
১৪ নভেম্বর। হরতালের পর সন্ধ্যা। রাস্তাঘাটে গাড়ি অল্প। পথচলতি মানুষও কম। ভিড়ভাট্টা নেই বলে বাসে ওঠা গেল সহজে। বসার মতো আসনও মিলে গেল। দেখলাম, বাসযাত্রীরা বেশ বৈঠকি মুডে আছেন। বাসযাত্রীদের বৈঠকি মুড মানেই রাজনীতি নিয়ে তপ্ত কথা। শুরু করলেন একজন। সঙ্গে সঙ্গে তাতে সায় দিলেন কয়েকজন। বিরোধিতার জন্য অনেকে এক পায়ে খাড়া। বোঝা গেল, যাত্রীরা বেশ তেতে আছেন। মওকা পেয়ে নিজের মনোভাব জানিয়ে দেওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করতে চান না কেউই। মুহূর্তের মধ্যেই বেশ সরগরম হয়ে উঠল পুরো বাস।
প্রথম বক্তা হরতালের ভুক্তভোগী। ঈদে গ্রামে ফেরার কথা ছিল। ফিরতে পারেননি। আপাতত বাড়ি ফেরার আশা ছেড়ে ঢাকায় ঈদ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। তার মত_ বাড়ি একটা ব্যক্তিগত ব্যাপার। দেশের আইন-আদালতে বিষয়টার সুরাহা হবে। লড়াই হবে আদালতে। এ নিয়ে রাজনীতি করার স্কোপ নেই। হরতাল ডাকার তো প্রশ্নই ওঠে না। ঈদের আগে এমন সময় হরতাল ডেকে বিএনপি মানুষের সিমপ্যাথি হারাল।
কথা শেষ হওয়ার আগেই তাকে চেপে ধরলেন একজন। খানিকটা রুষ্ট কণ্ঠে। বললেন, আপনাদেরই-বা কেমন নীতি? ঈদের আগে বাড়ি ছাড়াতে বাধ্য করলেন, তাও এক কাপড়ে? প্রথমজন বললেন, ভাই \'আপনাদের\' মানে কী? আমি তো কোনো দলের লোক না। তিনি হয়তো দলের লোক না। কিন্তু আরেকজন বাসের পেছনের সিট থেকে বলে উঠলেন, ঈদের আগে-পরে তো ব্যাপার না ভাই। অবৈধ বাড়ি থেকে তাকে চলে যেতে হতোই। ৪০ বছর ধরে তিনি যে বাড়িটা দখল করে রেখেছিলেন সেইটাই তো বড় ভুল ছিল। বাড়িটা আগেই ছাড়লে তিনি ভালো করতেন। এই বাড়ি দখলমুক্ত করে এতদিনে একটা কাজের কাজ করল সরকার।
বিএনপির পক্ষে আরেকজন এইবার গলা চড়িয়ে বললেন, বাড়ি অবৈধ হবে কেন? বাড়ি তো এই দেশের সরকারেরই দেওয়া। আর সুপ্রিম কোর্টে তো মামলার সুরাহা হয় নাই। এবার আওয়ামী পক্ষের একজন বললেন, আপনারা তো কথায় কথায় স্বৈরাচার বলেন। এখন স্বৈরাচারের দেওয়া বাড়িতে থাকতে সমস্যা হয় না? স্বৈরাচারের কথায় বৈঠকে নতুন এক তাত্তি্বকের আগমন ঘটল। তিনি বললেন, আসলে এখনও এরশাদই সবকিছুর কলকাঠি নাড়ছেন। কেমনে? খালেদা জিয়াকে বাড়ি দিয়ে তিনি আগেই সমস্যা তৈরি করে রেখেছিলেন। এখন বসে বসে দুই দলের বিবাদ দেখছেন আর মজা পাচ্ছেন। এরশাদবিরোধী একজন দেখা দিলেন সঙ্গে সঙ্গে। বললেন, এরশাদ আসলে এখন আর ফ্যাক্টর না। রাজনীতিতে তার বলার কিছু নাই, দেখারও খুব বেশি কিছু আছে বলে মনে হয় না।
কথা চলছে কখনও উঁচু, কখনও নিচু লয়ে। আলাপ উত্তপ্ত হয়ে উঠলে রেফারির মতো একেকজন গলা চড়িয়ে বলছেন, আমরা সাধারণ মানুষ। এসব নিয়ে বিবাদে জড়িয়ে আমাদের কাজ কী? রেফারিদের কথায় কাজ হচ্ছিল। পরক্ষণেই আবার তাপ বাড়ছিল। বাসের আলাপ শুনে মনে হচ্ছিল, রাজনীতি দেশের মানুষের ভাগ্যের নির্ধারক বিষয় না শুধু। মানুষের বিনোদনেরও অন্যতম উৎস বটে। রাজনীতি নিয়ে মুখরোচক আলোচনা করে মানুষ তৃপ্ত হয়। বিতর্কে জড়িয়ে নিজের মতের শক্তি পরীক্ষা করে। পত্রপত্রিকায়, টিভিতে রাজনীতি নিয়ে টক শো গোগ্রাসে গেলে। ক্ষমতাবানদের নিয়ে কথা বলতে পছন্দ করে। ক্ষমতার উত্থান-পতন নিয়ে ভাবে। কখনও এ-পক্ষ, কখন ও-পক্ষ এবং শেষ পর্যন্ত একা একা শুধু আত্মপক্ষ। তখন হয়তো তার অতিপ্রয়োজনীয় চালের দাম বাড়তির দিকে, পকেটে টান পড়েছে, বাসার বিদ্যুৎ ফুড়ূৎ ফুড়ূৎ করছে। কিন্তু এসবের সঙ্গে রাজনীতির যোগ নিয়ে আলোচনা জমে না। জমে খালেদা জিয়ার বাড়ি নিয়েই। আর এ নিয়ে মানুষের নখদর্পণে এত তথ্য, এত উপাত্ত আর এত যুক্তি যে ভাবতে ভালোই লাগে, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর অনেকেই বলছিলেন, রাজনীতির পুরনো ধারা আর চলবে না। বাঙালি না বাংলাদেশির মতো সস্তা তর্কে আর মানুষের মন ভিজবে না। দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি-দলপ্রীতি আর ফিরতে পারবে না। সংসদে বসে সবকিছুর সমাধান হবে। সহিংসতা-সংঘাতের দিন শেষ। সরকার যখন খালেদা জিয়ার বাড়ির বরাদ্দ বাতিল করল আর বিরোধী দল যখন বিষয়টি শক্তভাবে মোকাবেলা করার হুমকি দিল, তখনও এসব আশাবাদ থিতু হয়ে যায়নি। অনেকেই বলছিলেন, একটা বাড়ি কি আর রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু হতে পারে? বাড়ি ইস্যু নিয়ে বিএনপি আর কত দূর যাবে? খালেদা জিয়ার বাড়ি নিয়ে মানুষ রাস্তায় নামবে কেন? এসব কথার ফাঁকে ফাঁকে রাজনীতি ফিরছিল পুরনো খাতে। ফিরতে ফিরতে দু\'বছরের মাথায় এসে দেখা গেল_ ঠিকই, একটা বাড়িই রাজনীতির কেন্দ্র হতে পারে। সরকার ও বিরোধী দল মিলে যদি চেষ্টা করে তবে একটা বাড়ি কেন, একটা ইটও রাজনীতির কেন্দ্রে চলে আসতে পারে। সে নিয়ে জনগণ দু\'ভাগে বিভক্ত হতে পারে। বিবাদে জড়িয়ে রক্তও ঝরাতে পারে। আমাদের জনগণেরই-বা দোষ কী? যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ যদি বারাক ওবামার বিরুদ্ধে অপপ্রচারে বিশ্বাস করে আর ভোটে তার প্রভাব পড়ে তবে আমরা আর কতটুকু এগিয়ে থাকব? ভাবতে পারেন, যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপকসংখ্যক মানুষ বিশ্বাস করে, বারাক ওবামা মুসলিম এবং কমিউনিস্ট?
মোটাদাগে হিসাব করলে, আমাদের দেশে তিন ধরনের রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন মানুষের দেখা পাওয়া যায়। প্রথম ও দ্বিতীয় দলের কথা আগে বললাম। এইবার তৃতীয় দলের কথা। তারা মনে করেন, রাজনীতিতে যা হচ্ছে তার কোনোটাই ঠিক হচ্ছে না। ভুল সবই ভুল, এ জীবনের পাতায় পাতায় ভুল। খালেদা জিয়ার বাড়ি নিয়ে তাদের মন্তব্য কী তা নিয়ে স্বাভাবিক একটা কৌতূহল আছে মানুষের মধ্যে। এখন দেখা যাক তারা কী মনে করেন। তারা মনে করেন, এরশাদ যে সেনানিবাসের মইনুল রোডের মতো জায়গার একটা বাড়ি খালেদা জিয়াকে দিয়েছেন সেটা ঠিক করেননি। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, বাড়ি ভেট দিয়ে খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে বিরত রাখবেন। এই ভাবনা ছিল ভুল। আবার সেনানিবাসের বাড়িতে থেকে রাজনীতিতে জড়ানো ছিল খালেদা জিয়ার ভুল। তার উচিত ছিল, রাজনীতি শুরু করার পর বাড়ি ছেড়ে দেওয়া। বাড়ি তিনি না ছাড়লেও তার মনে রাখা উচিত ছিল, এ বাড়ি কারো স্থায়ী সম্পদ হতে পারে না। ফলে তিনি যে বিকল্প কোনো আবাসে নিজেকে মানিয়ে নেননি সেটা ছিল তার ভুল। আবার মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসে খালেদা জিয়ার বাড়ির বরাদ্দ বাতিল করার যে প্রক্রিয়া শুরু করেছে তা ছিল একটা ভুল। এ সিদ্ধান্ত রাজনীতিতে সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি করেছে। সরকারের সিদ্ধান্তের পর খালেদা জিয়া বাড়ি না ছেড়ে একগুঁয়ে মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। এতে রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। বাড়ির বিবাদ আদালতে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল ভুল। কারণ, এতে আলাপ-আলোচনা ও সমঝোতার পথ বন্ধ হয়েছে। খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের উচিত ছিল হাইকোর্টের রায় \'স্টে\' করার আবেদন করে আপিলের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত জানতে চাওয়া। সেটি তারা করেননি, সেটাও ছিল ভুল। আবার আদালতের চূড়ান্ত রায়ের আগে সরকার পক্ষ খালেদা জিয়াকে বাড়ি থেকে বের করার যে উদ্যোগ নিয়েছে তাও ছিল ভুল। সরকারের চাপ সত্ত্বেও খালেদা জিয়া যে বাড়ির দখল রাখতে মরিয়া হয়েছিলেন সেটা ছিল ভুল। আবার সরকার যে বেশ জোরজবরদস্তি করেছে সেটাও ছিল ভুল। বাড়ি থেকে উচ্ছেদ হওয়ার পর সংবাদ সম্মেলনে অশ্রুসিক্ত হয়ে খালেদা জিয়া দুর্বল মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। বিরোধীদলীয় নেত্রীর অশ্রুপাত ও সাজপোশাক নিয়ে মন্তব্য করে সরকারের নেতা-নেত্রীরাও শুভবোধের পরিচয় দেননি। বাড়ি থেকে উচ্ছেদ হয়ে ঈদের আগে হরতাল ডেকে বিএনপি ঠিক করেনি। সরকারও ঈদের আগে খালেদা জিয়াকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে ঠিক করেনি। মোটকথা, যা হয়েছে সবই ভুল, যা হচ্ছে, যা হতে পারে তাও।
অবশ্য ভুলবাদী লোকেরা কী চায়, সেটি বোঝা বড় শক্ত। কারণ, রাজনীতিতে এদের স্পষ্ট ও স্থায়ী কোনো চেহারা নেই। এরা কখনও তৃতীয় পক্ষ, কখনও মধ্যপক্ষ, কখনও কোনো পক্ষই না, স্রেফ সাধারণ নাগরিক।
এদের একদল হৃদয় খুঁজে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে না। তারা চায়, যেমন আছি তেমন রবো। মিলমিশের রাজনীতি চলুক। সংসদে বিতর্ক হোক। হরতাল-সংঘাত না থাকুক। নেতা-নেত্রীদের কথাবার্তা হোক।
আরেক দল চায়, রাজনীতিতে পরিবর্তন আসুক। রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে নাগরিকদের সামনে যথার্থ কর্মসূচি উত্থাপন করা হোক। দেশ ও জাতি একটা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাক। যে বিষয়গুলো রাজনীতির প্রকৃত ইস্যু নয়, সেগুলোকে ইস্যু বানানোর প্রক্রিয়াটা আর না চলুক। এটা হোক বর্তমান রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়েই।
আরেক অংশ মনে করেন, রাজনীতির পুরনো চর্চা আর চলবে না। বিদ্যমান রাজনৈতিক দল, নেতৃত্ব এমনকি তাদের কর্মসূচিও চলবে না। দেশ চালাবে উচ্চশিক্ষিত, অবসরপ্রাপ্ত লোকেরা। পারলে অগণতান্ত্রিক পথে, অনির্বাচিত সরকার গঠন করেই।
বলাবাহুল্য, দুই বছরের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনের পর দেশে তৃতীয় পক্ষের বক্তব্যের পসার এখন ভালো না। তাদের কথা ভালো কি মন্দ সেটা পরের কথা। কাটতি ভালো না এটাই বাস্তবতা। তৃতীয় পন্থার বিগত সমাধান দেখে মানুষ কিছুটা হতাশ। নতুন করে আশা ফিরতে সময় লাগবে। ফলে আপাতত পুরনো ধারার নাটকের দর্শক হওয়ার বিকল্প কী?
এসব নাটকের ফাঁকে ফাঁকে একটা বিষয় কিন্তু অনেকেরই চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে। রাজনীতিতে হিংসা-প্রতিহিংসা, ভুল-শুদ্ধ, অগ্রগতি-পশ্চাৎগতি সবই আছে, থাকবেও। খোলা চোখে যত অমানবিক মনে হোক, খালেদা জিয়ার সেনানিবাস ছাড়ার ঘটনা শেষ পর্যন্ত আমাদের রাজনীতিতে একটা অগ্রগতিই। ওয়ান-ইলেভেনের আগে-পরে রাজনীতির সঙ্গে সেনাবাহিনীর সম্পর্ক নিয়ে প্রচুর কথা হয়েছে। দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর সদস্যরা তো বটেই, শুভবোধসম্পন্ন প্রতিটি মানুষ মনে করে, গণতন্ত্রই শেষ কথা; রাজনীতিতে সশস্ত্র বাহিনীর জড়ানো ঠিক নয়। এই বাস্তবতায় একজন রাজনীতিকের সেনানিবাস ছাড়ার ঘটনা তাৎপর্যপূর্ণ। খালেদা জিয়া বাড়ি থেকে বের হতে বাধ্য হলেন বটে। কিন্তু এর মাধ্যমে সেনানিবাসের সঙ্গে রাজনীতির একটি যোগাযোগ ছিন্ন করল। আরও গ্রহণযোগ্য হতো, যদি এই প্রক্রিয়া শুধু আদালতের রায়ের মাধ্যমে সম্পন্ন হতো।
বিএনপির উচিত এখন মানুষের শক্তির দিকে দৃষ্টি দেওয়া, সাধারণের সমস্যা নিয়ে রাজনীতি করা। সেনানিবাসের বাড়ির স্মৃতি নিশ্চয়ই একজন শীর্ষস্থানীয় নেত্রীকেও অশ্রুসিক্ত করতে পারে। কিন্তু মানুষ নেতা-নেত্রীদের অশ্রুপাত দেখতে চায় না। তারা বরং নেতা-নেত্রীদের ত্যাগ-তিতিক্ষা ও সংগ্রামের কথা মনে করেই অশ্রুপাত করতে চায়। খালেদা জিয়ার উচিত, পুরনো বাড়ির শোক দ্রুত কাটিয়ে উঠে নতুন একটি বাড়ি তৈরি করা। আর নাগরিকদের উচিত খেয়াল রাখা, যাতে স্থায়ী বা অস্থায়ী, বাস্তব বা অবাস্তব কোনো রাজনৈতিক বাড়ি যেন সেনানিবাসে আর তৈরি না হয়।
মাহবুব মোর্শেদ : সাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mahbubmorshed@ymail.com