Tuesday, June 29, 2010

একশ' রুপির উপন্যাস!


বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের হাল-হকিকত হয়তো অনেকের জানা; কিন্তু কতটুকু জানা থাকা সম্ভব? একুশে বইমেলায় বই প্রকাশিত হয় কয়েক হাজার। এই বিপুল বইয়ের সম্ভারে চেনা-জানা, সিরিয়াস কিংবা জনপ্রিয় লেখকদের বই হাতে গোনা। এ সামান্যসংখ্যক বই নিয়েই পত্র-পত্রিকায় আলোচনা হয়, পাঠকরাও আগ্রহ ভেদে সে বই থেকে কেনাকাটা সারেন। এর বাইরে বইয়ের বিশাল একটি অংশ থেকে যায় সচেতন পাঠকের নাগালের বাইরে। অবশ্য নাগালের বাইরে বললে ভুল হবে, বইমেলার ঠিক বাইরেই রাস্তায় পাটি বিছিয়ে ভারতীয় পাইরেসি বইয়ের পাশে যে দুর্বল মলাটে, হালকা প্রচ্ছদে, বাহারি নামের বইগুলো শোভা পায় সেগুলো তো চেনা লেখকের চেনা বইয়ের চেয়ে হাতের নাগালে মেলে বেশি। নীলক্ষেতে, পুরানা পল্টনে ফুটপাতের বইয়ের দোকানে এ বইগুলোর কাটতি ভালো। আর ঢাকার বাইরে জেলা শহরগুলোর বইয়ের দোকান মানে কম দামের এসব বাহারি বইয়ে ভরা সেলফ। বছরখানেক আগে এসব বই নিয়ে একটি প্রতিবেদনও চোখে পড়েছিল। সেখানেই জানতে পেরেছিলাম, ভুল বানানে, কোনো সম্পাদনা, বাছ-বিচারের অবকাশ না রেখে ছাপা এসব বইয়ের নাম নেটবই। বাংলাবাজারের কিছু প্রকাশকের আয়ের উৎস এ নেটবই। নবিশ বা শখের লেখকরা পাণ্ডুলিপি নিয়ে এলে টাকার বিনিময়ে ছেপে কিছু বই লেখককে ধরিয়ে দিয়ে বাকিগুলো বাজারে ছেড়ে কিছু টুপাইস কামান অনেক প্রকাশক। মজার ব্যাপার হলো, মফস্বল বা রাজধানীর শখের লেখকরাই শুধু নন, প্রবাসী লেখকদের মহা-কদর আছে এমন প্রকাশকদের কাছে। নিজের টাকায় বই বের করেন আর সে টাকা থেকে লভ্যাংশটা পকেটে পুরতে পারেন বলে প্রকাশকরা নাকি নেটবইয়ের মুরগা ধরার জন্য তক্কে তক্কে থাকেন। বাংলাবাজারের নেটবই থেকে বেস্ট সেলার বেরিয়েছে কি-না সে খবর এখনও আমরা জানি না। নেটবই ছেপে কোনো প্রকাশক কোটিপতি হয়ে গেছেন কি-না সে বিষয়েও আমরা বেখবর; কিন্তু ভারতের বাজারে এখন নাকি ১০০ রুপির উপন্যাসের বেশ কাটতি। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস গত ২৬ তারিখে এ নিয়ে একটি রিপোর্ট ছেপেছে। কৌতূহলকর এ রিপোর্টে বলা হচ্ছে, ভারতের ইংরেজি বইয়ের বাজারে এখন চালু ট্রেন্ড হলো ১০০ রুপির সাহিত্য। প্রকাশনা শিল্পে এ নিয়ে বিরাট একটা হেস্তনেস্ত হয়ে গেছে। কোনো সম্পাদনা, গ্র্যামার, বানানের বালাই নেই, স্রেফ সস্তা প্রেমকাহিনী মলাটবদ্ধ করে ছাড়ছে প্রকাশনা সংস্থাগুলো।
ভারতে ১০০ মিলিয়ন মানুষ ইংরেজিতে কথা বলে। আর এ মানুষগুলোর কাছে এ হালকা উপন্যাসই বিকোচ্ছে দেদার। বলা হয়ে থাকে, ভারতে কোনো বই ৫ হাজার কপি চললেই বইটিকে বেস্ট সেলার তকমা দেওয়া হয়; কিন্তু সৃষ্টি পাবলিশার্স এমন সব ১০০ রুপির উপন্যাস বের করেছে, ভারতজুড়ে এসব বইয়ের ১৬ হাজার থেকে ১ লাখ পর্যন্ত বিক্রি হওয়া কোনো ব্যাপারই নয়। সৃষ্টি পাবলিশার্সের বয়স ১২ বছর। মালিক জয়ন্ত কে বসু। তারা এ জনপ্রিয়তার বাজারে ঢুকেছে মাত্র ২০০৮ সালে। এর মধ্যেই তারা ৩৬ জন নাম না জানা লেখকের বই বাজারে এনেছে। এদের মধ্যে কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ ছাত্র, একজন আবার ১৬ বছরের বালক। এদের অনেকে লেখক হওয়ার আগে একটা-দুটোর বেশি বইও পড়েনি। জয়ন্ত কে বসু বলছেন, তারা পাঠক বাড়াচ্ছেন। পাঠকরা পড়ছে, ফলে বই প্রকাশিত হচ্ছে। জয়ন্ত ছিলেন রুপা প্রকাশনীর মার্কেটিং বিভাগের কর্মকর্তা। এখন তিনি সৃষ্টিকে এমন এক জায়গায় নিয়ে এসেছেন যে, সৃষ্টি পাবলিশার্সকে এখন একতা কাপুরের বালাজি টেলিফিল্মসের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। একতা কাপুর যেমন প্রত্যেক টিভি সিরিয়াল শুরু করেন কে দিয়ে, তেমনি জয়ন্তও বইয়ের নাম দেন ১৯ বর্ণের। নামগুলোও বাহারি। যেমন- অফকোর্স আই লাভ ইউ...!, নাউ দ্যাট ইউ আর রিচ...। অবস্থা এমন জায়গায় গিয়ে ঠেকেছে, পেঙ্গুইন ইন্ডিয়া, রুপার মতো প্রকাশনীগুলোও বাজারে ঢোকার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। ১০০ রুপির উপন্যাস ছাপা শুরু করেছে। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠবে_ এ উপন্যাসগুলোতে থাকে কী? একজন লেখক বলছেন, 'আমরা কঠিন শব্দ ব্যবহার করি না। আর গল্পটা এমনভাবে বলি যেন লিখছি না, পাঠক আমার সামনে দাঁড়িয়ে, আমি তাকে বলছি।'

No comments:

Post a Comment