Wednesday, March 2, 2011
আলু
আলুর সঙ্গে সামরিকতা, অভিযান ও দেশ দখলের একটি ঐতিহাসিক সম্পর্ক আছে। আলু চাষের ইতিহাসে দেখা যায়, এই খাদ্যশস্যটির আদি উৎস আন্দিজ পর্বতমালাসংলগ্ন দেশগুলোতে, বৃহত্তর অর্থে লাতিন আমেরিকায়। প্রায় ১০ হাজার বছর আগে দক্ষিণ পেরুর মানুষেরা বন্য আলুকে পোষ মানিয়ে কৃষিজাত শস্যে পরিণত করেছিল। উত্তর-দক্ষিণ, লাতিন নির্বিশেষে বন্য আলুর দেখা পাওয়া যায়। লাতিন আমেরিকায় ইউরোপীয় বিশেষ করে স্প্যানিশ শাসনের বিস্তারের মাধ্যমে বিজয়ী স্প্যানিশদের সঙ্গে আলুর পরিচয় ঘটে। ষোড়শ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে স্পেনে আলুর চাষ হয়। ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর মাধ্যমে ইউরোপে আলু এলেও পশ্চিমা কৃষকরা আলুকে প্রথমে খুব সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখত, আলু চাষ করতে চাইত না। কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধি, খাদ্যশস্যের ক্রমবর্ধমান চাহিদা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে তারা আলু চাষে উৎসাহী হয়। কৃষকদের এই উৎসাহের আগে ইউরোপের নানা স্থানে স্প্যানিশ সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় আলু চাষ হতো। স্প্যানিশ সৈন্যদের জন্যই মূলত এই আলু চাষ হতো। পরে এই চাষ ইউরোপের অন্য জাতিগুলোর মধ্যেও ছড়িয়ে যায়। ব্রিটেনে ১৯ শতকের শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে আলু চাষের বিস্তার ঘটে। ফ্রেডরিক অ্যাঙ্গেলস বলেন, শিল্প বিপ্লবে লোহা বা ইস্পাতের যে ভূমিকা, আলুরও সেই ভূমিকা। বিশ্বাস করা হয় যে, আফ্রিকায় ঔপনিবেশিকদের মাধ্যমেই আলু চাষ বিস্তার লাভ করে। তবে এ ধারণাও আছে, আফ্রিকার সঙ্গে লাতিন আমেরিকার যোগাযোগ থেকেও সেখানে আলু চাষের প্রচলন হতে পারে। ঔপনিবেশিকরা কম দামের খাবার হিসেবে আলুর ওপর জোর দেয় এবং এটি স্থানীয়দের মধ্যে ব্যাপক অজনপ্রিয় খাবার হিসেবে বিবেচিত হতো। ধারণা করা হয়, ঔপনিবেশিকদের হাত ধরে এশিয়াতেও আলু এসেছিল। আঠারো শতকে কুয়ানলঙ শাসনের সময় অভাব ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে চীনে আলু চাষ শুরু হয়। তবে ভারতে শস্য হিসেবে আলু চাষ শুরু হয় আঠারো শতকের শেষ দিকে। আফ্রিকায় আলু শস্যের মর্যাদা পায় বিশ শতকের মাঝামাঝি এসে। আগে সীমিত আকারে চাষ থাকলেও, ব্যাপক আলু চাষের পেছনে যে ঔপনিবেশিকদের হাত ছিল তা নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে। আলু খুব সাদামাটা শস্য বা কন্দ হলেও এর ইতিহাস খুবই জটিল। প্রথমে পরাজিতদের কাছ থেকে এটি বিজয়ীরা রপ্ত করে পরে বিজিতদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিল। দুটোর সঙ্গেই সামরিক অভিযান ও সাফল্যের সম্পর্ক জড়িত। মজার ব্যাপার হলো, সামরিক বাহিনীর সাধারণ সভ্যদের খাবার হিসেবে আলুর ব্যাপক ব্যবহার হয়েছে অতীতে। দুর্ভিক্ষ, অভাব ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটেও আলুর কদর বেড়েছে। আলু চাষকে নতুন এলাকায় প্রথমে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখা হলেও পরে চাষে বাধ্য হয়েছে কৃষকরা। বাংলাদেশেও বহুদিন পর্যন্ত আলু চাষে কৃষকরা অনুৎসাহী ছিল। আলুকে খাবার হিসেবে নিম্নমানের বলে বিবেচনা করা হতো। ব্যাপকভাবে আলু চাষ ও আলুর ব্যাপক ব্যবহার অতি সাম্প্রতিক ঘটনা। আমাদের এখানে প্রধান খাদ্যশস্য ধান বা চাল। আলু সাধারণত প্রধান খাবার হিসেবে খাওয়া হয় না। বিভিন্ন তরকারির সঙ্গে সহযোগী আইটেম হিসেবে আলু ব্যবহৃত হয়। তবে খাদ্যশস্যের অভাব দেখা দিলে কিংবা চালের দাম বাড়লে এখানে শাসকরা আলু জনপ্রিয় করার উদ্যোগ নেন। ঐতিহাসিকভাবে আলুর সঙ্গে সামরিক বাহিনীর সম্পর্কের কারণেই হয়তো বা এদেশের সামরিক ও সামরিক বাহিনী সমর্থিত সরকারগুলো আলু জনপ্রিয় করার উদ্যোগ নিয়েছিল। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনে আলু জনপ্রিয় করার জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। সামরিক বাহিনী সমর্থিত বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও আলু নিয়ে বিশেষ উদ্যোগ এসেছিল। গণতান্ত্রিক সরকারগুলো আলুকে ততটা গুরুত্ব দেয় না। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, ইতিহাসে যাই ঘটুক, আলু এখন বাস্তবতা। আলু চাষ করে কৃষকরা মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকলে সেটি ভালো কথা নয়। আলু আগামী দিনের জন্য সংরক্ষণ করা সম্ভব কোল্ডস্টোরেজ সিস্টেমের মাধ্যমে। চালের বর্তমান বাজারে আলু খাওয়াকে উৎসাহিতও করা যেতে পারে। কিন্তু সেটি গণতান্ত্রিক পন্থায় হলে ভালো।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment