগে। যখন আদি মানব ভাবছেন, শয়তানের প্ররোচনায় তিনি নিষিদ্ধ ফলটি খাবেন কি খাবেন না, তখনই তার চিন্তার সমান্তরালে একটি আখ্যানের জন্ম হয়েছে। এজন্যই অনেকে আখ্যানকেই 'দ্বিধা' বলে আখ্যায়িত করেন। বস্তুত, আদি মানবের অন্তরের সেই দ্বিধা শুধু স্বর্গ থেকে মানুষকে বিচ্যুৎ করলো না, জন্ম হলো আরও অনেক দ্বিধার। স্বর্গের বাইরে আরেক জগৎ সৃষ্টি হলো। ফলে, যদি প্রশ্ন ওঠে কথাসাহিত্যের আদিমতম অনুভূতির নাম কী? তবে অনেকেই সঠিকভাবে বলবেন 'দ্বিধা'। পরবর্তীকালে আমরা দেখবো, আখ্যানগুলো কাব্যের ওপর ভর দিয়ে এগিয়ে চলেছে কিন্তু দ্বিধান্বিত মানুষের সঙ্গে ঘন ঘন শয়তানের দেখা হচ্ছে। ভালো ও মন্দ, কল্যাণ ও অকল্যাণ, পাপ ও পুণ্যের মধ্যে তীব্র যুদ্ধ লেগেছে। অভিধানে আছে, দ্বিধা অর্থ_ দুই ধারা, দুই ভাগে, দুই রকমে বা রীতিতে। দ্বিধার পরেই যে শব্দটি বসে তার নাম বিভক্ত। দ্বিধা মানে দোটানা, সংশয়, সংকোচ, ইতস্তত ভাব। আদি মানবের দ্বিধাজনিত একটি সিদ্ধান্ত থেকে দুটি জগতের জন্ম হলো_ একটি স্বর্গ, আরেকটি পৃথিবী। পৃথিবীর দ্বিধাজনিত কর্মকাণ্ড থেকে এলো কৃতকর্মের প্রসঙ্গ। জন্ম হলো নরক। আমরা দেখবো, সাহিত্যে বারবার শয়তানের সঙ্গে দেখা হচ্ছে মানুষের। গ্যয়টের ফাউস্ট কাব্যে মহামতি ফাউস্টের সঙ্গে দেখা হচ্ছে মেফিস্টোফেলিসের। মেফিস্টোফেলিসের প্ররোচনায় আত্মবিক্রয়ে রাজি হয়ে যাচ্ছেন জ্ঞানী ফাউস্ট পর্যন্ত। ক্রিস্টোফার মার্লোর ডক্টর ফস্টাসের কাহিনীও অনুরূপ। এরপর আমরা দেখবো, হ্যামলেটের মধ্যে দ্বিধার তীব্র ও গভীর বসতি তৈরি হচ্ছে। প্রেতাত্মা মারফত হ্যামলেট জেনে যাচ্ছেন, তার পিতার হত্যাকারী আসলে তার চাচা ক্লদিয়াস। হত্যা পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত তার মা গারট্রুডও। এই সত্য জেনে হ্যামলেটের মধ্যে প্রবল হচ্ছে প্রতিশোধ বোধ। কিন্তু প্রতিশোধ কীভাবে নেবেন তিনি? আসলেই কি নেবেন? হ্যামলেট দ্বিধাগ্রস্ত। দ্বিধা তাকে ক্রমশ আত্মমুখী, নির্জন করে তুলছে।
লক্ষ্য করবো, দ্বিধার মতো মানবিক এক অনুভূতির প্রেক্ষাপট তৈরি করার জন্য আমাদের সেরা লেখকদের অনেকেই দারস্থ হয়েছেন শয়তান বা প্রেতাত্মা বা দুষ্ট লোকের। কেন? শয়তানের প্ররোচনা ছাড়া কি মানুষের মনে দ্বিধার জন্ম হতে পারত না? তখন বিশ্বাস ছিল, অপশক্তির প্ররোচনা ছাড়া দ্বিধার জন্ম হতে পারে না। কেননা দ্বিধা হলো মানুষের অসুখ। দ্বিধার বিপরীত অনুভূতির নাম একাগ্রতা। একান্তই স্বর্গীয় এ অনুভূতির বাইরে দাঁড়িয়ে যখন কেউ ভাবে সামনে দুটো পথের কোন দিকে যাবে তখন শয়তান ছাড়া আর কে তাকে প্ররোচনা জোগাবে? কার এত গরজ?
কথিত আছে মুক্তা হলো ঝিনুকের দুরারোগ্য ব্যাধি। রোগগ্রস্ত হলে ঝিনুকের মধ্যে মূল্যবান রত্ন_ মুক্তার উন্মেষ ঘটে। তেমনি দ্বিধা নামক অসুখ থেকে পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছে আখ্যান, কথাসাহিত্য। উপন্যাসের লেখকরা যেন হ্যামলেটের মতোই ভাগ্যবিড়ম্বিত ও দ্বিধান্বিত। সত্য জেনে কীভাবে তার প্রতিবিধান করবেন, ভাবছেন হ্যামলেট। কিন্তু লোকে ভাবছে, হ্যামলেটের আত্মমগ্নতা আসলে গভীর প্রেমের ফসল। অন্যদিকে, লেখককে কেউ প্ররোচনা দেয় না, কিন্তু লেখক তার অভিজ্ঞতা ও অন্তর্দৃষ্টিতে দগ্ধ হয়ে জেনে যান কী কেন কীভাবে। কার্য ও কারণ একই সঙ্গে। তিনি যখন রচনা করেন আখ্যান, তখন সেখানে সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে ন্যায়-অন্যায়, সত্য-অসত্য, কল্যাণ-অকল্যাণের মধ্যে যুদ্ধ বেধে যায়। কখনও কখনও মনে হয়, আখ্যানকার যেন বা অন্যায়ের প্রতিনিধি, কখনও বা ন্যায়ের। এই যে বিদ্যমান সত্য থেকে বিচ্ছিন্ন করে নতুনভাবে সত্য নির্মাণের প্রক্রিয়া_ এরই নাম উপন্যাস। উপন্যাস মাত্রই বিনির্মাণ। উপন্যাসিক ঘটনাবলিকে উপন্যাস্ত করেন। বিদ্যমান বিন্যাস বা ন্যাস থেকে ঘটনা ও চরিত্রাবলিকে অন্যত্র প্রতিস্থাপন করে নানা দিক থেকে দেখে তিনি ঘটনাবলিকে নতুন করে পরখ করেন। সত্যাসত্য পুনর্নির্ণয় করে। ফলে, কেউ যদি বলেন ঔপন্যাসিকের মূল হাতিয়ার ভাষা। তবে তিনি ঠিক বলছেন। কেউ যদি বলেন_ আখ্যান, চরিত্র, বর্ণনা, ঘটনাবলীর উত্থান-পতন তবে তাও সত্য। কিন্তু ঔপন্যাসিকের মূল অবলম্বন অবশ্যই দ্বিধা। আমরা শেক্সপিয়ারের নাটকগুলোর আখ্যানের দিকে খেয়াল করলে দেখব_ তিনি মুখ্যত মানব চরিত্রের দ্বিধা নিয়েই কাজ করেছেন। আধুনিকতম কোনো উপন্যাসের মূল সুরও যদি খেয়াল করতে চাই তবে দেখব সেখানেও এক অনিবার্যভাবে দ্বিধাই সক্রিয়। টু বি অর নট টু বি... প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আয়োজন চলছে সর্বত্র। ফলে, লেখককে কেউ যদি 'দ্বিধার কারবারি' বলেন তবে তাকে দোষ দেওয়া যাবে না। ক্ষেত্রবিশেষে এমনও খুঁজে পাওয়া যেতে পারে যে, লেখক নিজেই নিজেকে দ্বিধার কারবারি আখ্যা দিচ্ছেন। তবে অতি সাম্প্রতিক দ্বিধার সঙ্গে পূর্বতন দ্বিধার মৌলিক কিছু পার্থক্য আছে। আগের আখ্যানগুলোতে প্ররোচক বা অনুঘটকের কাজ করত ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী শয়তান। কখনও প্রেতাত্মা বা দুষ্ট লোকেও পাপটি জাগিয়ে তুলত। কিন্তু কালের বিবর্তনে আমরা দেখব, প্রেক্ষাপট থেকে শয়তান অন্তর্হিত হয়েছে। মানুষের মনে দ্বিধা আপনা-আপনি জাগছে। মানুষ নিজেই খুলতে পারছে নিজের সামনে দুটি পথ। কোনটি বেছে নিয়ে এগোবে সে সিদ্ধান্তও একান্তই তার।
বাংলা ভাষায় খুব সুন্দর একটি কথা আছে, দ্বিধান্বিত পরিস্থিতি বোঝাতে_ দুই নৌকায় পা। দুই নৌকায় পা দিলে নাকি দুর্ঘটনার সমূহ আশঙ্কা। কিন্তু যদি প্রশ্ন করা হয়, কার নেই দুই নৌকায় পা? তবে উত্তর মেলা ভার। কেননা, সকলেরই পা দুই নৌকায়। ইতি আর নেতির নৌকা তো আছেই। আছে বুদ্ধি ও আবেগের নৌকাও। কেউ কেউ বলেন, বুদ্ধি দিয়ে নয়, অন্তরাত্মার পরামর্শ মেনে চলো। কেউ বা বলেন, আবেগ দিয়ে নয় বুদ্ধি দিয়ে বিচার করো। এই পৃথিবীতেই আমরা দেখছি, হাজার হাজার মানুষ ভবিষ্যৎ চিন্তা না করে ট্যাঙ্কের সামনে নেমে পড়ছে খালি হাতে যুদ্ধ করতে। কিংবা দেখছি বছরের পর বছর সামরিক শাসনের জাঁতাকলে জর্জরিত হয়েও কেউ পথে নামছে না। কখন কীভাবে কেন নামবে সে হিসাব মিলছে না তাদের। আবেগে যে নেমে পড়ছে রাস্তায় তাকে ঠিক বলবো নাকি তাকে ঠিক বলব যে বুদ্ধি দিয়ে চলতে চলতে বসে পড়ছে রাস্তায়? মূল্যবোধ ও বাস্তবতার দুই নৌকাও তো আছে। মূল্যবোধ বলে এটা করো, বাস্তবতা বলে বিপদ হতে পারে। প্রবৃত্তি বলে, নাও। নীতি বলে নিও না। প্রয়োজন বলে চলো, আদর্শ বলে থামো। দ্বিধা মানুষের দুরারোগ্য এক ব্যাধি। জোসেফ ক্যাম্পবেল লিখেছিলেন, মানুষের কী করা উচিত তা জানতে হলে বাইবেল পড়ূন। আর মানুষ কী করছে তা জানতে হলে পড়ূন সংবাদপত্র। ধর্মগ্রন্থগুলো বলে, ধর্মপথে চললে সে পথের একাগ্রতাই মানুষকে নিয়ে যাবে সেই স্বর্গে, যেখান থেকে সে বিচ্যুৎ হয়েছিল দ্বিধার খেসারত দিতে গিয়ে। কিন্তু স্বর্গে ফিরে যাবার ইচ্ছা কি সত্যিই মানুষের আছে? দুই নৌকা থেকে পা উঠিয়ে একটি নৌকা বেছে নেবার সামর্থ্য অর্জন করতে পারবে কি মানুষ কখনও? দ্বিধাহীনতা মানুষকে মানবোত্তীর্ণ করে বটে, কিন্তু দ্বিধা ছাড়া মানুষ হয় না। সত্যি কথা বলতে, দ্বিধা না থাকলে পৃথিবীই হতো না। দ্বিধা আছে বলেই, আছে_ পৃথিবী, সভ্যতা, যুদ্ধ, গ্গ্নানি, নশ্বরতা, পাপ, কামনা, প্রবৃত্তি। আর আছে কথাসাহিত্য।
No comments:
Post a Comment