Tuesday, August 24, 2010

রূপা


আজ নিউ ইয়র্ক বা লন্ডনে যে নতুন বইটি ছাপা হলো, কাল তা বাংলাদেশে মিলতে পারে। মিলবে কি-না তা নির্ভর করে পাঠকের চাহিদা আর পাঠক রুচি সম্পর্কে বই বিক্রেতা এবং সরবরাহকারীদের ধারণার ওপর। সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, প্রয়োজনীয় বইগুলো সচরাচর না মিললেও জনপ্রিয় বইগুলো ঠিকই মিলে যায়। শুধু মেলে বললে ভুল হবে, যে বই ভালো বিকোয় তা রাতারাতি পাইরেটেড হয়ে হকারদের হাতে ফেরি হতে থাকে। ঢাকার বিখ্যাত জ্যামে আটকে পড়ে থাকা মানুষকে এ বইগুলো যে বেশ আকৃষ্ট করে তা বেশ বোঝা যায়। দুর্বল মলাটে, দুর্বল ছাপায় কম দামের এ বইগুলো লোকে কেনে এবং দুধের স্বাদ ঘোলে মেটায়। এ ছাড়া উপায়ও হয়তো পাঠকের সামনে নেই। র‌্যানডম হাউস থেকে প্রকাশিত অরুন্ধতী রায়ের একটি বইয়ের দাম হয়তো ৭০০ থেকে এক হাজার টাকা। কিনতে হলে জ্যাম উজিয়ে দোকানে যেতে কত সমস্যা গুনতে হয় তার ইয়ত্তা নেই। ঢাকার রাস্তায় সেখানে ২০০ টাকায় ওই বই হকার একেবারে চোখের সামনে নিয়ে দোলাচ্ছে। পাইরেসি বিষয়ে অতি সচেতন ব্যক্তিও লোভ সামলাতে হিমশিম খাবেন। সমস্যা শুধু প্রাপ্যতায় নয়, দামেও। ইউরোপ-আমেরিকায় যে বই যে দামে বিক্রি হয়, সে বই সে দামে বাংলাদেশের পাঠকরা কিনতে চাইবেন না, সেটিই স্বাভাবিক। কিন্তু বাংলাদেশের মতো ছোট বাজারের হিসাব বড় প্রকাশকদের মাথায় থাকে না। ফলে বিকল্প হয় পাইরেসি, নয়তো বেশি দাম। এজন্যই রূপা। ভারতীয় প্রকাশনা সংস্থা রূপার ইংরেজি বই বেশ জনপ্রিয় ছিল এক সময়, এখনও আছে। দেখা যেত, বিখ্যাত, প্রয়োজনীয় ও জনপ্রিয় ইংরেজি বইগুলোর ভারতীয় সংস্করণ প্রকাশ করত রূপা। সে বই বাংলাদেশেও সুলভে বাজারজাত হতো। বাইরের বই প্রকাশে রূপা এখন তত তৎপর নয়, কিন্তু ভারতীয় বইগুলো সুলভে বাজারে আনার ক্ষেত্রে রূপা এখনও অদ্বিতীয়। যশোবন্ত সিংয়ের 'জিন্নাহ : ইন্ডিয়া-পার্টিশন-ইন্ডিপেন্ডেন্স' বইটির সহজলভ্যতা রূপার সেই ক্যারিশমার কথা মনে করিয়ে দিল সম্প্রতি। বাংলাদেশে পাঠকদের মধ্যে ইংরেজি বইয়ের চাহিদা আছে; কিন্তু প্রকাশক হাতেগোনা। আর সে প্রকাশকরা বেশি পাঠকের কাছে যাওয়ার পথে বাধা নিজেরাই বানিয়ে রাখেন অধিকাংশ সময়। দাম দেখে বোঝা যায় রূপার পথে যাত্রা করতে কেউ প্রস্তুত নন। অথচ রূপার স্বত্বাধিকারী বলেন, এখনও তাদের বইয়ের দাম ৫০ রুপি থেকে শুরু হয়। তাই অন্যদের প্রকাশ করা ইংরেজি বই যেখানে ৪-৫ হাজার কপি চলে, সেখানে রূপার বই ১ মিলিয়ন সহজেই বিক্রি হয়ে যায়।
রূপা এই আগস্টেই ৭৫ বছর পূর্ণ করতে চলেছে। বাংলাদেশের পাঠকরা জেনে খুশি হবেন, ভারত-বিখ্যাত এ প্রকাশনা সংস্থার শুরুতে বাঙালির বেশ যোগ ছিল। রূপার কর্ণধার দাউদয়াল মেহরার হোসিয়ারির দোকান ছিল কলকাতা নিউমার্কেটে। সেই দোকানের সাফল্য দেখে কলিন্স ডিকশনারির এজেন্ট তাকে ডিকশনারি বিক্রির জন্য হাত করেন। ডিকশনারি বেচতে বেচতেই তিনি ঢুকে যান বই-বাণিজ্যে। কলেজ স্ট্রিটে একটি দোকান নেন। সে দোকানের প্রথম ক্রেতা ফরিদপুরের সন্তান হুমায়ুন কবীর, ভারতের সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ও সাহিত্যিক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রূপা কলকাতা থেকে ব্যবসা গুটিয়ে এলাহাবাদ-বোম্বে হয়ে দিলি্লতে গিয়ে আখড়া গাড়ে। যুদ্ধের ভয়ে তখন অনেকেই ব্যবসা গুটিয়েছিলেন। ১৯৬০ সালে প্রকাশক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে রূপা। প্রথম দিকে বাংলা কবিতার বই করত। আর রূপার প্রথম বেস্ট সেলার হারমান হেসের 'সিদ্ধার্থ'। রূপার আত্মপ্রকাশের সঙ্গে আছে সত্যজিৎ রায়ের যোগ। বিখ্যাত এ শিল্পী ও চলচ্চিত্রকার তৈরি করে দিয়েছিলেন রূপার লোগো। এখনও এই লোগো ব্যবহার করে রূপা। রূপার কর্ণধার কপিশ মেহরা জানান, সত্যজিৎ এ কাজ করে সম্মানী বাবদ কিছু ভালো বই নিয়েছিলেন।
বোঝাই যাচ্ছে, রূপার দীর্ঘ ঐতিহ্য আছে, বাণিজ্য সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা আছে। সঙ্গে আছে পাঠক সম্পর্কেও স্পষ্ট ধারণা। কপিশ মেহরা বলেন, 'পাঠক বই পড়ূক_ এভাবে আমরা বলি না, পাঠক যে বই পড়ে সে বই-ই আমরা প্রকাশ করি।' বইকে জনপ্রিয় করার জন্য ভারতজুড়ে ছোট-বড় বই মেলার আয়োজন করেন তারা। আর লেখকদের নিয়মিত সম্মানী দেন, প্রতি বছর লেখকদের জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থাও করেন।
আমাদের দেশে রূপা হয়নি, তামা, পিতল, কাঁসা যদি কিছু হতো তাহলেও গর্ব করা যেত।

No comments:

Post a Comment