সারাবিশ্বেই রাজনীতিক, নীতিনির্ধারক ও বিশ্লেষকদের কাছে এটি বড় এক প্রশ্ন
যে, তরুণরা আসলে কী চায়? প্রশ্নটি আগেও কমবেশি ছিল। কিন্তু এখন বোধহয় আগের
যে কোনো সময়ের থেকে বেশি। প্রশ্নটা যে বেশি বেশি করে উঠছে, তার প্রেক্ষাপট
কী? একটা অনুমান করা যেতে পারে। দু'চার দশক আগেও প্রজন্ম ব্যবধান বা
জেনারেশন গ্যাপ ব্যাপারটি প্রজন্মগুলোর মধ্যে গুরুতর বিচ্ছিন্নতা তৈরি
করেনি। পুরনো প্রজন্মগুলোর পক্ষে নতুন প্রজন্মগুলোর চিন্তার গতিপ্রকৃতি
বুঝে ওঠা খুব কঠিন ছিল; কিন্তু সেটি একেবারে দুর্বোধ্য হয়ে ওঠেনি। এখন
প্রজন্ম ব্যবধান গুরুতর সমস্যা। রাজনীতির নীতিনির্ধারকদের পুরনো প্রজন্ম তো
বটেই, পিঠাপিঠি দুই প্রজন্মের মানুষের পরস্পরকে বুঝে ওঠার প্রক্রিয়াও
ক্রমে কঠিন হয়ে পড়ছে। পরস্পরের প্রতি মনোযোগ কমেছে কি? হতে পারে।
চিন্তাচর্চার ক্ষেত্রে বড় কোনো প্রভাবক তৈরি হয়েছে কি? অবশ্যই। এই
প্রভাবকের নাম তথ্যপ্রযুক্তি। ইন্টারনেট নীরবে-নিভৃতে নতুন প্রজন্মের
ভাষাভঙ্গি ও জীবনরীতিকে যেভাবে বদলে দিয়েছে অনেক বড় বড় আবিষ্কার ও উদ্ভাবনও
তা অতীতে পারেনি। যারা ছোটবেলা থেকে ই-যোগাযোগের মধ্যে নেই আর যারা আছে
তাদের চিন্তার ভঙ্গি, মনোজগতের আদলের মধ্যে পার্থক্য বিশাল। বছর তিনেক আগে
আরব বিশ্বের তরুণদের নিয়ে একটি লেখা পড়ছিলাম পশ্চিমা কোনো সংবাদপত্রে। তাতে
লেখা হয়েছিল, ইন্টারনেট আরব বিশ্বের তরুণদের পরিবর্তিত করে ফেলছে। তারা
কথা বলছে শত্রুদের সঙ্গে। মানে সেখানকার পুরনো প্রজন্ম যাদের শত্রুজ্ঞান
করে মিশত না_ সেই শত্রুদের সঙ্গে মিশছে তরুণরা। মিশে মিশে তরুণরা গণতন্ত্র,
স্বাধীনতা ও পরিবর্তন শিখেছে। এই মেশামেশির ফল তো আমরা দেখলাম। আরব বসন্ত।
পরিবর্তনের যে ডাক তরুণরা দিয়েছে তাতে পুরো বিশ্ব কেঁপে উঠেছে। কিন্তু
পরিবর্তন কি হয়েছে? আরব বসন্ত নিয়ে এখন ফুটবল খেলছে সামরিক জেনারেল আর
ইসলামপন্থিরা। অনেক তরুণের কাছে পরিবর্তন হয়তো এখন একটা ইলিউশনই। তবে এই
জাগরণে বোঝা গেছে, পরিবর্তন একটা এক্সপ্রেশন তরুণদের। বিশ্বে অনেক
রাজনীতিকই তরুণদের এ এক্সপ্রেশনের কথা জানেন। গত মার্কিন নির্বাচনে বারাক
ওবামা পরিবর্তনের ডাক দিয়ে কেমন সাড়া ফেলেছেন সেটি মনে আছে। কিন্তু
প্রত্যাশিত পরিবর্তন আসেনি সেখানেও। ফলে অনেক মার্কিনির কাছেও পরিবর্তন
মানে এখন হয়তো ইলিউশনই। বাংলাদেশেও পরিবর্তনের ডাক এসেছিল। অনেকে বলেন
পরিবর্তন নয়, এখানে যা হয়েছে তা পুরাতনের প্রত্যাবর্তন। তরুণরা পরিবর্তন
চায়, কিন্তু পথে নামলে তা হচ্ছে না। ভোট দিলেও তা হচ্ছে না। তবে কি তারা
যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বে? আর পরিবর্তন চায়টা কোথায়? যতটুকু মনে হয় তাতে অস্ত্র
হাতে নিয়ে পরিবর্তনের সংগ্রামে নামবার মতো মানসিকতা তরুণদের মধ্যে নেই।
নিদেনপক্ষে একটা দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক প্রক্রিয়াতেও তাদের মন বসবে বলে মনে
হয় না। স্বল্পমেয়াদে মাঠে নেমে একটা হেস্তনেস্ত করার মনোভাব আছে।
পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে তারা কী চায়? শ্রমিক শ্রেণীর মুক্তি? সমাজতন্ত্র?
ধর্মরাষ্ট্র? এসব কিছুই না। তরুণরা যা চায় ভদ্রভাষায় বলতে গেলে তা হলো_
স্বাধীনতা, মুক্তি, গণতন্ত্র। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের আদলে জীবনযাপনের
নিশ্চয়তা। ভারতের জনপ্রিয় লেখক চেতন ভগতের ভাষায় বলতে গেলে, নোকরি, ছুকরি
আর সামাজিক অবস্থান। চেতন ভগতের উপন্যাস ফাইভ পয়েন্ট সামওয়ান অবলম্বনে
নির্মিত হিন্দি সিনেমা থ্রি ইডিয়টসের কারণে তিনি তরুণদের মধ্যে সুপরিচিত।
তিনি তরুণদের মুখপাত্র। তরুণরা কী চায় সে প্রশ্নের জবাবে তিনি এ জবাবই
দিয়েছেন। মনে হতে পারে, খুব অসঙ্গত জবাব। তাছাড়া তরুণীদের কথা তার বিবেচনায়
এলো না। কিন্তু সত্য হয়তো এটাই। নিয়মতান্ত্রিক গণতন্ত্রের মধ্যে তারা চায়
চাকরি, সঙ্গিনী ও সামাজিক মর্যাদা। সরকারের কাজ সেসব নিশ্চিত করা। এ জন্য
পরিকল্পনা গ্রহণ করা। রাজনৈতিক ক্ষমতায় যদি তরুণরা বাগড়া না দিতে আসে তবে
এটুকু চাওয়া তো সরকারগুলো সানন্দে পূরণ করতে চাইতে পারে। কিন্তু পারছে কি?
বাংলাদেশে যদি তরুণরা বলে, আমরা শুধু চাকরি, সঙ্গী-সঙ্গিনী আর সামাজিক
মর্যাদা চাই। তবে সেটুকু পূরণের আন্তরিক চেষ্টা কি কেউ করবে?
No comments:
Post a Comment