Tuesday, June 15, 2010

দরজায় কড়া নাড়ছে পত্রিকার হকার : অরুন্ধতী রায়




ভারত সরকার যখন দেশের প্রান্ত-অঞ্চলে বিদ্রোহীদের দমনের জন্য সেনা ও বায়ুসেনা মোতায়েনের চিন্তাভাবনা করছে তখন শহরাঞ্চলে অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটছে। 'গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা কমিটি' ২ জুন মুম্বাই শহরে একটি জনসভার আয়োজন করে। মূল বক্তা ছিলেন 'ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি'র সম্পাদকীয় উপদেষ্টা গৌতম নাভলাখা আর আমি। মিডিয়ার উপস্থিতি ছিল দেখার মতো। সভা হয়েছিল ৩ ঘণ্টা। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় তা সাড়ম্বরে প্রচারিতও হয়েছিল। ৩ জুন কিছু পত্রিকা, টিভি ও রেডিফের মতো কিছু অনলাইন খবরদাতা সাইট বস্তুনিষ্ঠভাবে এ বিষয়ক খবর প্রচার করেছিল। টাইমস অব ইন্ডিয়ার মুম্বাই সংস্করণের শিরোনাম হয়েছিল 'আমাদের এখন এমন একটা আদর্শ দরকার যা বামও না, ডানও না।' হিন্দু পত্রিকার খবরের শিরোনাম হয়েছিল 'আমরা কি পাহাড়ে বক্সাইট ফেলে রাখতে পারি?' সভার ভিডিও ইউটিউবে আপলোড করা হয়েছিল।
কিন্তু মিটিংয়ের পরদিন আমি যা বলেছিলাম তাকে মিথ্যা আকারে কর্কশভাবে উপস্থাপন করে পিটিআই। খবরটি প্রথম প্রকাশিত হয় ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে ৩ জুন ১টা ৩৫ মিনিটে। শিরোনামে লেখা হয়েছিল, 'অরুন্ধতী মাওবাদীদের সমর্থন দিচ্ছেন এবং কর্তৃপক্ষ তাকে গ্রেফতার করতে পারে এই ভয়ে ভীত নন'। সংবাদের কিছু অংশ এখানে তুলে দিচ্ছি :
"লেখক অরুন্ধতী রায় মাওবাদীদের প্রতিরোধ আন্দোলনকে যথার্থ মনে করেন এবং এই সমর্থনের জন্য কর্তৃপক্ষ যদি তাকে গ্রেফতার করে তবে তার তোয়াক্কা তিনি করেন না। রায় বলেন, 'নকশাল আন্দোলন সশস্ত্র সংগ্রাম ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু আমিও দোষারোপমূলক রাজনৈতিক বিশ্লেষণের সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে। এই আন্দোলন সশস্ত্র হওয়াটাই উচিত ছিল। বিরোধিতার গান্ধীবাদী পদ্ধতিতে শ্রোতার প্রয়োজন হয়, যা এখানে অনুপস্থিত।' সংগ্রামের এই পথ বেছে নেওয়ার আগে মানুষ এ নিয়ে দীর্ঘ তর্ক-বিতর্ক করেছে। দাতেঁওয়াড়াতে নিরাপত্তারক্ষীদের বিরুদ্ধে মাওবাদীদের ভয়াবহ হামলায় ৭৬ জন সিআরপিএফ ও পুলিশের মৃত্যুর ঘটনায় অরুন্ধতী মাওবাদীদের স্যালুট জানিয়েছেন। তিনি বলেন, 'আমি লাইনের একপাশে নই। আমি কারও পরোয়া করি না... আমাকে তুলে নিয়ে জেলে ভরে ফেলো'।"
খবরের শেষ থেকেই শুরু করি। আমি ৭৬ সিআরপিএফ সদস্যের নিহত হওয়ার ঘটনায় দাতেঁওয়াড়ার মানুষকে স্যালুট জানিয়েছি_ এই কথাটি একটি অপরাধমূলক বিকৃতি। আমি সিএনএন-আইবিএনের সঙ্গে একটি সাক্ষাৎকারে এটি স্পষ্ট করে বলেছি যে, সিআরপিএফ সদস্যদের মৃত্যুর ঘটনাকে আমি দুঃখজনক মনে করি। আমি মনে করি, তারা গরিবের বিরুদ্ধে ধনীদের যুদ্ধে দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছেন। মুম্বাইয়ের সভায় আমি যা বলেছি তা হলো, মিডিয়া যে অন্তঃসারশূন্য দোষারোপের ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তুলেছে আমি তাকে সমালোচনা করি। যুদ্ধ শুরু হয়েছে, সহিংসতাও বিস্তার লাভ করেছে, এখন দু'পক্ষের নৃশংসতার খবর সংবলিত কোনো নিরপেক্ষ অবস্থান নেওয়া কঠিন। ফলে এক পক্ষের নৃশংসতার ওপর ভিত্তি করে নৃশংসতার বিশ্লেষণ অর্থহীন হয়ে পড়েছে। আমি বলেছি, আমি ওইখানে সরকার বা মাওবাদী কারও দ্বারাই কোনো সাধারণ মানুষ হত্যার ঘটনাকে সমর্থন দেওয়ার জন্য উপস্থিত ছিলাম না। এখন গুরুত্বপূর্ণ এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যে, আদিবাসী গ্রামগুলোতে সিআরপিএফ সদস্যরা ২৭টি একে ফোরটি সেভেন, ৩৮টি আইএনএসএএস, ৭টি এসএলআর, ৬টি লাইট মেশিনগান নিয়ে কী করছিল? যদি তারা যুদ্ধ করতেই গিয়ে থাকে তবে মাওবাদীদের দ্বারা সিআরপিএফ সদস্যদের হত্যার ঘটনাকে দোষারোপ করার মানে হলো, এই যুদ্ধে সরকারের পক্ষাবলম্বন করা। আর এই যুদ্ধের সঙ্গে আমরা অনেকেই দ্বিমত পোষণ করি।
পিটিআইর খবরের বাকি অংশগুলো সভা সম্পর্কে বিদ্বেষপ্রসূত, বুদ্ধিহীন মুড়িঘণ্ট। মাওবাদীদের সম্পর্কে আমার অবস্থান পরিষ্কার। আমি তাদের নিয়ে দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছি। আমি ওই সভায় বলেছি, করপোরেট কোম্পানির ভূমিগ্রাসের বিরুদ্ধে মানুষ যে আন্দোলন করছে তাতে বিভিন্ন মতাদর্শের মানুষ একত্রিত হয়েছে। এই মতাদর্শের মানুষের মধ্যে মাওবাদীরা সবচেয়ে জঙ্গি। আমি বলেছি, সরকার এখন সবাইকে মাওবাদী হিসেবে আখ্যায়িত করছে, যাতে সবার বিরুদ্ধে নিপীড়নমূলক ও সামরিক ব্যবস্থা নেওয়া যায়। আমি বলেছি, সরকার মাওবাদী কথাটাকে এমনভাবে সম্প্রসারিত করেছে যে, যারাই তাদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে এবং ন্যায়বিচার নিয়ে কথা বলছে তারাই এখন মাওবাদীতে পরিণত হয়েছে। আমি কালিংনগর ও জগৎসিংপুরের মানুষের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি, যারা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করেও সশস্ত্র পুলিশের দ্বারা ঘেরাও হয়েছিল এবং তাদের গুলি করা হয়েছিল। আমি বলেছি, স্থানীয় মানুষেরা কী পদ্ধতিতে প্রতিরোধ করবে তা নির্বাচনের জন্য দীর্ঘদিন চিন্তাভাবনা করে তবেই সিদ্ধান্ত নেয়। আমি বলেছি, কেন গভীর বনের মানুষেরা গান্ধীবাদী প্রতিরোধের পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারে না। সত্যাগ্রহের জন্য এক ধরনের রাজনৈতিক মঞ্চ দরকার, এটি কার্যকর করার জন্য দরকার সহানুভূতিসম্পন্ন মানুষের উপস্থিতি, কিন্তু গভীর বনে সেটি নেই। আমি কথা বলেছি ক্ষুধার্ত মানুষের সঙ্গে, তারা কীভাবে আমরণ অনশনে যাবে? আমি কখনও বলিনি, 'এই আন্দোলন সশস্ত্র হওয়াই উচিত ছিল।' (এই পৃথিবীতে কথাটার মানে কী দাঁড়ায় আমি জানি না।)
আমি বলেছিলাম, বিভিন্ন মতভিন্নতা সত্ত্বেও আজ অনেক আন্দোলন চলছে এবং সেগুলো চলছে একই শত্রুর বিরুদ্ধে। ফলে তারা সবাই একই দিকে এবং আমি তাদের পাশে আছি। কিন্তু লাইনের এই পাশ থেকে শুধু সরকারকে প্রশ্ন করাই কর্তব্য নয়, আমাদের নিজেদেরও প্রশ্ন করতে হবে। আমি যা বলেছিলাম, তা হুবহু এই :
'আমি যে প্রতিরোধকে ধারণ করি তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমি লাইনের এই পাশে আছি। আমি এ নিয়ে সচেতন। আমি পরোয়া করি না, আমাকে তুলে নাও, জেলে ভরে ফেলো। আমি লাইনের এই পাশে আছি। কিন্তু এই পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের ঘুরে দাঁড়ানো এবং সহযোদ্ধাদের প্রশ্ন করা উচিত।'
এরপর আমি বলেছি, যখন এটা বলা হচ্ছে যে, প্রতিরোধের গান্ধীবাদী পদ্ধতি কার্যকর নয়, তখন এটা মনে রাখা দরকার যে নর্মদা বাঁচাও আন্দোলনের মতো কার্যকর গান্ধীবাদী আন্দোলনের একটি মৌলিক ও বিপ্লবী উন্নয়ন দর্শন আছে। কিন্তু মাওবাদী আন্দোলন যেখানে কার্যকর সেখানে তারা কোনো বিকল্প উন্নয়ন পরিকল্পনার কথা ভেবেছেন কি-না এ নিয়ে সন্দেহ আছে। সরকার প্রাইভেট কোম্পানির কাছে খনি বিক্রি করে দিচ্ছে এই তথ্যের বাইরেও যে প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ সেটি হলো, রাষ্ট্রের খনিনীতির চেয়ে মাওবাদীদের খনিনীতি কি খুব আলাদা? তারা কি পাহাড়ে বক্সাইট ফেলে রেখে দেবে? নাকি ক্ষমতায় এলে তারা খনন চালাবে? আমি পাবলো নেরুদার সেই 'আদর্শ তেল কোম্পানি' কবিতাটির কথা উল্লেখ করতে পারি, যেখানে এই পুরনো তর্কটির কথা বলা হয়েছে।

পিটিআই রিপোর্টার আয়োজকদের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে সভা রেকর্ড করার পর এই মনগড়া 'ব্যাখ্যা' দাঁড় করাতে পারেন না। এটা ভয়াবহ মিথ্যাচার। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, ৪ জুন বিভিন্ন সংবাদপত্র ও টিভি একদিনের পুরনো এই রিপোর্ট প্রকাশ করে। আর এসব পত্রিকা ও টিভির নিজেদের রিপোর্টাররা আগের দিন সঠিক সংবাদ দিয়েছেন এবং জানেন পিটিআইর রিপোর্টটি মিথ্যা। দি ইকোনমিক টাইমস বলেছে, 'অরুন্ধতী রায় প্রকাশ্য সভায় অং সান সু চি হতে চেয়েছেন।' আমি এটা জানতে আগ্রহী যে, কেন সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলগুলো একই খবর একবার সত্য আরেকবার মিথ্যা আকারে মোট দুইবার ছাপতে আগ্রহী হলো?'
ওইদিন সন্ধ্যা ৭টায় দুই মোটরসাইকেল আরোহী আমার দিলি্লর বাসায় এসে জানালায় পাথর ছুড়ে মেরেছে। একটি পাথর রাস্তায় ক্রীড়ারত এক বাচ্চার গায়ে প্রায় আঘাত করতে বসেছিল। এতে ক্ষিপ্ত মানুষ জড়ো হয়, লোক দুটি পালিয়ে যায়। এর মিনিট খানেকের মধ্যেই একটি টাটা ইন্ডিকা এসে হাজির। একটি লোক নিজেকে জিটিভির রিপোর্টার পরিচয় দিয়ে জিজ্ঞেস করল, এটা কি অরুন্ধতী রায়ের বাড়ি? এখানে কি কোনো সমস্যা হয়েছে? স্পষ্টভাবেই বোঝা যায়, এটি আমাদের টিভি চ্যানেলগুলোর পাতানো নাটক মঞ্চায়নের আগ্রহে ঘটেছে, যেখানে দেখানো হতো অরুন্ধতী রায় জনরোষের শিকার হয়েছেন। আমার সৌভাগ্য, তাদের চিত্রনাট্যে ভুল ছিল। কিন্তু আরও অনেক কিছু তখনও বাকি ছিল। ৫ জুন রায়পুরের দৈনিক ভাস্কর একটি খবর ছাপে, যেখানে লেখা হয়, 'সাহস থাকে তো এসি রুম ছেড়ে জঙ্গলে আসুন, অরুন্ধতী রায়।' ওই সংবাদে ছত্তিশগড় পুলিশের মহাপরিচালক বিশ্বরাজন আমার উদ্দেশে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেছেন, মাওবাদীদের সঙ্গে যোগ দিয়ে আমি যেন পুলিশকে মোকাবেলা করি। ভাবুন, পুলিশের মহাপরিচালক বনাম আমি, ম্যান টু ম্যান এমন লড়াইয়ের কথা। ভারতীয় জনতা পার্টির ছত্তিশগড়ের নেতা পুনম চতুর্বেদী সাংবাদিকদের বলেন, আমাকে চৌরাস্তায় গুলি করে মেরে ফেলা উচিত। এবং আমার মতো অন্য বিশ্বাসঘাতকদের শূলে চড়ানো উচিত (কারও উচিত তাকে জানানো যে, সরাসরি এ ধরনের সহিংসতা ছড়ানো ইন্ডিয়ান পেনাল কোডে শাস্তিযোগ্য অপরাধ)। ৮ জুন হিন্দি দৈনিক নয়ি দুনিয়া খবর দেয়, 'মাওবাদীদের প্রকাশ্যে সমর্থন' দেওয়ার অপরাধে দুজন ব্যক্তি ছত্তিশগড়ের দুটি থানায় নালিশ জানিয়েছেন।
এটাকেই বলে মনস্তাত্তি্বক যুদ্ধ। নাকি এটি অপারেশন গ্রিন হান্টের শহুরে ভূত? যেখানে একটি সরকারি সংবাদ সংস্থা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে একটি নথি তৈরি করার জন্য সহায়তা করছে, যখন ওই মন্ত্রণালয় আমার বিরুদ্ধে কোনো তথ্যপ্রমাণ খুঁজেও পায়নি? নাকি পিটিআই সরকারকে এই ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করছে যে, আমাদের মধ্যে যারা বেশি পরিচিত তাদের গ্রেফতার করলে সরকারের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির ক্ষতি হবে না? নাকি এটি সেই নিষ্ঠুর খেলার অংশ, যাতে কোনো বিচার-বিবেচনার অবকাশ না রেখে বলা হয়, যদি তুমি আমাদের সঙ্গে না থাক, তবে তুমি মাওবাদীদের সঙ্গে আছ। তুমি শুধু একজন মাওবাদী নও, তুমি বোকা, উগ্র ও উচ্চরবের মাওবাদী। যাই হোক, এটি ভয়ঙ্কর ও লজ্জাহীন এবং নতুন একটি ঘটনা। যে কোনো কাশ্মীরিকে জিজ্ঞেস করুন, বা যে কোনো তরুণ মুসলিমকে যে 'সন্ত্রাসী' হিসেবে গ্রেফতার হয়েছে শুধু ভিত্তিহীন সংবাদের ভিত্তিতে। জিজ্ঞেস করুন মোহাম্মাদ আফজালকে, যাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে 'সমাজের যৌথ অবচেতনাকে শান্তি দিতে'।
এখন অপারেশন গ্রিন হান্ট আমার মতো লোকের দরজায় করাঘাত করতে শুরু করেছে। ভাবুন সেই সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মীদের কথা, যারা সমাজে পরিচিত নন, তাদের ক্ষেত্রে কী হচ্ছে। ২০০ জনকে জেল দেওয়া হয়েছে, নির্যাতন করা হয়েছে অথবা সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর ঘটনাটি ঘটেছে ২৬ জুন জরুরি অবস্থার ৩৫তম বার্ষিকীতে। যেন ভারতীয় জনগণকেই এখন জরুরি অবস্থা জারি করতে হবে (কেননা সরকার এটি করবে না)। প্রশ্ন হলো, জরুরি অবস্থা কি কখনও তুলে নেওয়া হয়েছিল? এখন সেন্সরশিপ বড় সমস্যা নয়, এর চেয়ে বড় সমস্যা হলো সংবাদের নির্মাণশিল্প।

ভারতের আউটলুক ম্যাগাজিন থেকে
ভাষান্তর : মাহবুব মোর্শেদ

No comments:

Post a Comment