Sunday, November 14, 2010

মানুষকে ইতিহাস বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা দিতে চাই না : অরুন্ধতী রায়


অরুন্ধতী রায় সম্প্রতি কাশ্মীরের শ্রীনগরে আয়োজিত এক সেমিনারে বলেছেন, 'কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ নয়।' এ নিয়ে ভারতে তীব্র বিতর্ক উঠেছে। এ বিতর্কের রেশ ধরে তেহেলকা পত্রিকার পক্ষ থেকে তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোমা চৌধুরী। সাক্ষাৎকারটি সমকালের পাঠকদের জন্য অনূদিত হলো


প্রশ্ন : আপনি দিলি্ল ও কাশ্মীরে যে বক্তব্য দিয়েছেন তার পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্র আপনার বিরুদ্ধে রাজদ্রোহের অভিযোগ আনার কথা ভাবছে। রাষ্ট্রদ্রোহ বিষয়ে আপনার ভাবনা কী? আপনি কি নিজেকে রাষ্ট্রদোহী হিসেবে দেখেন? আপনি যে দিলি্ল ও কাশ্মীরে বললেন 'আজাদিই একমাত্র সমাধান'_ তার পেছনে কারণ কী?
উত্তর : রাষ্ট্রদ্রোহ একটি প্রাচীন ও বাতিল ধারণা, 'টাইমস নাউ' নামে একটি চ্যানেল আমাদের জন্য এটি পুনরাবিষ্কার করেছে। মনে হচ্ছে, চ্যানেলটি উন্মত্তভাবে আমাকে পেড়ে ফেলতে এবং জনতার রুদ্ররোষের শিকার বানাতে চায়। আমি কে এইখানে? একটা টিভি চ্যানেলের জন্য ছোট টার্গেট। এরকম পরিস্থিতিতে একজন লেখককে বিনা বিচারে বলি দেওয়া খুব কঠিন কিছু নয়, আমার মনে হয় তারা সেটাই করতে চায়। আক্ষরিকভাবেই এটি আমাকে উত্ত্যক্ত করছে। আমি এতে মনোবৈকল্যের দেখা পাচ্ছি। আমি যদি ভারত সরকারে থাকতাম তবে একধাপ পিছিয়ে সাম্প্রতিক সংকটজনক পরিস্থিতিতে প্রশ্ন তুলতাম, কীভাবে একটি টিভি চ্যানেল পোকায় খাওয়া, বাতিল ধারণাগুলো সামনে এনে উন্মত্ততায় বাতাস দিচ্ছে এবং আমাদের আন্তর্জাতিকভাবে অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। 'কাশ্মীর ইস্যু'কে আন্তর্জাতিক মাত্রা দেওয়ার নানা চেষ্টা হয়েছে অতীতে আর ভারত সরকারও একে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে।
এর পেছনে একটা কারণ হলো, আজমির বিস্ফোরণের দায় থেকে শীর্ষ আরএসএস নেতা ইন্দ্রেশ কুমারকে রেহাই দিতে বিজেপি মরিয়া হয়ে উঠেছে। তারা মানুষের মনোযোগ ঘুরিয়ে দিতে চায়। যারা খবর তৈরি করার জন্য মরিয়া সেসব মিডিয়ার জন্য এটা ছিল মোক্ষম সুযোগ। আর এরই নেতৃত্ব দিয়েছে টাইমস নাউ। আমার কখনও মনে হয়নি আমি রাষ্ট্রদ্রোহী। 'আজাদিই একমাত্র সমাধান' শিরোনামে আয়োজিত হলেও দিলি্লর সেমিনারে আমি বক্তব্য দিতে রাজি হয়েছিলাম। আমার মতে, যারা প্ররোচিত হতে চায় তাদের প্ররোচিত করার মতো শিরোনাম ছিল সেমিনারটির। কাশ্মীরে গত অর্ধশতাব্দী ধরে যা হচ্ছে তার বাস্তবতায় এই সেমিনার খুব বড় কিছু বলে আমার সত্যিই মনে হয়নি।
শ্রীনগরের সেমিনারের বিষয় ছিল 'কোন পথে কাশ্মীর : আজাদি না গোলামি'। এটা কাশ্মীরের তরুণদের জন্য আয়োজিত। তাদের মধ্যে এই তর্ককে জোরদার করার উদ্দেশ্যে যে, তারা আজাদি বলতে কী বোঝে আর আজাদির কাছ থেকে কী চায়। অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়ার কোনো ধ্বংসাত্মক আহ্বান নয় এটি, বরং উল্টোটাই। এটি ভাবনাচিন্তার, তর্ককে গভীরে নিয়ে যাওয়ার এবং অস্বস্তিকর প্রশ্ন তোলার একটি আয়োজন ছিল।
প্রশ্ন : আপনি সবসময়ই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে বিশ্বাসী। আপনি কেন সৈয়দ আলি শাহ গিলানি এবং বারাবারা রাওয়ের মতো লোকের সঙ্গে একই প্লাটফর্মে, একই দলে গেলেন। তারা তো খুবই গোঁড়া এবং নির্দিষ্ট রাজনৈতিক আদর্শ ধারণ করেন। যদি আপনি নাগরিক সমাজের কোনো মঞ্চ থেকে কথা বলতেন তবে হয়তো একজন লেখক বা চিন্তক হিসেবে আপনার বক্তব্য ভিন্নভাবে গৃহীত হতো।
উত্তর : এটা নাগরিক সমাজের প্লাটফর্মই ছিল! এটি এমনসব মানুষের প্লাটফর্ম যাদের কোনো কার্যালয় নেই, তাদের ভিন্নমতেরও নানা মাত্রা আছে। বারাবারা রাও ও গিলানির আদর্শ সম্পূর্ণ ভিন্ন বটে। এটাই বলে দেয়, এই প্লাটফর্ম নানা মতের মানুষের, যদিও তাদের মধ্যে কিছু ঐক্যও আছে। আমি আমার কথা বলেছি। যেভাবে তারা বলেছেন। আমি দাঁড়িয়ে গিয়ে বলিনি আমি হুরিয়াত (গিলানি) বা সিপিআই (মাওবাদী) হয়ে গেলাম। আমি তাই বলেছি, যা আমি ভাবি।
প্রশ্ন : স্পষ্টভাবেই গিলানি শুধু আজাদির পক্ষে বা ভারতবিরোধী নন, কথাবার্তায়ও শরিয়াপন্থি, জামাতপন্থি। কাশ্মীরী নেতৃত্বের অভ্যন্তরীণ কোন্দলেও তার ভূমিকা ধোঁয়াশাপূর্ণ। আপনি যদি কাশ্মীর প্রসঙ্গে আপনার মতামত ব্যক্ত করবেনই তবে তাদের সঙ্গে জড়ো হয়ে সেটি করলেন কেন? আপনি ভারত রাষ্ট্রের পক্ষ হয়ে তার সমালোচনা করলেন না কেন?
উত্তর : অনেক কাশ্মীরী গিলানির মতের সঙ্গে সহমত পোষণ করেন না এবং ভারত রাষ্ট্রের কাছে বিক্রি না হয়ে যাওয়ার কারণে তাকে শ্রদ্ধাও করেন। আমার কথা হলো, আমি তার অনেক কথার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করি। এ নিয়ে আমি লিখেছি। কথা বলার সময় বিষয়গুলো স্পষ্টও করেছি। আমি বাস করি এমন একটি রাষ্ট্রের প্রধান যদি তিনি হতেন আর তিনি যদি তার মত আমার ওপর চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করতেন, তবে আমার সাধ্যমতো সব উপায়ে আমি সেগুলো প্রতিরোধ করতাম।
কিন্তু ঘটনা হলো, তারা কাশ্মীরে আছেন। তাকে ভারত রাষ্ট্রের সঙ্গে তুলনা করা এবং উভয়কে সমানভাবে সমালোচনা করার যুক্তি হাস্যকর। এমনকি ভারত সরকার, এর সর্বদলীয় প্রতিনিধি সভা এবং নতুন 'মধ্যস্থতাকারীরা' পর্যন্ত জানেন কাশ্মীরে যা ঘটছে তাতে গিলানির বৃহৎ অংশীদারিত্ব আছে। এটাও সত্যি যে, তিনি কাশ্মীরী নেতৃত্বের সঙ্গে গৃহবিবাদে লিপ্ত। নব্বইয়ের দশকে সেখানে গোষ্ঠীগত হত্যাকাণ্ডের মতো ভয়াবহ সব ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোতে গিলানিকে জড়ানো হয়েছে। কিন্তু প্রতিরোধ আন্দোলনে অন্তর্কলহ নতুন কিছু নয়। এগুলো রাষ্ট্র সমর্থিত হত্যাকাণ্ডের সমান নয়। দক্ষিণ আফ্রিকায় আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস ও ব্ল্যাক কনসাসনেসের মধ্যে ভয়ঙ্কর লড়াই হয়েছিল। এতে স্টিভ বিকোসহ হাজারো মানুষ খুন হয়েছিলেন। এখন আপনি কি বলবেন, নেলসন ম্যান্ডেলার সঙ্গে একই মঞ্চে বসা অপরাধ?
সেমিনারে কথা বলে, লিখে, তিনি যা বলছেন তাকে প্রশ্ন করে গিলানি পরিবর্তনের সপক্ষে যুক্তি দিচ্ছেন। তিনি এখন যা বলছেন আর কয়েক বছর আগে যা বলেছেন তার মধ্যে তফাত আকাশ-পাতাল। আমি আপনার এই প্রশ্নে অবাক হচ্ছি। যখন রতন টাটা ও মুকেশ আম্বানি নরেন্দ্র মোদির কাছ থেকে প্রকাশ্যে গুজরাট গরিমা পুরস্কার নিলেন এবং তাকে আলিঙ্গন করলেন তখন ক'জন সেটা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে? সেটা তো কোনো সেমিনার ছিল না, ছিল কি? টাটা-আম্বানিরা নরেন্দ্র মোদিকে প্রশ্ন করেননি, নিজেদের ব্যক্তিগত মত প্রকাশ করেননি, মোদির সভাপতিত্বে যে গণহত্যা হয়েছিল তার সমালোচনা করেননি... তারা তাকে সমর্থন করেছেন। তারা বলেছিলেন, মোদির প্রধানমন্ত্রী হওয়া উচিত। সেটা সঠিক অবস্থান, তাই না?
প্রশ্ন : বারাবারা রাওয়ের ক্ষেত্রেও একই কথা। তারা সামাজিক ন্যায়বিচারের কথা বলছেন, ভারত রাষ্ট্র এখন যেখানে দাঁড়িয়ে তার সমালোচনা করছেন। এই অবস্থান সম্ভবত আপনার সঙ্গে যায় না। মাওবাদী আদর্শে পরিবর্তনের কেন্দ্রীয় উপায় অস্ত্র হাতে নেওয়া। আপনার কোনো লেখায় আপনি একে সমর্থন করেননি। কাশ্মীরের এমন একটি উচ্ছল সময়ে কেন আপনি বারাবারা রাও ও গিলানির সঙ্গে একই মঞ্চ শেয়ার করলেন?
উত্তর : আমি মাওবাদীদের নিয়ে বিশাল একটি প্রবন্ধে আমার মত জানিয়েছি, এখানে সেই মতকে একবাক্যে সংক্ষেপ করতে চাচ্ছি না। সব বিষয়ে একমত না হলেও আমি বারাবারা রাওকে প্রশংসা করি। কিন্তু আমি এই সংকটময় পরিস্থিতিতে মাওবাদীদের নিয়ে এবং কাশ্মীরে সংঘটিত ঘটনাবলি নিয়ে কথা বলার প্রয়োজন বোধ করি। কারণ এখন মিডিয়ার বড় একটি অংশ রক্তচোষা প্রচারযন্ত্রের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে, চেষ্টা করছে সবার মাথা থেকে শেষ বুদ্ধিবৃত্তিক ঘিলুটুকু বের করে নিতে। এটা তত্ত্বের বিষয় নয়, এটা মানুষের জীবন, নিরাপত্তা ও আত্মবোধের বিষয়। আগের কোনো সময়ই এটি এতটা সংকটাপন্ন ছিল না।
প্রশ্ন : আপনি কেন এমন একজন মানুষকে সমর্থন করছেন, যিনি কাশ্মীরকে ভারত থেকে আলাদা করে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত করতে চান?
উত্তর : যাকে আমি সমর্থন করছি বলে মনে হচ্ছে সেই লোকটি কে? গিলানি? আপনারা কি সিরিয়াসলি এই প্রশ্ন করছেন? আমি ভারত থেকে আলগা করে নিয়ে কাশ্মীরকে পাকিস্তানে জুড়ে দেওয়ার চিন্তা সমর্থন করেছি কোথায়, সেটি কি আপনারা আমাকে দেখাতে পারেন? গিলানি কি কাশ্মীরে একমাত্র লোক, যিনি কাশ্মীরের আজাদি চান? আমি কাশ্মীরের মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে সমর্থন করি। এটা গিলানিকে সমর্থন করা থেকে ভিন্ন ব্যাপার।
প্রশ্ন : 'কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ নয়। এটা ঐতিহাসিক সত্য।' এই মন্তব্য থেকেই মূলত তর্ক উঠেছে। কেন এ কথা বললেন?
উত্তর : ইতিহাস তো সর্বজনবিদিত। আমি মানুষকে ইতিহাস বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা দিতে চাই না। কিন্তু কাশ্মীরের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি কি এর অস্পষ্ট ইতিহাসের কারণে তৈরি হয়নি? ভারতীয় সরকার সেখানে ৭ লাখ সৈন্য কেন রেখেছে? মধ্যস্থতাকারীদের ভাষায়, 'তারা কি সেখানে আজাদির রোডম্যাপ তৈরি করছে?' নাকি এলাকাটাকে 'বিবাদপূর্ণ' হিসেবে আখ্যায়িত করছে? আমরা যখন কাশ্মীরের রাস্তার বাস্তবতাকে প্রত্যক্ষ করি তখন কেন চোখ ছোট করে ফেলি?

ভাষান্তর : মাহবুব মোর্শেদ

No comments:

Post a Comment