Saturday, November 13, 2010

কাশ্মীর :: আজাদি, অরুন্ধতী রায় ও সৈয়দ আলী শাহ গিলানি


কাশ্মীর আবার তর্কের কেন্দ্রে। বর্ণনায় একটু ভুল হলো, তর্কের কেন্দ্রে এবার শুধু কাশ্মীর নয়, অরুন্ধতী রায়ও। ১৯৪৭ থেকে কাশ্মীর নিয়ে তর্ক-বিতর্ক, যুদ্ধ-বিবাদ সবই চলছে সমানে। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার অন্যতম অমীমাংসিত ইস্যু এটি। তারা কাশ্মীরের দুটি অংশ নিয়ন্ত্রণ করে, নিজেদের মতো করে কাশ্মীর নিয়ে মত ব্যক্ত করে। দুটি দেশের মিডিয়া, মধ্যবিত্ত সমাজের বড় অংশ, রাজনীতিক ও ক্ষমতার কেন্দ্রগুলো কাশ্মীর প্রসঙ্গে চলতি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে তৃপ্ত। ফলে, ভারতীয় ও পাকিস্তানি এ দুই উচ্চকণ্ঠ মতকে ছাপিয়ে সাধারণ কাশ্মীরিদের কণ্ঠস্বর শোনা যায়নি অনেক দিন। কিন্তু সম্প্রতি কাশ্মীরিদের কিছু কিছু কথা কানে আসছে। তারা বলছেন, কাশ্মীরের ভাগ্য নির্ধারণ করার অধিকার সেখানকার জনগণের। প্রশ্ন তুলছেন, ভারত বা পাকিস্তানের শাসকরা কেন তাদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করবে? যুদ্ধের বদলে জনমতের ভিত্তিতে কেন কাশ্মীরের ভাগ্য নির্ধারিত হবে না? কাশ্মীরিদের কণ্ঠস্বর যখন মৃদুস্বরে ধ্বনিত হচ্ছিল, তখন ভেতরে-বাইরে পরিস্থিতির মৌলিক কিছু পরিবর্তনও ঘটছিল। সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ সে সময় পাকিস্তানের ঘরের ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। একদা \'জিহাদ\' ও \'জঙ্গিবাদের\' প্রশ্রয়দাতা হিসেবে অভিযুক্ত দেশটি স্বয়ং ন্যাটো বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে জঙ্গিবাদ দমনে ব্যস্ত। তার মনোযোগ আর কাশ্মীরে কেন্দ্রীভূত নয়, আফগান সীমান্তের দিকে, নিজের সীমান্ত প্রদেশে। নানা সমস্যায় জর্জরিত পাকিস্তানের মনোযোগ সরে গেলে ক্রমে কাশ্মীরের নিজস্ব কণ্ঠস্বর শক্তি পেতে থাকে। আত্মঘাতী হামলা, প্রশিক্ষিত জঙ্গি ও জিহাদের স্বপ্নে বিভোর মোল্লাদের বদলে রাস্তায় নামতে থাকে সাধারণ মানুষ। বন্দুক-বোমার বদলে তরুণরা হাতে তুলে নেয় ইট-পাটকেল। নতুন পরিস্থিতি তৈরি হয় সেখানে। এই তরুণদের ওপর থেকে জঙ্গিবাদের ছায়া অনেকটাই অপসৃত। ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে এরাই নতুন পরিস্থিতি তৈরি করে। গণতান্ত্রিক ভারত নতুন সংকটের মুখে পড়ে। ২০০৮ সালে কাশ্মীরী তরুণরা যে বিশাল প্রতিবাদ সংগঠিত করেছিল তা বিস্মিত করে দেয় অনেককে। ভারতীয় বুদ্ধিজীবীরা ধীরে ধীরে কথা বলতে শুরু করেন। অরুন্ধতী রায় বলেন, কাশ্মীর থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করতে হবে। বছর দুয়েক আগে দেওয়া এই বক্তব্য অনেককে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল। শুধু সৈন্য প্রত্যাহারের দাবিই নয়, সেখানকার নাগরিক আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি বিচার-বিশ্লেষণ করছিলেন তিনি। কাশ্মীরের মানবাধিকার পরিস্থিতিও ছিল তার পর্যবেক্ষণের কেন্দ্রে। আর এ কথা অরুন্ধতীর শত্রুও স্বীকার করেন যে, এসব ক্ষেত্রে তার দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত স্বচ্ছ, স্পষ্ট ও স্বাধীন_ কারও স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য তিনি কথা বলেন না। অরুন্ধতী ১৯৯৭ সালে ম্যান বুকার পুরস্কার পেয়েছিলেন। এ পুরস্কার তার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল বিশ্বের। তাকে নিয়ে সাহিত্যজগতে বড় প্রত্যাশাও তৈরি হয়েছিল। কিন্তু তিনি সাহিত্য নয়, সক্রিয়তা দিয়ে নিজের মনোযোগ ঘুরিয়ে দিয়েছেন। অর্জন করেছেন অ্যাক্টিভিস্ট পরিচয়।
এই অরুন্ধতী গত ২৪ অক্টোবর কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগরে অনুষ্ঠিত একটি সেমিনারে বলেন, \'কাশ্মীর কখনই ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল না।\' আলোচনার বিষয় ছিল_ \'কোন পথে কাশ্মীর : দাসত্ব নাকি আজাদি?\' সভায় কাশ্মীরের চলমান অস্থিরতা বিষয়ে বলতে গিয়ে অরুন্ধতী ঔপনিবেশিক শক্তি হয়ে ওঠার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছেন ভারতকে। তার এ বক্তব্য ঝড় তোলে। তাৎক্ষণিকভাবে পত্রপত্রিকায় এ নিয়ে বিস্তর লেখালেখি চলতে থাকে। কংগ্রেস ও বিজেপি_ ভারতের দুই প্রধান দল বক্তব্য প্রত্যাহার দাবি করে। বিজেপি দাবি তোলে, অরুন্ধতীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে মামলা করা হোক। মামলার কথা জোরেশোরে আলোচিত হচ্ছিল। কিন্তু ক্রমে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, অরুন্ধতীর বিরুদ্ধে মামলা করার ইচ্ছা ভারত সরকারের নেই। এটি করে ভারতীয় সরকার যথেষ্ট প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছে। প্রথমত, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে ভারত চরম ভিন্নমতও সমালোচনা সহকারে গ্রহণ করতে পারে, এমন একটি ধারণা জনমনে তৈরি হয়েছে। দ্বিতীয়ত, অরুন্ধতীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা বা গ্রেফতার পরিচালনা করলে তিনি আন্তর্জাতিক মিডিয়ার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতেন এবং বুদ্ধিজীবী ও মিডিয়ার সমর্থন তার দিকে যেত। মামলা না করায় বিরুদ্ধ-মতের বুদ্ধিজীবী কলামিস্টরা অরুন্ধতীকে ধুয়ে দিতে পারছেন। অবশ্য ভারত সরকারের মধ্যেও একটি অংশ মনে করে, কাশ্মীরকে \'আজাদি\' দেওয়া যায়। হয়তো সেটা সীমিত, কিন্তু তার নাম আজাদিই।
অরুন্ধতীর বক্তব্যের পর সবচেয়ে মজার প্রশ্ন তুলেছেন কাশ্মীরের অ্যাক্টিভিস্ট ড. সাবির চৌধুরী। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, \'পাকিস্তানের মধ্যে কি সত্য কথা বলার মতো একজন অরুন্ধতী তৈরি করা সম্ভব?\' ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, সেখানে সেনাশাসন চলছে_ সবই হয়তো সত্য। কিন্তু কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানের নীতিও তো ভ্রান্ত। সেখানে তারাও সেনাশাসন চালাচ্ছে, মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। কিন্তু পাকিস্তানে কি এমন একজন লেখক, বুদ্ধিজীবী আছেন যিনি পাকিস্তানের কাশ্মীর-নীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন? সাবির চৌধুরীর প্রশ্নের উত্তরে না-ই বলতে হবে।
পাকিস্তানে হয়তো তেমন বুদ্ধিজীবী থাকতেও পারেন। কিন্তু কাশ্মীর নিয়ে বলার পর তাকে দেশে থাকতে দেওয়া হবে, গ্রেফতার করা হবে না_ এমন ভাবা কঠিন।
মামলা না হলেও অরুন্ধতীকে অবশ্য নানা সমস্যা মোকাবেলা করতে হচ্ছে। বিজেপির মহিলা সংগঠনের কর্মীরা তার বাড়িতে হামলা চালিয়েছে। ভারতের বিভিন্ন মিডিয়া তার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করছে। অনেকে বলছেন, অরুন্ধতী কাশ্মীর নয়, নিজেকে নিয়ে বিতর্ক চান। তিনি জঙ্গিবাদীদের দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়েছেন। তিনি সৈয়দ আলী শাহ গিলানির মতো প্রতিক্রিয়াশীল মুসলিমদের দলে ভিড়ে গেছেন। শ্রীনগরের সেমিনারে সৈয়দ আলী শাহ গিলানি উপস্থিত ছিলেন, বক্তব্য দিয়েছেন; ছিলেন আয়োজকদের একজন। ধারণা করা হচ্ছিল, তার বিরুদ্ধেও রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করা হতে পারে। তিনি স্বাধীন কাশ্মীর আন্দোলনের নেতা। সম্প্রতি তার একটি সাক্ষাৎকার ছেপেছে ইন্ডিয়া টুডে। তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, রাষ্ট্রদ্রোহের মামলার বিষয়ে কী ভাবছেন? তিনি বলেন, \'আমার বিরুদ্ধে ৯০টি এফআইআর আছে। ৯১টা হলে কিছু যায়-আসে না। ২১ অক্টোবর দিলি্লতে আমি যা বলেছি, শ্রীনগরেও সেই একই কথা বলেছি। এটাই কঠিন বাস্তবতা। জম্মু ও কাশ্মীর বিতর্কিত এলাকা। এটি ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ নয়। ১৯৪৭ সালের ২৭ অক্টোবর ভারত এটি দখল করে নিয়েছে।\' গিলানি চান স্বাধীন কাশ্মীর হবে আদর্শ ইসলামী রাষ্ট্র। তাকে প্রশ্ন করা হলো, স্বাধীন কাশ্মীরে কি আপনি অরুন্ধতীকে নেবেন? তিনি উত্তর দেন, যদি তিনি চান তবে কেন নেব না? অবুঝ লোকেও বোঝে, সৈয়দ আলী শাহ গিলানি আর অরুন্ধতী রায়ের মতের মধ্যে তফাত বিস্তর। তেহেলকা পত্রিকার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে অরুন্ধতী বলেছেন, তারা যার যার জায়গা থেকে কথা বলেছেন, এখানে দলে ভেড়ার কোনো ব্যাপার নেই।
এখন কেউ যদি বলেন, অরুন্ধতী কাশ্মীরকে স্বাধীন ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করছেন, সেটি ভুল হবে। তিনি মূলত মানবাধিকার নিয়েই চিন্তিত। আদর্শ মুসলিম রাষ্ট্র অনেক দূরের যুক্তি। সে যুক্তি দিয়ে তর্কে জেতা যায়, কিন্তু এখনকার দগদগে বাস্তবতা তাতে ফিকে হয় না।

মাহবুব মোর্শেদ : সাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mahbubmorshed@ymail.com

No comments:

Post a Comment