Thursday, February 24, 2011

শেষ দিক থেকে দ্বিতীয়


তালিকাটি যদি দুর্নীতির ধারণাসূচক হতো তবে রাজনৈতিক মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যেত। একদল বলত, দুর্নীতির ক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতি হয়নি। আরেক দল বলত, দুর্নীতির ক্ষেত্রে পিছিয়েও যায়নি দেশ, অর্থাৎ পরপর দুই বছর দুর্নীতির ধারণাসূচকে একই অবস্থানে থাকা একটা স্থিতিশীলতার লক্ষণ। এমন স্থিতিশীল অবস্থানে আমরা বেশ কয়েক বছর ছিলাম। দুর্নীতির ধারণাসূচকে একেবারে শীর্ষস্থানে থাকার সেই সময়ের কথা অনেকের মনে পড়বে এ প্রসঙ্গে। এবার দেশ নয় শহর। দুর্নীতি বিষয় নয়, বিষয় বসবাসযোগ্যতা। বসবাস অযোগ্যতার দিক থেকে গত বছর ঢাকা ছিল দ্বিতীয় অবস্থানে, এবারও তালিকায় দ্বিতীয় রয়েছে। ঢাকা শহরের বাসযোগ্যতা নিশ্চিত করার গুরুদায়িত্ব যাদের কাঁধে তারা বলতে পারেন, পরপর দুই বছর দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা স্থিতিশীলতার লক্ষণ। অবস্থা খারাপ হয়নি, এটাই তো স্বস্তির কথা। আগ বাড়িয়ে কেউ কেউ আবার ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিটকে দোষারোপ করতে পারেন। বলতে পারেন, তাদের জরিপে ভুল ছিল, তারা ধারণার ওপর জরিপ করেছেন। বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশকে হেয় করার জন্য এ ধরনের জরিপ চালানো হয়েছে, এমন কথাও উঠতে পারে। আরেকটু আগ বাড়িয়ে এ ধরনের জরিপের সঙ্গে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের সংযোগও খুঁজে দেখা যেতে পারে। কেউ বলতে পারেন, আমাদের শহর আমাদের মতোই। আমাদের নিজস্ব ভাষা সংস্কৃতি, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির মতোই আমাদের শহরও। এ শহর বিদেশিদের কাছে যাই হোক, আমরা সুখে আছি। আশার কথা, এখনও এমন মেঠোতর্কের দেখা মিলছে না। বোঝা যাচ্ছে, দুর্নীতি সূচকের মতো বসবাসযোগ্যতার সুযোগ এখানে কল্কে পাচ্ছে না। এ কথা সত্য, দুর্নীতি যেভাবে সমাজের নানা স্তরে বসবাসরত মানুষকে ভোগান্তির মধ্যে ফেলে দেয়, শহরের বাসযোগ্যতা ততটা করে না। শহরে বাস করে এমন কোটি মানুষের কাছে ঢাকাই একমাত্র শহর। পৃথিবীর অন্য কোনো শহর কতটা বাসযোগ্য তা তুলনা করে দেখার অবকাশ তাদের নেই। তুলনা করতে পারে শুধু তারাই যারা আর দশটা শহর দেখেছে, স্বচক্ষে না দেখলেও টিভি-ইন্টারনেটের কল্যাণে আর দশটা শহর সম্পর্কে ধারণা আছে। এমন মানুষের সংখ্যা কম। আমাদের অধিকাংশ মানুষ জানেন না নাগরিক সুবিধা, নিরাপত্তা, চলাচলের স্বাধীনতা, বসবাসের স্বস্তি কী জিনিস? সত্যি কথা বলতে, সর্বনিম্ন সুবিধা যা না থাকলে শহরটি বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে পড়ে_ সেই গ্যাস-পানি-বিদ্যুতের সরবরাহ নিশ্চিত করতেই আমাদের ব্যবস্থাপকরা হিমশিম খেয়ে যান। আমাদের রাস্তার তুলনায় যান বেশি, যানের তুলনায় লোক বেশি। ফলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মানুষকে ভোগান্তি পোহাতে হয়। পরিস্থিতি এমন যে, যারা কোনোদিন অন্য শহর দেখেননি, কোনো শহর সম্পর্কে শোনেননি পর্যন্ত, তারাও এ শহরকে বসবাসের অনুপযুক্ত ভাবে। আর যারা জানেন, বোঝেন তারা একটু বেশি অস্বস্তিতে থাকবেন এটা স্বাভাবিক। বিদেশিদের ক্ষেত্রে কী হবে সেটি বলাই বাহুল্য। ফলে তারা যখন গবেষণা করে একটি তালিকা করবেন তাতে ঢাকা শহরের নাম শেষ দিকে থাকাটাই স্বাভাবিক। তাই বলে যুদ্ধবিধ্বস্ত, দুর্ভিক্ষকবলিত হারারের পর? আমাদের চেয়ে অনেক অনুন্নত দেশের শহরও আমাদের থেকে উন্নত, অধিকতর বসবাসযোগ্য। সে দিকগুলো বিচার করলে মনে হয়, শহরের বাসযোগ্যতা শুধু অর্থনীতির সঙ্গে জড়িত নয়। পরিকল্পনা, ব্যবস্থাপনা, সদিচ্ছা এমন কিছু জরুরি ব্যাপার অনুন্নত দেশের শহরকেও উজ্জ্বল করে তুলতে পারে। সম্প্রতি বিশ্বকাপ ক্রিকেটের উদ্বোধনী হয়ে গেল। শহরকে ঘষে মেজে সাফ করে আমরা বিদেশিদের সামনে উপস্থাপন করতে চাইলাম। কোটি কোটি টাকা খরচ হলো শহর আলোকিত করতে গিয়ে। নানা আশাবাদ তৈরি হলো। মনে হলো, বিদেশিরা এবার পর্যটনের জন্য আসতে শুরু করবে। কিন্তু এখন ইকোনমিস্টের বিশ্লেষণ দেখে মনে হচ্ছে, সে আশা এখনও অনেক দূরের বিষয়। বসবাসযোগ্যতার দিক থেকে একটু একটু করে এগোতে পারলে নাগরিকদের যেমন অতিথিদেরও তেমনি উপকার হতো। কৃত্রিম ঝাড়ফুঁকে শহর সাজিয়ে লাভ নেই।

No comments:

Post a Comment