Monday, January 24, 2011
বেবি ডকের প্রত্যাবর্তন
২৫ বছরের স্বেচ্ছানির্বাসন থেকে 'বেবি ডকে'র প্রত্যাবর্তন ঘটেছে হাইতির রাজনীতিতে। তরুণ প্রজন্মের কাছে বেবি ডক খুব পরিচিত নাম নয়। কিন্তু হাইতির রাজনীতির খবর একটু তলিয়ে দেখলেও বেবি ডকের খবর মেলা কঠিন কিছু নয়। রবিঠাকুরের গল্প 'খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন' কথাটি বাংলায় কালক্রমে একটি বাগধারা হিসেবেই গৃহীত হয়েছে। সেই বাগধারাটি বোধকরি বেবি ডকের প্রত্যাবর্তনের সঙ্গে বেশ মিলিয়ে দেওয়া চলে। হাইতির রাজনীতিতে বেবি ডক বা খোকাবাবু বলে পরিচিত জঁ ক্লদ দুভেলিয়ের প্রত্যাবর্তনের পর দেশটির রাজনীতির দিকে সবাই বেশ কৌতূহলী দৃষ্টি দিয়েছেন। দেশে ফিরে বেবি ডক বলেছেন, তিনি দেশের সংকটের সময় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্যই ফিরেছেন। অবশ্য ক্ষমতাসীন সরকার তাকে গ্রেফতার করে দুর্নীতির অভিযোগে জেলে পুরে দিয়েছে ইতিমধ্যে। এ হলো গত সপ্তাহের ঘটনা। হাইতির বর্তমান সংকট কোথায়, সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে সকলের মনে পড়বে ২০১০ সালের ২৪ জানুয়ারির কথা। অর্থাৎ আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে দেশটি ৭ মাত্রার মারাত্মক ভূমিকম্পে পুরো বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এ ভূমিকম্পে প্রায় ৩ লাখ মানুষ মারা যায়, ৩ লাখ আহত হয় এবং ১০ লাখ গৃহহীন হয়ে পড়ে। রাজধানী পোর্ট অ প্রিন্সের প্রেসিডেন্ট প্যালেস, ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি, কেন্দ্রীয় ক্যাথিড্রালসহ বহু স্থাপনা ধ্বংস হয়ে যায়। এই ভূমিকম্পের পর লাতিন আমেরিকার সবচেয়ে গরিব এই দেশটি এক গভীর সংকটে পড়ে। গত একটি বছর ডায়রিয়া-কলেরার মতো মহামারীর ধকল সইবার পর 'পতন' বা 'আরও খারাপ দশা'র কোনো অস্তিত্ব সেখানে নেই। কারও কারও হয়তো মনে পড়বে, বিধ্বস্ত এই দেশটির প্রাথমিক উদ্ধার অভিযানে যুক্তরাষ্ট্র বুশ ও ক্লিনটন দু'জনকেই পাঠিয়েছিল। কিন্তু হাইতিকে বাঁচানোর তাদের প্রচেষ্টা থমকে যায়। কারণ, এই বিপর্যয়ের মধ্যেও হাইতিয়ানরা ষড়যন্ত্রমূলক সাহায্যের বিরোধিতা করেছিল। এর ফল হয়েছে মারাত্মক। বিভিন্ন রিপোর্ট সূত্রে দেখা যাচ্ছে, এক বছর আগের হাইতির সঙ্গে আজকের হাইতির কোনো পার্থক্য নেই। যে ধ্বংসস্তূপ তৈরি হয়েছিল, তাতে জীবনের কোনো আশা তৈরি হয়নি। এ অবস্থাতেই ফিরলেন বেবি ডক। অনেকের মনে পড়বে, আশির দশকে আফ্রিকান সোয়াইন ফ্লুর মহামারীর পর যে সংকটে পড়েছিল হাইতি, তারই ফল হিসেবে বেবি ডকের ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটেছিল। ২৫ বছর পরের আরেকটি বিপর্যয়ের পর বেবি ডকের প্রত্যাবর্তন ঘটল। ইতিমধ্যে দেশটিতে কেউ কেউ তাকে উদ্ধারকর্তা হিসেবে ভাবতে বসেছেন। বেবি ডকের স্বৈরাচারী শাসনের পতন ঘটেছিল অভ্যন্তরীণ আন্দোলন ও খানিকটা বাইরের চাপে। কিন্তু বেবি ডক যার সন্তান সেই পাপা ডক হাইতির জনপ্রিয় শাসক ছিলেন। পাপা ডক নামে পরিচিত ফঁদ্ধাসোয়া দুভেলিয়ের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে গণআন্দোলনের ফল হিসেবে হাইতির শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। ১৯৫৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত আমৃত্যু তিনি হাইতি শাসন করেছেন। মৃত্যুর পর বেবি ডক তার উত্তরাধিকার ১৫ বছর বহন করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত পাপা ডক স্বৈরাচারী শাসন কায়েম করেছিলেন তা শাসনকালের বহর দেখলেই বোঝা যায়। আর বেবি ডকের কথা তো বলাই বাহুল্য। সব মিলিয়ে হাইতির মতো দুর্ভাগা জাতি বোধ হয় খুব কমই আছে। কিন্তু আঠারো-উনিশ শতকে পৃথিবীর বুকে হাইতি এক নতুন আশা নিয়ে এসেছিল। হাইতিই লাতিন আমেরিকার প্রথম স্বাধীন দেশ। ১৮০৪ সালে হাইতিয়ান বিপ্লবের পর প্রথম আফ্রিকান দাসদের নেতৃত্বে স্বাধীন রাষ্ট্র তৈরি হয়েছিল হাইতিতেই। বলা হয়ে থাকে, হাইতি হলো লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা আর আমেরিকার সেতু। প্রথম স্বাধীনতা, সম্ভাবনা ও স্বপ্নে উদ্গাতা। হাইতি হয়তো এখনও স্বাধীনতা, মুক্তি ও সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখানোর দায় শোধ করে চলেছে। ফরাসি বিপ্লবের প্রেরণায় হাইতিতে যে বিপ্লব হয়েছিল তারই প্রেক্ষাপটে কিউবান ঔপন্যাসিক আলেহো কার্পেন্তিয়ের একটি উপন্যাস লিখেছিলেন 'এল রেইনো দ্য এস মুন্দে' বা 'কিংডম অব দিস ওয়ার্ল্ড'। বাংলায় উপন্যাসটি অনুবাদ করেছেন মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় 'এই মর্ত্যের রাজত্বে' নামে। সেখানে বলা আছে দুর্ভাগা এই জাতিটির করুণ ইতিহাস, সবিস্তারে। আজকের হাইতির দিকে তাকালে মনে হয়, মর্ত্যের রাজত্বে নিজের দেশ থেকে উৎখাত হওয়া দাসদের যে দুঃখের জীবন শুরু হয়েছিল সে বঞ্চনার ইতিহাস কখনও
থামবার নয়।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment