বালাসাহেব কেশব ঠাকরে তার পুরো নাম হলেও গণমাধ্যমে তিনি বাল ঠাকরে নামেই
পরিচিত। শিবসেনার প্রতিষ্ঠাতা ভারতীয় এই রাজনীতিকের মৃত্যু হলো ১৭ নভেম্বর।
ভারতীয় গণমাধ্যমে তার মৃত্যুর খবর শুধু গুরুত্ব সহকারে নয়, রীতিমতো
আনুষ্ঠানিকতা ও শ্রদ্ধার সঙ্গেই পরিবেশিত হচ্ছে। শিবসেনা ও বাল ঠাকরে
সম্পর্কে যাদের ধারণা নেতিবাচক, তাদের কাছে ভারতীয় মিডিয়ার এই কভারেজ
কিছুটা প্রশ্নের উদ্রেক করছে বটে। কিন্তু একই সঙ্গে মিডিয়া কেন; মতবাদ
নির্বিশেষে গণমাধ্যমগুলো ধর্মীয় রাজনীতির এমন একজন নেতার প্রস্থানে
সম্মিলিত শ্রদ্ধাঞ্জলি ও শোক জ্ঞাপন করছে_ তা বোঝাও জরুরি। অনুসারীদের কাছে
বাল ঠাকুরে 'হিন্দুদের হৃদয়সম্রাট' নামে আখ্যায়িত। ধর্মীয় রাজনীতিতে
দীর্ঘকালীন নেতৃত্বদানের স্বীকৃতি হিসেবে এমন আখ্যা তার প্রাপ্য। পুরো
ভারতেই তার অনুসারী তৈরি হয়েছে। এ অনুসারীরা ধর্মভিত্তিক ক্ষমতার দিকে
রাজনৈতিক দলগুলোর পথ খুলে দিয়েছে বলে মনে করা হয়। ফলে, হিন্দুত্ববাদী
রাজনীতিতে তার ভূমিকা বিশাল। কিন্তু যদি রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কর্তৃত্বের
কথা বলা হয়, তবে বাল ঠাকরে ছিলেন মহারাষ্ট্র ও মুম্বাইয়ের সম্রাট। তার
অনুজ্ঞাতেই মুম্বাই ও মহারাষ্ট্র পরিচালিত হতো। একটি ভারতীয় পত্রিকা
লিখেছে, বালাসাহেব ঠাকরেই ঠিক করে দিতেন_ অমিতাভ বচ্চনকে ফ্রেঞ্চ কাটে
মানাবে কি-না, মণিরত্নমের বোম্বে সিনেমা মুক্তি পাবে কি-না। মুম্বাইয়ের
ফিল্মি দুনিয়াকে তিনি কার্যত নিয়ন্ত্রণ করতেন তার মতাদর্শিত পাহারার
মাধ্যমে। পান থেকে চুন খসলে শিবসেনারা মাঠে নেমে যেত। ফলে, তার নির্দেশ
অমান্য করার সাধ্য কারও ছিল না। তবে, মুম্বাইয়ের ফিল্ম জগতের প্রতি তার
কোনো বিদ্বেষ ছিল না। তিনি এ জগতের ভালো-মন্দ দেখভাল করতেন। আর বলিউডও তার
পৌরোহিত্য মেনে নিয়েছিল এবং এতে অভ্যস্তও হয়ে উঠেছিল। তাই তার মৃত্যুতে
বলিউডে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। পুরো মুম্বাই শহর ছুটি হয়ে গেছে হয়
শিবসেনাদের ভয়ে, নয়তো আন্তরিক সমীহ প্রদর্শন করে। অমিতাভ বচ্চন ছিলেন তার
মৃত্যুশয্যার পাশে। কেউ কেউ তাকে বলেন বলিউডের ফ্রেন্ড, ফিলোসফার অ্যান্ড
গাইড। কেউ বলিউডের সঙ্গে তার সম্পর্ককে অম্ল-মধুর বলে আখ্যায়িত করেন।
বলিউডের বড় স্টারদের সঙ্গে ভারতের বড় রাজনীতিকরা তার মৃত্যুতে শোক ও
শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছেন। এমন একজন রাজনীতিক বাল ঠাকরে, যার অনুসারীরা বল
প্রয়োগ ও লাঠালাঠিতে বিশ্বাসী। প্রয়োজনে হিংসার রাজনীতি করতেও কুণ্ঠিত নয়।
দাঙ্গা, হামলার বহু অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে, তার প্রতি এই শ্রদ্ধা কি শুধু
ক্ষমতার প্রতি সমীহ প্রদর্শন করার জন্যই, নাকি রাজনীতির জটিল হিসাব-নিকাশেই
এমনটা বিধেয়? খোঁজ নিতে গেলে দেখা যাবে_ না, সবটাই ভয়, সমীহ বা ভান নয়।
বিপুল ধর্মান্ধ ভক্তশ্রেণীর বাইরে অনেকে আন্তরিকভাবেই তাকে সম্মান
জানাচ্ছেন। কেননা, বাল ঠাকরের রাজনীতির অভিমুখ শুধু ধর্মের দিকেই নয়।
মহারাষ্ট্রে তিনি ভূমিপুত্রদের অধিকার প্রতিষ্ঠার নায়ক। মারাঠি ভাষা ও
সংস্কৃতির রক্ষক। মহারাষ্ট্র থেকে বোম্বে প্রেসিডেন্সি আলাদা করার
সিদ্ধান্ত যেমন তিনি রুখে দিয়েছিলেন, তেমনি মহারাষ্ট্র ও কর্নাটকের সীমান্ত
বিরোধে রীতিমতো লড়াই করেছিলেন। মুম্বাইয়ের কসমোপলিটন আবহে প্রতিষ্ঠা
করেছিলেন এথনিক বা স্থানীয় মানুষের অধিকার। সাধারণত দেখা যায়, কসমোপলিটন
শহর তার এথনিক বৈশিষ্ট্য অস্বীকার করে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে; স্থানীয়
জনগোষ্ঠীকে প্রান্তে ঠেলে দেয়। বাল ঠাকরে মুম্বাইয়ের ক্ষেত্রে এমনটি হতে
দেননি। আর নিজেকে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন ট্রেড ইউনিয়নের মাধ্যমে।
সব মিলিয়ে তিনি মারাঠিদের গোত্রপতি ও সম্রাটে পরিণত হয়েছিলেন। বাল ঠাকরে
পেশাগত জীবন শুরু করেছিলেন সাংবাদিক ও কার্টুনিস্ট হিসেবে। ফ্রি প্রেস
জার্নাল ও টাইমস অব ইন্ডিয়ায় তার আঁকা কার্টুন প্রকাশ হতো। সে পেশা ছেড়ে
রাজনীতিতে ঢুকলেও পরে সামানা ও দো পেহের কে সামানা নামে দুটি পত্রিকা
প্রকাশ করেছিলেন। বাল ঠাকরের জন্ম ১৯২৬ সালের ২৩ জানুয়ারি। তার মৃত্যুর
মধ্য দিয়ে একটি যুগের অবসান হলো। হয়তো শিবসেনার রাজনীতিও আর আগের মতো থাকবে
না। কেননা, তার জীবিত অবস্থাতেই রাজনীতির উত্তরাধিকার নিয়ে পরিবারে বিবাদ
লেগেছে। বিবাদ যে সামনে আরও বাড়বে_ তাতে সন্দেহ নেই।
No comments:
Post a Comment