একান্ত অসতর্ক ও ভুলোমন না হলে নিজের বাসায় তালা না লাগিয়ে পাশের বাসাতেও
বেড়াতে যান না রাজধানীর অধিবাসীরা। ঈদে বা দীর্ঘ ছুটি কাটাতে দূরে গেলে তো
কথাই নেই। একেকটি দরজায় সাধ্য ও সুবিধামতো নানাপ্রকার তালা দেওয়া হয়। তালা
দেওয়ার আগে ঘরের দরজা-জানালা সব বন্ধ করে চলে ঘরকে রীতিমতো বেহুলার বাসরঘর
বানানোর আয়োজন। দরজায় একাধিক ব্র্যান্ডের হরেক রকম তালা লাগিয়েও শান্তি
নেই। যদি জানা যায়, আশপাশের বাসার কেউ ছুটি কাটাতে গ্রামে যাচ্ছেন না তবে
তার কাছে অনুরোধ থাকে_ ভাই কি আপা, একটু চোখকান খোলা রাখবেন। বাসার
দারোয়ানকে বাড়তি বকশিশ ধরিয়ে একটু নিয়মিত চোখ রাখার অনুরোধও করা হয়। তবুও
কাজ হয় না। চোর-ডাকাতদের রোধ করার সাধ্য কার? ওনারা গ্রিল কেটে বাসায় ঢুকতে
পারেন যেমন, তেমনি তালা ভাঙতেও সময় লাগে না। তাই যত তালাই লাগানো হোক,
বাসা ছাড়তে গেলেই মনটা একটু খচখচ করবেই। তালা লাগানোর পর এ শহরে কার এমন
বুকের পাটা যে, তিনি নিশ্চিন্তে থাকেন? হ্যাঁ, যার নিরাপত্তার দায়িত্ব
রাষ্ট্রের, পুলিশ প্রহরায় যার বাসা সুরক্ষিত, তিনি ঘর খোলা রাখলেও আপত্তির
কিছু নেই। কিন্তু বাদবাকি সবাই তালাঅন্তপ্রাণ। তালাময় জীবনে অভ্যস্ত এই
নাগরিকদের যদি কেউ তালা লাগানোর অনুরোধ জানান, তবে তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠাই
স্বাভাবিক। আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যেভাবে তালা লাগিয়ে নিশ্চিন্তে গ্রামে
যাওয়ার পরামর্শ দিলেন নগরবাসীকে, তা তিনি করতেই পারেন। সবাই ঘর খুলে রেখে
যাবে চোরদের সুবিধা করে দেওয়ার জন্য আর ফিরে এসে সরকারের দোষ দেবে_ তা তো
হতে পারে না। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে,
চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই-খুনোখুনি নেই বললেই চলে। এ অবস্থায় কেউ যদি নিজের
ইচ্ছায় বিপদে পড়তে না চায় তবে কেউ বিপদ ঘটাতে আসবে কেন? মন্ত্রীর দিক থেকে
তাই তালা লাগানোর পরামর্শে কোনো ভুল নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আইন-শৃঙ্খলা
পরিস্থিতির যথাযথ খবর তিনি জানেন কিনা? খুন-খারাবি, চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই
ইত্যাদি অপরাধের বাড়বাড়ন্তের খবর জানতে অপরাধ বিশেষজ্ঞদের শরণাপন্ন হওয়ার
দরকার পড়ে না। দৈনিক পত্রিকাগুলোতে চোখ বোলালেই হয়। সাধারণ মানুষ তো
ভুক্তভোগী, পরিস্থিতির শিকার। তারা যখন দেখছে, যে বিষয়ের মন্ত্রী তিনি সে
বিষয়েই বেখবর শুধু নন, উল্টো খবর দিচ্ছেন; তখন তারা তার ভালো কথাকেও
ইতিবাচকভাবে নিতে পারছে না। ফলে যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে। তালা প্রসঙ্গ নিয়ে
বিস্তর কথা হচ্ছে। মেঠো আড্ডা, ভার্চুয়াল স্পেস, মিডিয়ায় কথা প্রসঙ্গে তালা
প্রসঙ্গ উঠছে। কেউ রুষ্ট, কেউ দুষ্ট। মন্ত্রীর কথায় ক্ষোভ প্রকাশ করে
অনেকে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নের দাবি জানাচ্ছেন। কেউ কেউ আবার এ নিয়ে
নানা পরিহাস করছেন। অতীত-বর্তমানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের নিয়ে নানা কথা
হচ্ছে। তালা নিয়ে বিস্তর তত্ত্বতালাশ চলছে। সাতক্ষীরার তালা থেকে শুরু করে
মনের তালা পর্যন্ত নানা কথা হচ্ছে। মন্ত্রীর বেফাঁস মন্তব্য নিয়ে এই যে
নানামুখী কথাবার্তা, এতে কিন্তু সাধারণের মনোভাব কিছুটা বোঝা যাচ্ছে। সে
মনোভাব বুঝে নিয়ে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়াটা সরকারের কাজ। কিন্তু
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীই যদি মনে করেন, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি একেবারে
সন্তোষজনক, তবে পরিস্থিতির উন্নতির জন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে
আদেশ-নির্দেশ কে দেবেন? এত বড় শহর, এত মানুষ, এত ঘরবাড়ি, এত চোর-ডাকাত_ এই
শহরের নিরাপত্তার জন্য ২ হাজার র্যাব সদস্য যে যথেষ্ট নয়, তা তো সবার
জানা। তালা লাগালেই সমাধান নিশ্চিত হবে না। তাই তালা লাগানোর কথাটা বাড়তি।
মন্ত্রীর এই বাড়তি কথায় রুষ্ট হয়ে তাই কেউ কেউ বলেই ফেলছেন_ মাননীয়
মন্ত্রী, কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেবেন না। আমরা তালা লাগাই। আপনার কথা মনে
রেখে এবার বেশি করে তালা লাগাব। আপনি এবার মুখে
তালা লাগান।
No comments:
Post a Comment