উপনিবেশভাগ্য বরণ করবার পর পৃথিবীর সব দেশের ভাগ্যে যা ঘটেছে, ভারতবর্ষে
এবং বাংলায় তার ব্যত্যয় ঘটেনি। প্রায় দুই শত বছর ইংরেজের অধীন উপনিবেশ
হিসেবে ক্রিয়াশীল থাকার পর আমাদের ভাগ্যে মূলত কী ঘটেছে_ যদি এ প্রশ্ন ওঠে
তবে তর্কটা নানাদিকে বইতে শুরু করে আবশ্যিকভাবে। উপনিবেশের বিরুদ্ধে
সশস্ত্র ও শান্তিবাদী আন্দোলনের স্মৃতি যারা এখনও বহন করছেন, তাদের মত এক
রকম। বিদেশি শক্তির শোষণ, নির্যাতন, নিপীড়ন, হত্যার সর্বব্যাপী রাজত্বের
কথা তারা উল্লেখ করেন। বলেন, আমাদের সমাজে যা ছিল না, তা এনেছে উপনিবেশ।
সাম্প্রদায়িক হিংসা-বিদ্বেষ, দাঙ্গা একান্তভাবে ইংরেজ উপনিবেশকারীদের
অবদান। শন্তি ও সহাবস্থানপ্রিয় ভারতীয় সমাজের বিভেদের বিষ ও বিষাদবৃক্ষ
ইংরেজরাই রোপণ করেছে। ইউরোপ-মনস্ক শিক্ষিত আলোকিত মধ্যবিত্তের বিচার আলাদা।
প্রয়োজনীয় সমালোচনার সঙ্গে সঙ্গে তারা বলেন, উপনিবেশ আমাদের সভ্যতা
দিয়েছে_ সর্বসাম্প্রতিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, আধুনিকতা, শিল্পায়ন, যোগাযোগ
ব্যবস্থার ধারায় পিছিয়ে থাকা ভারতবর্ষীয় সমাজকে স্থাপন করেছে। তারা শোষণ
করেছে সত্য, কিন্তু বিনিময়ে আমাদের এমন এক উজ্জ্বল আলো দিয়ে গেছে, যার
তুলনা নেই। ইংরেজের প্রতি কৃতজ্ঞচিত্ত বাঙালির উদাহরণ ঢের মিলবে। শুধু নীরদ
চন্দ্র চৌধুরীই নন, খুঁজে দেখলে দেখা যাবে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসটাই
ক্ষেত্রবিশেষে ইংরেজের প্রতি প্রণত হয়ে আছে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জন্য
উপনিবেশের অবদানের সংক্ষিপ্ত তালিকা করলেই বিষয়টি স্পষ্ট হতে পারে। বাংলা
ভাষায় গদ্য ছিল না। ইংরেজের আশ্রয়-প্রশ্রয়-তত্ত্বাবধানে এখানে গদ্য গড়ে
উঠেছে। বাংলায় উপন্যাস ছিল না। বাঙালি লেখক ইংরেজি উপন্যাসের আদলে উপন্যাস
রচনা করেছেন। কবিতায় আধুনিকতা ছিল না; আধুনিকতা এনেছে উপনিবেশ। বাংলায় নাটক
ছিল না; নাটক এনেছে উপনিবেশ। বস্তুত, যা কিছু না থাকা_ সবই পূরণ করে
দিয়েছে উপনিবেশ। উপনিবেশ দিয়েছে ইতিহাস, দর্শন, জাতীয়তার ধারণা। গড়েছে শহর,
রাজধানী। দূর গ্রাম দেশ পর্যন্ত নিয়ে গেছে রেল ও সড়ক। সবচেয়ে বড় কথা,
উপনিবেশ আমাদের দিয়েছে দৃষ্টি এবং দেখার আলো। উপনিবেশই সাতসমুদ্র পাড়ি দিয়ে
আমাদের জন্য এনেছে এনলাইটমেন্ট, রেনেসাঁ, রিফর্মেশন। বলে রাখি, এই যে
সংক্ষিপ্ত তালিকা তার বেশিরভাগই এখন প্রবল চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড়িয়ে আছে।
যারা চ্যালেঞ্জ করছেন, তারা বলছেন, উপনিবেশ মূলত মিথ্যার বেসাতি। কোনো
জাতিকে শাসন-শোষণ করার জন্য শুধু সশস্ত্র সৈন্যবাহিনী আর সুবিধাভোগী-সমর্থক
জনগোষ্ঠী থাকলে হয় না। বরং শাসিত-শোষিত জাতিটিকে মিথ্যা মতাদর্শের আবর্তে
বন্দি করে ফেলতে হয়। আর এই মিথ্যা মতাদর্শের আবর্তই হলো উপনিবেশের টিকে
থাকার মতাদর্শ।
তাহলে আবারও যদি এই প্রশ্ন তুলি যে, উপনিবেশ কী করেছে? উপনিবেশ দেশে দেশে কী করে মূলত? উপনিবেশ মূলত ইতিহাস ভুলিয়ে দেয়। প্রথম আক্রমণেই ইতিহাসের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা ঘটিয়ে নতুন ইতিহাসের মধ্যে নিক্ষেপ করে পুরো জনগোষ্ঠীকে। অন্তত- সতেরো, আঠারো, উনিশ শতকের দখলদারদের কর্মপ্রক্রিয়া তেমনই দেখি সর্বত্র। বিশ শতকে কি আলাদা? কিংবা একবিংশ শতকে? ইরাক বা আফগানিস্তানে ইউরোপীয় ও মার্কিন আগ্রাসন ও দখলদারিত্ব কি এ দেশগুলোর অতীত ও বর্তমানকে পুরো ধ্বংস করে দিয়ে নতুন করে নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু করেনি? অবশ্য, একবিংশ শতকের দুনিয়ায় একটি জনগোষ্ঠীকে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েও নতুন নির্মাণ সম্ভব কি-না সে অন্য তর্ক। কিন্তু বিশ শতকের আগে অল্প আয়াসে ইতিহাসের সঙ্গে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার ঘটনা অহরহই আমরা ঘটতে দেখেছি। বিশ শতকে চেক দেশে সোভিয়েত দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে সোচ্চার লেখক মিলান কুন্ডেরা হয়তো ইতিহাস ও স্মৃতিকেন্দ্রিক এই বিপদের কথা মাথায় রেখেই বলেছিলেন, 'প্রতিপত্তির বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রাম প্রকারান্তরে ভুলে যাওয়ার বিরুদ্ধে মনে রাখারই সংগ্রাম।' এ কথার তাৎপর্য বুঝতে হলে তেমন ঔপনিবেশিক আমলের কথাই আমাদের মনে আনতে হবে। তেমন প্রসঙ্গ উঠলে স্পষ্ট বুঝতে পারি, আমাদের দেশে স্মৃতির বিরুদ্ধে বিস্মৃতির জয় হয়েছে। এবং সঙ্গতকারণেই আধিপত্যবাদী ধারণা ও মতাদর্শের কাছে মানুষের সংগ্রাম পরাজিত হয়েছে।
ইংরেজ কীভাবে বাংলা গদ্য তৈরি করল_ সে গল্পটা শুনুন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও শ্রীরামপুরের ব্যাপ্টিস্ট মিশন উভয়ে নিজ নিজ কাজের সূত্রে বাংলা শিখতে চাইল। কিন্তু ভাষা শিখতে হলে তো গদ্যের বই থাকা চাই। অনেক খুঁজে পেতেও কোনো গদ্যের বই পাওয়া গেল না। জানা গেল, বাংলা গদ্যের অস্তিত্বই নেই। ফলে, তারা কতিপয় সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতকে নিয়োগ করলেন বাংলা গদ্য তৈরি করার জন্য। তারা সংস্কৃতর আদলে বাংলা গদ্য তৈরি করে দিলেন। এ বর্ণনার ফাঁকগুলো লক্ষ্য করার মতো। সাহিত্যে মোটাদাগে মধ্যযুগ বলে যা পরিচিত; সে যুগে কাহিনী, কবিতা, দর্শন, প্রবন্ধ সবই কাব্যে লেখা হতো। বাংলায় যেমন ইংরেজিতেও তেমন। রুশ ভাষাতেও ব্যতিক্রম নেই। সঙ্গত কারণে বাংলায় লেখা কাব্যগুলো তখনকার প্রধান সাহিত্য। কিন্তু তখন তো লোকে চিঠি চালাচালি করত, দলিল-দস্তাবেজ লিখত, সামাজিক আরও নানা কাজে গদ্যের ব্যবহার না থাকার কারণ নেই। পরবর্তীকালের এমন গদ্যের প্রচুর নমুনা আবিষ্কৃত ও প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু সেদিকে ইংরেজদের মন গেল না। তখন লোকে নিশ্চয়ই ছন্দে ছন্দে কথা বলত না। গদ্যেই বলত। সে কথা শোনার অবকাশও নেই ইংরেজদের। ভাষা শিখতে হবে, অতএব সাধারণের ভাষা শিখে লাভ কী? নতুন একটি ভাষা তৈরি করে তা শিখে নেওয়াই তো সবচেয়ে সহজ। লোকের মুখের ভাষা, ব্যবহারিক চিঠিপত্র, দলিলের ভাষা বাদ দিয়ে তারা নতুন ভাষা তৈরির দায়িত্ব দিলেন ভিনভাষী পণ্ডিতদের। তারা সংস্কৃত গড়নে প্রাকৃতজনের ভাষাকে এমনই এক রূপ দিলেন এবং বাংলা ভাষায় সংস্কৃতের অমোচনীয় ছাপ মেরে দিলেন যে, তা থেকে রেহাই পেতে বাংলাকে আজও লড়াই করতে হচ্ছে। ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো আফ্রিকায় স্থানীয় ভাষাগুলোকে লণ্ডভণ্ড করে ধ্বংস করে দিয়েছে। স্থানীয় অধিবাসীরা ইংরেজি বা স্প্যানিশ বা পর্তুগিজ বা ফরাসিকেই গ্রহণ করেছেন। লাতিন আমেরিকায় স্থানীয় ভাষাগুলোর স্থান জবরদখল করেছে স্প্যানিশ। বাংলায় কি ব্যতিক্রম ঘটেছে? এখানে ভাষাকে ধ্বংস করে দেবার বদলে গড়ে দিয়েছে ঔপনিবেশিক শক্তি? এ প্রশ্ন নিশ্চয় উঠবে ভবিষ্যতে; উঠতে শুরু করেছে।
শুধু ভাষা কেন, ক্রমে তো জানা গেল, ইংরেজ দার্শনিকদের চিন্তা চাউর হওয়ার আগে এখানে শক্তিশালী দর্শনের ধারা ছিল। ইতিহাস, একেবারে পাক্কা লিখিত ইতিহাসও ছিল। কবিতা তো ছিলই, নাটকও ছিল। সত্যি কথা বলতে, উপন্যাসও ছিল। সাহিত্যের ক্রমপরিবর্তনের ধারায় কোনো আঙ্গিক হয়তো রূপ বদল করছিল, কোনো আঙ্গিক হয়তো খোলস বদল করে নতুনরূপে প্রকাশিত হওয়ার অপেক্ষায় ছিল। শেষ পর্যন্ত আমাদের আখ্যান-উপাখ্যান উপন্যাসের রূপ পেত কি না_ সে প্রশ্ন অবান্তর। পাঁচালি শেষ পর্যন্ত নাটক হয়ে উঠত কি না_ সে প্রশ্নও ওঠে না। কারণ, ইতিহাসে সে সুযোগ ছিল না। কেননা, একেবারে ছিন্নমূল করে দিয়ে আমাদের সাহিত্যের আধুনিকতার যাত্রা শুরু হয়েছিল। পরবর্তীকালে যখন সাহিত্যের ইতিহাস রচিত হলো, আমরা দেখলাম উপনিবেশের ভিত্তিহীন মিথ্যার বেসাতি। সব প্রণতি ঔপনিবেশিক শক্তির পদতলে চলে গেল। কিন্তু ভিত্তিহীনতার ওপর কি অট্টালিকা তৈরি হয়? যদি আধুনিক যুগের বাংলা সাহিত্যের বিপুল সম্ভারের দিকে তাকাই, তবে দেখব বিশালায়তন অট্টালিকাগুলোই দাঁড়িয়ে আছে সামনে। যদি রায় দেওয়া হয়_ এ ভিত্তিহীন, তবে রায়টা গ্রহণযোগ্য হবে না। এর ভিত্তি উপনিবেশ ও দুই শত বছরের মতাদর্শ। সত্যি বলতে, আমরা তো আমাদের সমাজে, রাষ্ট্রে উপনিবেশের বহু অবদান ও ক্ষত বহন করে চলেছি। তাহলে, সাহিত্যের একার দোষ দেব কেন? আমরা তো সিরাজুদ্দৌলার সেই বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা ফেরত আনতে চাই না। তাহলে, উপন্যাসের জায়গায় কি ফেরত আনা সম্ভব আখ্যান বা উপাখ্যানকে? নাটকের জায়গায় পাঁচালিকে? সতের শতকে যেখানে ছিল বাংলা গদ্য, সেখান থেকে আবার শুরু করা যায়? রাষ্ট্র ও রাজনীতি অফেরতযোগ্য পথে চলে, কিন্তু সাহিত্য তো চলে না। অনেকেই অবশ্য বলেন, আমাদের দেশে ইতিহাসের পথযাত্রা স্পাইরাল। পুরনো ঘটনা নাকি ফিরে ফিরে আসে। তারপরও সবাই এ কথা মানেন যে, রাষ্ট্রের ইতিহাসকে পুরনো খাতে ফেরত আনবার উপায় নেই। সে সম্ভাবনা ক্ষীণ। কিন্তু সাহিত্য তো ব্যক্তি-লেখকের অভিরুচির কাছে দায়বদ্ধ। তাই হয়তো আমরা দেখব, অতিসাম্প্রতিক কালে সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপটে কোনো সাহিত্যিক পাঁচালি লিখছেন। উপন্যাসের চাইতে আখ্যান রচনাকে শ্রেয়তর মনে করছেন। মঙ্গলকাব্যকে পুনর্নির্মাণ করতে চাইছেন। প্রাচীন বাংলার জনজীবনকে আঁকতে চাইছেন। বর্ণনায়-বিষয়ে পালা-পাঁচালি-যাত্রার ছাপ রেখে যেতে চাইছেন। শ্রীচৈতন্য থেকে শুরু করে লালন ও তার পরবর্তীকালে চিন্তাচর্চাকে স্পর্শ করতে চাইছেন। সাহিত্যিক প্রচেষ্টা হিসেবে এগুলোর মূল্য ব্যাপক। আমাদের সাহিত্যের ইতিহাসে যে মিসিং লিংকগুলো আছে সেগুলো পূরণ করার চেষ্টা এগুলো। সাহিত্যমানের বিচারে এগুলো গুরুত্বপূর্ণ_ সন্দেহ নেই। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে এগুলো আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ঔপনিবেশিক শক্তি ও তার তাঁবেদাররা যে মিথ্যা, বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ইতিহাস তৈরি করেছে; তার ভ্রান্তিগুলো ধরিয়ে দেওয়াটাও গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাসের মধুর ও তিক্ত ভুলগুলো থেকে তো শিখতেই হবে আমাদের। আর যদি আমরা ক্রমাগত ক্ষতগুলো আড়াল করেই চলি, সেগুলো আরোগ্যহীন ব্যাধিতে রূপান্তরিত হবে।
বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম উপন্যাসের সূত্রে যদি ১৮৬৫ সালকে আমাদের উপন্যাসের সূচনাকাল বলে গণ্য করি, তবে সেটা দুঃখজনক কথা। সাহিত্যের জনপ্রিয়তম ধারাটির সঙ্গে তুলনীয় কোনো আঙ্গিক আমাদের তাহলে নেই। দেবেশ রায় লিখেছিলেন, দস্তয়েভস্কির উপন্যাস আলোচনা করতে গিয়ে মিখাইল বাখতিন রুশ লোক-আখ্যানের সূত্র উল্লেখ করতে পেরেছিলেন। যেসব জাতি কখনও ঔপনিবেশিক শক্তির শিকারে পরিণত হয়নি, তাদের সবার ক্ষেত্রেই প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় গীতিকা, আখ্যানই উপন্যাসের পথে যাত্রা করেছে। আমাদের ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটিয়েছে উপনিবেশ। কিন্তু উপনিবেশের বিধিলিপি আজ অব্দি মেনে চলার কোনো দায় কি আমাদের আছে? এখন যদি সাহিত্যের ছেড়ে আসা ইতিহাসের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের কাজ শুরু হয়, তবে দোষ কোথায়? উপন্যাসের একটা বড় চাহিদা তো জাতীয়, স্থানীয় বৈশিষ্ট্য গ্রহণ করা। একই সঙ্গে সাম্প্রতিক হয়ে ওঠা। যদি তা-ই হয়, তবে পাঁচালি, মঙ্গলকাব্য, আখ্যান, গীতিকবিতা থেকে বাংলা উপন্যাস যদি শক্তি সঞ্চয় করে, তবে তা আশাব্যঞ্জক ঘটনা বলেই গণ্য হবে।
আমরা ছিলাম কাক। ঔপনিবেশিক শক্তি আমাদের ময়ূরপুচ্ছ পরিয়ে গেছে। আমরা তো শত শত বছর ওই মিথ্যা ময়ূর সেজে থাকতে পারি না। ময়ূরপুচ্ছ নিশ্চয় আমরা পরব। কিন্তু ভেতরে ভালো কাক হওয়ার বাসনাটা কি এতকাল পরেও আসবে না?
তাহলে আবারও যদি এই প্রশ্ন তুলি যে, উপনিবেশ কী করেছে? উপনিবেশ দেশে দেশে কী করে মূলত? উপনিবেশ মূলত ইতিহাস ভুলিয়ে দেয়। প্রথম আক্রমণেই ইতিহাসের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা ঘটিয়ে নতুন ইতিহাসের মধ্যে নিক্ষেপ করে পুরো জনগোষ্ঠীকে। অন্তত- সতেরো, আঠারো, উনিশ শতকের দখলদারদের কর্মপ্রক্রিয়া তেমনই দেখি সর্বত্র। বিশ শতকে কি আলাদা? কিংবা একবিংশ শতকে? ইরাক বা আফগানিস্তানে ইউরোপীয় ও মার্কিন আগ্রাসন ও দখলদারিত্ব কি এ দেশগুলোর অতীত ও বর্তমানকে পুরো ধ্বংস করে দিয়ে নতুন করে নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু করেনি? অবশ্য, একবিংশ শতকের দুনিয়ায় একটি জনগোষ্ঠীকে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েও নতুন নির্মাণ সম্ভব কি-না সে অন্য তর্ক। কিন্তু বিশ শতকের আগে অল্প আয়াসে ইতিহাসের সঙ্গে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার ঘটনা অহরহই আমরা ঘটতে দেখেছি। বিশ শতকে চেক দেশে সোভিয়েত দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে সোচ্চার লেখক মিলান কুন্ডেরা হয়তো ইতিহাস ও স্মৃতিকেন্দ্রিক এই বিপদের কথা মাথায় রেখেই বলেছিলেন, 'প্রতিপত্তির বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রাম প্রকারান্তরে ভুলে যাওয়ার বিরুদ্ধে মনে রাখারই সংগ্রাম।' এ কথার তাৎপর্য বুঝতে হলে তেমন ঔপনিবেশিক আমলের কথাই আমাদের মনে আনতে হবে। তেমন প্রসঙ্গ উঠলে স্পষ্ট বুঝতে পারি, আমাদের দেশে স্মৃতির বিরুদ্ধে বিস্মৃতির জয় হয়েছে। এবং সঙ্গতকারণেই আধিপত্যবাদী ধারণা ও মতাদর্শের কাছে মানুষের সংগ্রাম পরাজিত হয়েছে।
ইংরেজ কীভাবে বাংলা গদ্য তৈরি করল_ সে গল্পটা শুনুন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও শ্রীরামপুরের ব্যাপ্টিস্ট মিশন উভয়ে নিজ নিজ কাজের সূত্রে বাংলা শিখতে চাইল। কিন্তু ভাষা শিখতে হলে তো গদ্যের বই থাকা চাই। অনেক খুঁজে পেতেও কোনো গদ্যের বই পাওয়া গেল না। জানা গেল, বাংলা গদ্যের অস্তিত্বই নেই। ফলে, তারা কতিপয় সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতকে নিয়োগ করলেন বাংলা গদ্য তৈরি করার জন্য। তারা সংস্কৃতর আদলে বাংলা গদ্য তৈরি করে দিলেন। এ বর্ণনার ফাঁকগুলো লক্ষ্য করার মতো। সাহিত্যে মোটাদাগে মধ্যযুগ বলে যা পরিচিত; সে যুগে কাহিনী, কবিতা, দর্শন, প্রবন্ধ সবই কাব্যে লেখা হতো। বাংলায় যেমন ইংরেজিতেও তেমন। রুশ ভাষাতেও ব্যতিক্রম নেই। সঙ্গত কারণে বাংলায় লেখা কাব্যগুলো তখনকার প্রধান সাহিত্য। কিন্তু তখন তো লোকে চিঠি চালাচালি করত, দলিল-দস্তাবেজ লিখত, সামাজিক আরও নানা কাজে গদ্যের ব্যবহার না থাকার কারণ নেই। পরবর্তীকালের এমন গদ্যের প্রচুর নমুনা আবিষ্কৃত ও প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু সেদিকে ইংরেজদের মন গেল না। তখন লোকে নিশ্চয়ই ছন্দে ছন্দে কথা বলত না। গদ্যেই বলত। সে কথা শোনার অবকাশও নেই ইংরেজদের। ভাষা শিখতে হবে, অতএব সাধারণের ভাষা শিখে লাভ কী? নতুন একটি ভাষা তৈরি করে তা শিখে নেওয়াই তো সবচেয়ে সহজ। লোকের মুখের ভাষা, ব্যবহারিক চিঠিপত্র, দলিলের ভাষা বাদ দিয়ে তারা নতুন ভাষা তৈরির দায়িত্ব দিলেন ভিনভাষী পণ্ডিতদের। তারা সংস্কৃত গড়নে প্রাকৃতজনের ভাষাকে এমনই এক রূপ দিলেন এবং বাংলা ভাষায় সংস্কৃতের অমোচনীয় ছাপ মেরে দিলেন যে, তা থেকে রেহাই পেতে বাংলাকে আজও লড়াই করতে হচ্ছে। ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো আফ্রিকায় স্থানীয় ভাষাগুলোকে লণ্ডভণ্ড করে ধ্বংস করে দিয়েছে। স্থানীয় অধিবাসীরা ইংরেজি বা স্প্যানিশ বা পর্তুগিজ বা ফরাসিকেই গ্রহণ করেছেন। লাতিন আমেরিকায় স্থানীয় ভাষাগুলোর স্থান জবরদখল করেছে স্প্যানিশ। বাংলায় কি ব্যতিক্রম ঘটেছে? এখানে ভাষাকে ধ্বংস করে দেবার বদলে গড়ে দিয়েছে ঔপনিবেশিক শক্তি? এ প্রশ্ন নিশ্চয় উঠবে ভবিষ্যতে; উঠতে শুরু করেছে।
শুধু ভাষা কেন, ক্রমে তো জানা গেল, ইংরেজ দার্শনিকদের চিন্তা চাউর হওয়ার আগে এখানে শক্তিশালী দর্শনের ধারা ছিল। ইতিহাস, একেবারে পাক্কা লিখিত ইতিহাসও ছিল। কবিতা তো ছিলই, নাটকও ছিল। সত্যি কথা বলতে, উপন্যাসও ছিল। সাহিত্যের ক্রমপরিবর্তনের ধারায় কোনো আঙ্গিক হয়তো রূপ বদল করছিল, কোনো আঙ্গিক হয়তো খোলস বদল করে নতুনরূপে প্রকাশিত হওয়ার অপেক্ষায় ছিল। শেষ পর্যন্ত আমাদের আখ্যান-উপাখ্যান উপন্যাসের রূপ পেত কি না_ সে প্রশ্ন অবান্তর। পাঁচালি শেষ পর্যন্ত নাটক হয়ে উঠত কি না_ সে প্রশ্নও ওঠে না। কারণ, ইতিহাসে সে সুযোগ ছিল না। কেননা, একেবারে ছিন্নমূল করে দিয়ে আমাদের সাহিত্যের আধুনিকতার যাত্রা শুরু হয়েছিল। পরবর্তীকালে যখন সাহিত্যের ইতিহাস রচিত হলো, আমরা দেখলাম উপনিবেশের ভিত্তিহীন মিথ্যার বেসাতি। সব প্রণতি ঔপনিবেশিক শক্তির পদতলে চলে গেল। কিন্তু ভিত্তিহীনতার ওপর কি অট্টালিকা তৈরি হয়? যদি আধুনিক যুগের বাংলা সাহিত্যের বিপুল সম্ভারের দিকে তাকাই, তবে দেখব বিশালায়তন অট্টালিকাগুলোই দাঁড়িয়ে আছে সামনে। যদি রায় দেওয়া হয়_ এ ভিত্তিহীন, তবে রায়টা গ্রহণযোগ্য হবে না। এর ভিত্তি উপনিবেশ ও দুই শত বছরের মতাদর্শ। সত্যি বলতে, আমরা তো আমাদের সমাজে, রাষ্ট্রে উপনিবেশের বহু অবদান ও ক্ষত বহন করে চলেছি। তাহলে, সাহিত্যের একার দোষ দেব কেন? আমরা তো সিরাজুদ্দৌলার সেই বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা ফেরত আনতে চাই না। তাহলে, উপন্যাসের জায়গায় কি ফেরত আনা সম্ভব আখ্যান বা উপাখ্যানকে? নাটকের জায়গায় পাঁচালিকে? সতের শতকে যেখানে ছিল বাংলা গদ্য, সেখান থেকে আবার শুরু করা যায়? রাষ্ট্র ও রাজনীতি অফেরতযোগ্য পথে চলে, কিন্তু সাহিত্য তো চলে না। অনেকেই অবশ্য বলেন, আমাদের দেশে ইতিহাসের পথযাত্রা স্পাইরাল। পুরনো ঘটনা নাকি ফিরে ফিরে আসে। তারপরও সবাই এ কথা মানেন যে, রাষ্ট্রের ইতিহাসকে পুরনো খাতে ফেরত আনবার উপায় নেই। সে সম্ভাবনা ক্ষীণ। কিন্তু সাহিত্য তো ব্যক্তি-লেখকের অভিরুচির কাছে দায়বদ্ধ। তাই হয়তো আমরা দেখব, অতিসাম্প্রতিক কালে সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপটে কোনো সাহিত্যিক পাঁচালি লিখছেন। উপন্যাসের চাইতে আখ্যান রচনাকে শ্রেয়তর মনে করছেন। মঙ্গলকাব্যকে পুনর্নির্মাণ করতে চাইছেন। প্রাচীন বাংলার জনজীবনকে আঁকতে চাইছেন। বর্ণনায়-বিষয়ে পালা-পাঁচালি-যাত্রার ছাপ রেখে যেতে চাইছেন। শ্রীচৈতন্য থেকে শুরু করে লালন ও তার পরবর্তীকালে চিন্তাচর্চাকে স্পর্শ করতে চাইছেন। সাহিত্যিক প্রচেষ্টা হিসেবে এগুলোর মূল্য ব্যাপক। আমাদের সাহিত্যের ইতিহাসে যে মিসিং লিংকগুলো আছে সেগুলো পূরণ করার চেষ্টা এগুলো। সাহিত্যমানের বিচারে এগুলো গুরুত্বপূর্ণ_ সন্দেহ নেই। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে এগুলো আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ঔপনিবেশিক শক্তি ও তার তাঁবেদাররা যে মিথ্যা, বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ইতিহাস তৈরি করেছে; তার ভ্রান্তিগুলো ধরিয়ে দেওয়াটাও গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাসের মধুর ও তিক্ত ভুলগুলো থেকে তো শিখতেই হবে আমাদের। আর যদি আমরা ক্রমাগত ক্ষতগুলো আড়াল করেই চলি, সেগুলো আরোগ্যহীন ব্যাধিতে রূপান্তরিত হবে।
বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম উপন্যাসের সূত্রে যদি ১৮৬৫ সালকে আমাদের উপন্যাসের সূচনাকাল বলে গণ্য করি, তবে সেটা দুঃখজনক কথা। সাহিত্যের জনপ্রিয়তম ধারাটির সঙ্গে তুলনীয় কোনো আঙ্গিক আমাদের তাহলে নেই। দেবেশ রায় লিখেছিলেন, দস্তয়েভস্কির উপন্যাস আলোচনা করতে গিয়ে মিখাইল বাখতিন রুশ লোক-আখ্যানের সূত্র উল্লেখ করতে পেরেছিলেন। যেসব জাতি কখনও ঔপনিবেশিক শক্তির শিকারে পরিণত হয়নি, তাদের সবার ক্ষেত্রেই প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় গীতিকা, আখ্যানই উপন্যাসের পথে যাত্রা করেছে। আমাদের ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটিয়েছে উপনিবেশ। কিন্তু উপনিবেশের বিধিলিপি আজ অব্দি মেনে চলার কোনো দায় কি আমাদের আছে? এখন যদি সাহিত্যের ছেড়ে আসা ইতিহাসের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের কাজ শুরু হয়, তবে দোষ কোথায়? উপন্যাসের একটা বড় চাহিদা তো জাতীয়, স্থানীয় বৈশিষ্ট্য গ্রহণ করা। একই সঙ্গে সাম্প্রতিক হয়ে ওঠা। যদি তা-ই হয়, তবে পাঁচালি, মঙ্গলকাব্য, আখ্যান, গীতিকবিতা থেকে বাংলা উপন্যাস যদি শক্তি সঞ্চয় করে, তবে তা আশাব্যঞ্জক ঘটনা বলেই গণ্য হবে।
আমরা ছিলাম কাক। ঔপনিবেশিক শক্তি আমাদের ময়ূরপুচ্ছ পরিয়ে গেছে। আমরা তো শত শত বছর ওই মিথ্যা ময়ূর সেজে থাকতে পারি না। ময়ূরপুচ্ছ নিশ্চয় আমরা পরব। কিন্তু ভেতরে ভালো কাক হওয়ার বাসনাটা কি এতকাল পরেও আসবে না?
No comments:
Post a Comment