Sunday, November 4, 2012

লালন ফকিরের গান :: ইলিনা সেন

 Illustration: Mayanglambam Dinesh


ছোটবেলায় প্রতি বছর আমরা কলকাতার বাইরের বাংলায় যেতাম পরিবারের সঙ্গে মিলবার উদ্দেশে। তখন স্বজনদের বাড়িতে কিংবা যাওয়া-আসার পথে ট্রেনে ও বাসস্টপে ভ্রাম্যমাণ বাউলদের গান শুনে বাউল সঙ্গীত নিয়ে আমার ভাসাভাসা ধারণা হয়েছিল। বাউল ঐতিহ্য ও সঙ্গীতের পিতৃপুরুষ লালন ফকিরের অবদান অনেক পরে আমার কাছে জীবন্ত হয়ে ওঠে। বীরভূমের মোহনীয় শীতে শান্তিনিকেতনের পৌষমেলা, কেঁদুলীর মেলায় ঘুরতে ঘুরতে তরুণ হিসেবে বাংলা কবিতা ও গান সম্পর্কে আমার একটা সচেতনতা তৈরি হয়েছিল। তখন ছত্তিশগড়ের খেটে খাওয়া মানুষের সান্নিধ্যে সম্ভবত আমি কিছুটা স্রোতের বাইরের জীবনযাপন করার চেষ্টা করছিলাম। সাধারণ মানুষের কাছে আমার প্রতিদিনের আনন্দ, দুঃখ ও নির্ভরতার শিক্ষণ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হলো লালনের ম্যাজিক। 'নবঅঞ্জর' সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী ছত্তিশগড়ের ১৮৫৭ সালের বীর নায়ক বীর নারায়ণ সিংয়ের জীবন নিয়ে একটি নাটকের মহড়া করছিল। দীর্ঘ বিকেলগুলোতে ওই মহড়া দেখতে দেখতেই বাউল গান সম্পর্কে আমার ধারণা আরও উঁচুতে পৌঁছেছিল। সময় ও বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পেরেছিলাম লালনের গানের পরতে পরতে মর্মার্থ লুকিয়ে আছে। জীবন ও সমাজকে বুঝতে ব্যক্তির নিজস্ব অভিযাত্রায় এ গানগুলো দরকারি ও সমৃদ্ধ দিশা হিসেবে উপস্থিত হতে পারে।
লালনের সবচেয়ে চেনা গানগুলোর মধ্য দিয়ে আমার ভ্রমণের কথা সবিস্তারে উল্লেখ করতে চাই। কেঁদুলীর মেলার বাউল আখড়ায় প্রথম 'সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে' গানটি শোনার পর আমার মধ্যে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি হয়। আমি বুঝতে পারি- লালন বর্ণ ও ধর্মমতের বিভাজন অগ্রাহ্য করে মৌল মানব-অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন। ছত্তিশগড়ের খনি শ্রমিকদের মধ্যে গড়ে ওঠা আন্দোলন দেখে আমি লালনের কথাগুলোর স্বতঃসিদ্ধভাবে তুলনা করতে পেরেছিলাম। আন্দোলনটি গড়ে তুলেছিলেন শঙ্কর গুহ নিয়োগী। সেখানে বলা হতো, মানুষের মধ্যে দুটি গোষ্ঠী আছে- বাগওয়া গোষ্ঠী (মানুষখেকো বা শোষক) এবং মানখি, যারা মানুষের মতো মানবতার সঙ্গে বাস করে। কয়েক বছর পর আমি যখন ধর্মীয় ও সামাজিক কাঠামোর পিতৃতান্ত্রিক উত্তরাধিকার সম্পর্কে জানলাম, বুঝতে পারলাম এগুলো কীভাবে নারীকে প্রান্তে ঠেলে দেয়, তখন লালনের গানের অননুকরণীয় সেই লাইনগুলো মনে পড়ল, 'সুন্নত দিলে হয় মুসলমান/নারীর তবে কী বা বিধান।/বামুন চিনি পৈতার প্রমাণ/বামনী চিনবি কেমনে'। জেন্ডার পরিচয় নির্ণয়ের ক্ষেত্রে লালনের অনুজ্ঞা যেমন তাত্ত্বিক, তেমনি বাস্তব। লালনের অনুসারীরা তাদের ধর্মীয় ও সামাজিক চর্চায় জেন্ডার-সাম্য স্থাপন করার চেষ্টা করেন। আমার বন্ধু মিমলু সেন অবশ্য বাউলস্ফিয়ার বইয়ে দেখিয়েছেন, সেটা করা সব সময় সহজ নয়।
লালনের সুফি গানগুলো একইভাবে বহুস্তর অর্থ তৈরি করে। আঠারো শতকের বাংলায় তন্ত্র, বৈষ্ণব ও ইসলামী সংস্কৃতির মোহনায় বসে লালন এমন গান লিখেছেন ও গেয়েছেন- যা অনুধাবনযোগ্য এবং এর তাৎক্ষণিক সৌন্দর্য সাধারণ মানুষকে সম্পর্কিত করতে পারে। কবীর জন্মেছিলেন ভিন্ন সময়ে ও ভিন্ন স্থানে। কিন্তু তারই মতো লালনও হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার বলে গণ্য হন। প্রিয় পরমাত্মার সন্ধানে লালনের খোঁজ কোনো দেখার অভিজ্ঞতা না দিয়ে তাকে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়- 'আমার বাড়ির পাশে আরশিনগর, যেথায় পড়শি বসত করে/আমি একদিনও না দেখিলাম তারে।' কখনও সেই প্রিয় আবার লালনের মধ্যেই বাস করেন, তার ভাষাতেই কথা বলেন, তবু অনন্ত সন্ধান অব্যাহত থেকে যায়-  'কথা কয় রে দেখা দেয় না/নড়ে চড়ে বুকের ভিতর/তবু খুঁজে জনমভর মেলে না।'
মরমী সুফি অভিজ্ঞতা চেনা যায়, সেটি বুল্লে শাহ ও অন্য সন্তদের নিকটবর্তী। তার পরও ভিন্ন স্তরে মানবমনে অনেক স্তরের চেতনা জাগ্রত করে। এ গানগুলোকে মৌলিক মানব-অভিজ্ঞতার ইতিবাচক চিন্তার প্রেক্ষাপটে যেমন ব্যাখ্যা করা যায়, তেমনি ভগ্নমনস্কতার প্রকাশ বলেও চিহ্নিত করা চলে। লালন ব্যাখ্যার ভার শ্রোতার ওপর ছেড়ে দিয়েছেন- এ কথা খুব বাঁধাগৎ হয়ে যায়। এগুলো যতদূর ও যতভাবে সম্ভব তার সঙ্গে আমাদের সংযোগ তৈরি করে।
আমি যতভাবে বলতে পারি তার চেয়ে বেশি প্রভাব লালনের- আমার ওপর। সম্ভবত তার কবিতার মতো একেও সময় ও স্থান থেকে আলগা করা যাবে না। আমি বলতে পারি, লালন আমাকে অবসম্ভাব্যতার বাইরে তাকানোর সাহস দিয়েছেন, পুরো অর্থহীন পরিস্থিতির মধ্যেও অর্থ ও কার্যকারণ খোঁজার অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। তার কবিতার সৌন্দর্য তীব্র নৈরাশ্যের মধ্যেও আশা জাগিয়ে রাখার শক্তি দিয়েছে।

ইলিনা সেন : ভারতীয় নারীবাদী তাত্ত্বিক ও মানবাধিকারকর্মী; মুম্বাইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্সেসের অধ্যাপক; অ্যাক্টিভিস্ট ড. বিনায়ক সেনের স্ত্রী। তেহেলকা পত্রিকায় চিন্তার উৎসব আয়োজনে তিনি লালনকে নিয়ে এ লেখাটি লিখেছেন। ভাষান্তর করেছেন মাহবুব মোর্শেদ।

No comments:

Post a Comment