ভারতের যোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক মন্ত্রী কপিল সিবাল গত মাসে ফেসবুক ও
গুগল নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বক্তব্য দিয়ে রীতিমতো বিপদে পড়ে গেছেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর ব্যবহারকারীরা তো বটেই, গণতান্ত্রিক ভারতের
সংবাদমাধ্যমগুলোও রীতিমতো তোপ দেগেছে মন্ত্রীর বিরুদ্ধে। বিভিন্ন পত্রিকা
সম্পাদকীয় প্রকাশ করে মন্ত্রীর সমালোচনা করেছিল। এ সম্পাদকীয়গুলোর মধ্যে
একটি বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। তারা বলেছিল, ভারতের মধ্যে চীন হওয়ার বাসনা কাজ
করছে। চীন ও ভারতকে আগামী বিশ্বের বড় দুই অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে বিবেচনা
করা হয়। চীনের প্রবৃদ্ধি, বাজার ও উন্নয়নের গতি ভারতকে নিত্যই তাড়া করে
ফেরে। ভারতের সরকার, ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা সবসময় চীনকে চোখে চোখে রাখেন।
ফলে ভারতে বহু উচ্চারিত শব্দ চীন, হয়তো চীনেও ভারত বেশ আলোচিত প্রসঙ্গ।
ভারত যে অর্থনৈতিক নিরিখে চীন হওয়ার বাসনা পোষণ করে সেটি অনেকের গ্রহণযোগ্য
বিষয়। কিন্তু গণতান্ত্রিক ভারত যদি গণতন্ত্র বিসর্জন দিয়ে চীনের মতো
দমননীতি অবলম্বন করে তবে প্রথমত তা পরিহাসের বিষয়, পরে উদ্বেগের বিষয়ও হয়ে
উঠতে পারে। একদলীয় অর্থাৎ কমিউনিস্ট শাসনের আদর্শে দীক্ষিত চীনে স্বাধীন
গণমাধ্যম নেই, জনগণের মতপ্রকাশের অধিকারও নেই। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার
আছে বটে কিন্তু ফেসবুক, গুগল সেখানে নিষিদ্ধ। চীনের নাগরিকরা ইচ্ছা করলেই
কোনো বিষয় নিয়ে লিখতে বা মত জানাতে পারেন না। কিন্তু ভারতে উল্টো
পরিস্থিতি। বহু বছরের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের কারণে ভারতে শক্তিশালী গণমাধ্যম
গড়ে উঠেছে। জনমতের শক্তিও সেখানে ব্যাপক। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে
দেশটির নাগরিকরা নিজেদের মত ব্যক্ত করছেন, সংগঠিত হচ্ছেন। এই ভারতে যদি
কোনো অজুহাতে কেউ গুগল-ফেসবুক নিষিদ্ধ করার দাবি জানায় তবে তাতে তীব্র
প্রতিক্রিয়া হতে বাধ্য। হয়েছেও তাই। মন্ত্রীর উক্তির পর কেউ কেউ বলেই
ফেলেছেন, ভারত কি জনমত রূদ্ধ করে চীনের পথে হাঁটতে শুরু করেছে? যদি তাই হয়
তবে চীন হওয়ার দরকার আমাদের নেই। এই চীন হয়ে আমরা কী করব? যদি নাগরিকদের
স্বাধীনতাই না থাকে তবে অর্থনীতি দিয়ে কী হবে? তারও চেয়ে বড় প্রশ্ন,
ইন্টারনেটের ওপর কড়াকাড়ি আরোপই কি চীনের উন্নয়নের মন্ত্র? যাই হোক, কপিল
সিবালের মন্তব্যের পর অনেক তর্ক-বিতর্ক হয়ে গেছে। কিন্তু সরকার দমেনি। তারা
গুগল ও ফেসবুকের কর্তাদের ডেকেছেন। ডেকে নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য সরানোর
উপায় নিয়ে চীনা স্টাইলে চাপ দিয়েছেন। গুগল, ফেসবুকের বড় বাণিজ্যিক স্বার্থ
আছে ভারতে। তারাও সরকারের ডাকে সাড়া দিয়েছে। ফেসবুক ও গুগল হরহামেশা
বিভিন্ন সরকারের আহ্বানে কনটেন্ট সরায় বা লুকিয়ে ফেলে। ভারত সরকার তাদের
সাম্প্রদায়িক উস্কানি বা অন্য কোনো ক্ষতিকর উপাদান সরিয়ে ফেলার অনুরোধ
জানাতে পারে। যদি জানায় তবে তাতে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু গুগল
বলে, বিভিন্ন দেশের সরকার তাদের কাছে সরকারবিরোধী উপাদান সরানোর আহ্বান
জানায় এবং তারা সেগুলো সরায়। অনুরোধের দলে ভারত অন্যতম দেশ। ফেসবুকও
অনুরোধে ঢেঁকি গেলে। যদি তাই হয়, তবে আর এ সাইটগুলো বন্ধ করার হুমকি উঠবে
কেন? মাথায় ব্যথা হলে ব্যথার ওষুধ দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু মাথা কাটা হবে
কেন? ভারতের একটি আদালত সম্প্রতি ফেসবুক ও গুগলের প্রতি হুশিয়ারি
উচ্চারণ করে বলেছেন, আপনাদের অবশ্যই কঠোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কায়েম করতে
হবে। নইলে আমরা চীনের মতো এ ধরনের সাইট বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবো। আপত্তিকর
উপাদান থাকলে তা সরানোর নির্দেশ আসতেই পারে। একেবারে নিরাময় অযোগ্য ব্যাধি
হলে সাইটও বন্ধ করে দেওয়ার উদাহরণ আছে। তাই বলে চীনের মতো? ভারত চীনের মতো
হতে চাইলে তাতে দুঃখের যথেষ্ট কারণ আছে। কথায় আছে, পুঁজিবাদে পেঁৗছানোর
সবচেয়ে দীর্ঘতম পথের নাম সমাজতন্ত্র। আর সমাজতন্ত্রে পেঁৗছানোর সবচেয়ে
সংক্ষিপ্ত পথ হলো মতপ্রকাশের অধিকার খর্ব করা। লোকে ভেবেছিল, ভারতের নব
উত্থানে তাদের যাত্রা হবে গণতান্ত্রিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো। সে আশায়
বুঝি এবার বালি পড়ল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বদলে চীন যাত্রা শুরু হলো
তার।
No comments:
Post a Comment