১৯৭৭ সালে ক্রেইগ থমাস 'ফায়ারফক্স' নামে একটি উপন্যাস লিখেছিলেন।
রহস্য-রোমাঞ্চ ঔপন্যাসিক ক্রেইগের উপন্যাসের প্রেক্ষাপট স্নায়ুযুদ্ধের
সময়কার। কাহিনীর কেন্দ্রে যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য ও সোভিয়েত ইউনিয়ন। গোপন
সূত্রে ব্রিটিশ ও আমেরিকান কর্তৃপক্ষ জেনে যায় সোভিয়েতরা মিগ-৩১ নামে নতুন
ধরনের একটি এয়ারক্র্যাফট তৈরি করেছে। এ এয়ারক্র্যাফটটির বিশেষ বৈশিষ্ট্য
হলো, এটি সব ধরনের রাডার ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিয়ে উড়তে সক্ষম এবং এটি পাইলটের
চিন্তার সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে ক্ষেপণাস্ত্র চালাতে পারে। যুক্তরাজ্য ও
যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষগুলো ফায়ারফক্সের খবরে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল এবং
এয়ারক্র্যাফট নির্মাণের প্রযুক্তি নয়, খোদ এয়ারক্র্যাফটটি চুরি করার
পরিকল্পনা আঁটল। তারা চুরির দায়িত্ব দিল দক্ষ পাইলট মাইকেল গ্রান্টকে।
শ্বাসরুদ্ধকর উপন্যাসটি অবশ্য আমাদের আলোচনার বিষয় নয়, বিষয়
এয়ারক্র্যাফটটি। ১৯৭৭ সালে যা ছিল রোমাঞ্চ উপন্যাসের খেয়ালি কল্পনা তা
বর্তমানে বাস্তব হয়ে উঠেছে। ইতিমধ্যে রাডার ব্যবস্থাকে ফাঁকি দেওয়ার মতো
এয়ারক্র্যাফট তৈরি হয়ে গেছে। ক্রেইগের কাল্পনিক এয়ারক্র্যাফটটি শুধু রাডার
ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিতে পারত কিন্তু ইনফ্রারেড দিয়ে এর অস্তিত্ব শনাক্ত করা
যেত। কিন্তু এখন স্টিলথ এয়ারক্র্যাফট প্রযুক্তিতে নির্মিত এয়ারক্র্যাফটগুলো
উভয়কেই ফাঁকি দিতে সক্ষম। মজার ব্যাপার, এয়ারক্র্যাফটে বসে পাইলটের
চিন্তার সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের চিন্তা এখনকার এয়ারক্র্যাফটকে করতেই হয় না।
এয়ারক্র্যাফটে পাইলটের বালাই থাকে না। ড্রোন নামে যে এয়ারক্র্যাফটটি তৈরি
হয়েছে তা পাইলটবিহীন। চলে সম্পূর্ণ কম্পিউটারাইজড নেটওয়ার্কিং সিস্টেমে।
পাকিস্তান ও আফগানিস্তান সীমান্তে জঙ্গি ও তালেবান দমন করতে গিয়ে ড্রোন
প্রযুক্তি বিশেষ পরিচিতি পেয়েছে। ড্রোন নিয়ে পাকিস্তানে তীব্র বিতর্ক দেখা
দিয়েছে কিছু কিছু সৈন্যের মৃত্যুর ফলে। সম্প্রতি ইরান একটি মার্কিন ড্রোন
আটক করে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দেখিয়েছিল। এখন শোনা যাচ্ছে, ইরান নাকি এমন
একটি এয়ারক্র্যাফট তৈরির চেষ্টাও করছে। ড্রোন স্টিলথ প্রযুক্তি। ধারণা করা
হচ্ছে, ইলেকট্রনিক সাইবার অ্যাটাক বা জ্যামিংয়ের সাহায্যে ইরানিরা ড্রোনটির
খোঁজ পেয়েছিল। পাইলটবিহীন এ প্রযুক্তির পাশাপাশি সৈন্য বহনকারী স্টিলথ
এয়ারক্র্যাফটের দেখাও মিলেছে পাকিস্তানে। ধারণা করা হয়, ওসামা বিন লাদেন
হত্যা অভিযানে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষকে ফাঁকি দিতে এ ধরনের এয়ারক্র্যাফট
ব্যবহার করা হয়েছিল। আর এই এয়ারক্র্যাফটগুলোর একটি লাদেনের বাড়ির কাছে
বিধ্বস্ত হয়েছিল। এই বিশেষ এয়ারক্র্যাফটটি সবার কাছেই অপরিচিত, ধারণা করা
হয় এটি স্টিলথ প্রযুক্তির এয়ারক্র্যাফট। বলাবাহুল্য, ক্রেইগ থমাসের কল্পনা
এখন বাস্তব। গত শুক্রবার ভারতীয় পত্রিকা ডিএনএ ইন্ডিয়া খবর দিয়েছে,
সম্প্রতি পাকিস্তানে যে বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে সে বিমানের পাইলট বিমানের
সামনে দিয়ে একটি ইউএফও যেতে দেখেছেন। ইউএফও হলো আনআইডেন্টিফায়েড ফ্লাইং
অবজেক্ট। সাধারণত ভিনগ্রহ থেকে পৃথিবীতে আসা নভোযানকেই এ নামে ডাকা হয়। এমন
নভোযানের অস্তিত্ব অবশ্য প্রমাণিত নয়। এখন অবশ্য অশনাক্ত সব
এয়ারক্র্যাফটকেই ইউএফও নামে ডাকার রেওয়াজ তৈরি হয়েছে। ডিএনএ জানাচ্ছে, একটি
অসমর্থিত সূত্রমতে, ভোজা এয়ার বোয়িং-৭৩৭ বিপর্যয়ের ভিডিও চিত্রে ওই স্থান
দিয়ে রহস্যময় তিনটি আলোর উৎসকে অতিক্রম করতে দেখা গেছে। এগুলোকেই ইউএফও বলা
হচ্ছে। অসমর্থিত খবরটি দিয়েছে রাশিয়ান একটি পত্রিকা। এ দুর্ঘটনায় ১২৭
যাত্রী মারা গেছে। ফিরে আসি ক্রেইগ থমাসের উপন্যাসে। গ্রান্ট যখন মিগ-৩১
চুরি করে সোভিয়েতের আকাশ পাড়ি দিচ্ছে, তখন তার সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছিল এক
যাত্রীবাহী বিমানের। বলাবাহুল্য, বিমানের রাডারে মিগের অস্তিত্ব ধরা পড়েনি।
সহসা একেবারে চোখের সামনে মিগটিকে দেখে রীতিমতো ভিরমি খেয়েছিল যাত্রীবাহী
বিমানের পাইলট। অল্পের জন্য দুর্ঘটনাও ঘটতে যাচ্ছিল। হয়তো এমনই কোনো
এয়ারক্র্যাফটের দেখা পেয়েছিল ভোজা। তাকে ইউএফও বলা হচ্ছে। রহস্য-রোমাঞ্চ
উপন্যাসের সূত্রে কল্পনাটা একটু বেশি হয়ে গেল বটে। এখন থামা দরকার।
Saturday, April 28, 2012
Saturday, April 21, 2012
কার্টুন কেলেঙ্কারি
সামান্য এক কার্টুন নিয়ে ভারতজুড়ে তোলপাড় হচ্ছে। ভারতের নানা ইংরেজি দৈনিকে
কার্টুনটি দেখে মনে হলো এ তো সামান্যই। ঠিক কার্টুনও নয় কোলাজ। একটু
পরিহাস আছে বটে, কিন্তু লন্ডনের পত্রিকা প্রাইভেট আই হরহামেশা যেমন
তীব্র-তীক্ষষ্ট কোলাজ করে তার তুলনায় এ কিছুই না। কার্টুনে পশ্চিমবঙ্গের
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইন্ডিয়ান রেলওয়ের লোগো দেখিয়ে বলছেন,
দেখতে পাচ্ছ মুকুল, সোনার কেল্লা। এরপরই সদ্য বিদায়ী রেলমন্ত্রীর পাশে
বর্তমান রেলমন্ত্রী মুকুল রায়ের ছবি। মুকুল বলছেন, ওটা দুষ্ট লোক। এরপরই
মমতার উক্তি, দুষ্ট লোক? ভ্যানিশ। কার্টুন প্রসঙ্গে সবার মনে পড়বে,
সম্প্রতি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের রেলমন্ত্রীর পদ থেকে দিনেশ ত্রিবেদিকে
সরিয়ে মুকুল রায়কে বসিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তৃণমূল সমর্থিত জোট
ক্ষমতায় বলে কেন্দ্রীয় সরকার দ্বিমত সত্ত্বেও মেনে নেয় এই সিদ্ধান্ত।
কোলাজটি অবশ্যই বাস্তবসম্মত, সঠিক তথ্যের ওপরই তৈরি। কিন্তু মমতা ক্ষেপেছেন
বেশ। প্রথমে কলকাতার পুলিশ ফেসবুককেই অনুরোধ করেছে কার্টুন সরিয়ে ফেলতে।
মামাবাড়ির অনুরোধ বটে। নানা দেশের সরকারগুলো এখন পান থেকে চুন খসলেই ফেসবুক
থেকে এটা-ওটা সরানোর নির্দেশ জারি করে বসছে। মমতাই-বা পিছিয়ে থাকবেন কেন।
কিন্তু কোলাজ সরানোর অনুরোধ করেই চুপ থাকল না পশ্চিমবঙ্গ সরকার। কোলাজের
অপরাধে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্রকে গ্রেফতার
করেছে পুলিশ। স্বাধীন মতপ্রকাশের ওপর এমন হামলায় ভারতজুড়ে মমতার তীব্র
সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেছে মূলধারা ও বিকল্পধারার গণমাধ্যমগুলো। এক
কার্টুনের ধারাবাহিকতায় আরও নানা কার্টুন হয়েছে। কোথাও মমতাকে দেখানো হয়েছে
হিটলারের রূপে, কোথাওবা অত্যাচারী পুলিশরূপে। প্রেস কাউন্সিল অব ইন্ডিয়ার
চেয়ারম্যান বিচারপতি মার্কেন্ডেয় কুটজু পর্যন্ত বলেছেন, মমতাকে গণতান্ত্রিক
সংস্কৃতি শিখতে হবে আর পরিপকস্ফ আচরণও করতে হবে। নাগরিকরা প্রশ্ন করছে,
শাসকদের কোনো সমালোচনাই তাহলে করা যাবে না? শাসকরা যাচ্ছেতাই সিদ্ধান্ত
নেবেন, হাস্যকর ও বেদনাদায়ক নানা কাজ করে যাবেন আর নাগরিকরা সামান্য
সমালোচনাও করতে পারবে না, এ কী করে হয়। সত্যিকার অর্থে, এত জল ঘোলা না করে
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যদি এমন একটা কোলাজকে মেনে নিতেন তবে ভারতজুড়ে এত
নিন্দা তাকে কুড়াতে হতো না, এক কার্টুনের জের ধরে আরও কার্টুন হতো না। যাই
হোক, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মিডিয়ার ওপর রুষ্ট হয়ে বলেছেন, তারা শুধু
নেতিবাচক দিকগুলোকেই প্রাধান্য দেয়। যে মিডিয়া ক্ষমতায় আসার আগে মমতার
প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করত সেই মিডিয়ার প্রতিই মমতাকে অভিযোগ করতে হচ্ছে
মেয়াদের এক বছর না যেতেই। মিডিয়াগুলো বলছে, তাদের পলিসি পরিবর্তন হয়নি। বরং
কৃতকর্মের ফলই ভোগ করতে হচ্ছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। কিছুদিন আগে
সরকারের অর্থপুষ্ট লাইব্রেরিগুলোর জন্য ক্রয়যোগ্য পত্রিকার তালিকা ঠিক করে
দিয়ে মিডিয়ায় তুমুল সমালোচনার শিকার হয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এবার এই
কার্টুন কেলেঙ্কারি। তবে কার্টুন কাণ্ডের পর মমতা মিডিয়া নিয়ে এবার খুশি
হতে পারেন। কারণ, টাইম ম্যাগাজিন বিশ্বের প্রভাবশালী ১০০ ব্যক্তির মধ্যে
তার নাম নিয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রভাবশালী বটে। বাংলাদেশ-ভারত
সম্পর্কোন্নয়নের বেশ ক'টি উদ্যোগ তিনি থামিয়ে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়,
কেন্দ্রীয় সরকারের বেশ কিছু ভাইটাল ডিসিশনেও বাগড়া দিয়েছেন। মমতা হেলে বসলে
ভারতের সরকারও হেলে যাওয়ার আশঙ্কা। তাই দিদিকে ট্যাক্স দিয়েই চলতে হচ্ছে
সরকারকে। সেদিন এনডিটিভিতে দেখলাম, একজন সাংসদ মমতার এই প্রভাব নিয়ে
মতপ্রকাশ করতে গিয়ে বলছেন, এখনও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দেশ চালাচ্ছে। এত
প্রভাব আর ক্ষমতা যার তিনি সমালোচনা না সয়েই রাজ্য চালাবেন সেটা কীভাবে
মানা যায়?
Friday, April 20, 2012
মিথ্যার ময়ূরপুচ্ছ
উপনিবেশভাগ্য বরণ করবার পর পৃথিবীর সব দেশের ভাগ্যে যা ঘটেছে, ভারতবর্ষে
এবং বাংলায় তার ব্যত্যয় ঘটেনি। প্রায় দুই শত বছর ইংরেজের অধীন উপনিবেশ
হিসেবে ক্রিয়াশীল থাকার পর আমাদের ভাগ্যে মূলত কী ঘটেছে_ যদি এ প্রশ্ন ওঠে
তবে তর্কটা নানাদিকে বইতে শুরু করে আবশ্যিকভাবে। উপনিবেশের বিরুদ্ধে
সশস্ত্র ও শান্তিবাদী আন্দোলনের স্মৃতি যারা এখনও বহন করছেন, তাদের মত এক
রকম। বিদেশি শক্তির শোষণ, নির্যাতন, নিপীড়ন, হত্যার সর্বব্যাপী রাজত্বের
কথা তারা উল্লেখ করেন। বলেন, আমাদের সমাজে যা ছিল না, তা এনেছে উপনিবেশ।
সাম্প্রদায়িক হিংসা-বিদ্বেষ, দাঙ্গা একান্তভাবে ইংরেজ উপনিবেশকারীদের
অবদান। শন্তি ও সহাবস্থানপ্রিয় ভারতীয় সমাজের বিভেদের বিষ ও বিষাদবৃক্ষ
ইংরেজরাই রোপণ করেছে। ইউরোপ-মনস্ক শিক্ষিত আলোকিত মধ্যবিত্তের বিচার আলাদা।
প্রয়োজনীয় সমালোচনার সঙ্গে সঙ্গে তারা বলেন, উপনিবেশ আমাদের সভ্যতা
দিয়েছে_ সর্বসাম্প্রতিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, আধুনিকতা, শিল্পায়ন, যোগাযোগ
ব্যবস্থার ধারায় পিছিয়ে থাকা ভারতবর্ষীয় সমাজকে স্থাপন করেছে। তারা শোষণ
করেছে সত্য, কিন্তু বিনিময়ে আমাদের এমন এক উজ্জ্বল আলো দিয়ে গেছে, যার
তুলনা নেই। ইংরেজের প্রতি কৃতজ্ঞচিত্ত বাঙালির উদাহরণ ঢের মিলবে। শুধু নীরদ
চন্দ্র চৌধুরীই নন, খুঁজে দেখলে দেখা যাবে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসটাই
ক্ষেত্রবিশেষে ইংরেজের প্রতি প্রণত হয়ে আছে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জন্য
উপনিবেশের অবদানের সংক্ষিপ্ত তালিকা করলেই বিষয়টি স্পষ্ট হতে পারে। বাংলা
ভাষায় গদ্য ছিল না। ইংরেজের আশ্রয়-প্রশ্রয়-তত্ত্বাবধানে এখানে গদ্য গড়ে
উঠেছে। বাংলায় উপন্যাস ছিল না। বাঙালি লেখক ইংরেজি উপন্যাসের আদলে উপন্যাস
রচনা করেছেন। কবিতায় আধুনিকতা ছিল না; আধুনিকতা এনেছে উপনিবেশ। বাংলায় নাটক
ছিল না; নাটক এনেছে উপনিবেশ। বস্তুত, যা কিছু না থাকা_ সবই পূরণ করে
দিয়েছে উপনিবেশ। উপনিবেশ দিয়েছে ইতিহাস, দর্শন, জাতীয়তার ধারণা। গড়েছে শহর,
রাজধানী। দূর গ্রাম দেশ পর্যন্ত নিয়ে গেছে রেল ও সড়ক। সবচেয়ে বড় কথা,
উপনিবেশ আমাদের দিয়েছে দৃষ্টি এবং দেখার আলো। উপনিবেশই সাতসমুদ্র পাড়ি দিয়ে
আমাদের জন্য এনেছে এনলাইটমেন্ট, রেনেসাঁ, রিফর্মেশন। বলে রাখি, এই যে
সংক্ষিপ্ত তালিকা তার বেশিরভাগই এখন প্রবল চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড়িয়ে আছে।
যারা চ্যালেঞ্জ করছেন, তারা বলছেন, উপনিবেশ মূলত মিথ্যার বেসাতি। কোনো
জাতিকে শাসন-শোষণ করার জন্য শুধু সশস্ত্র সৈন্যবাহিনী আর সুবিধাভোগী-সমর্থক
জনগোষ্ঠী থাকলে হয় না। বরং শাসিত-শোষিত জাতিটিকে মিথ্যা মতাদর্শের আবর্তে
বন্দি করে ফেলতে হয়। আর এই মিথ্যা মতাদর্শের আবর্তই হলো উপনিবেশের টিকে
থাকার মতাদর্শ।
তাহলে আবারও যদি এই প্রশ্ন তুলি যে, উপনিবেশ কী করেছে? উপনিবেশ দেশে দেশে কী করে মূলত? উপনিবেশ মূলত ইতিহাস ভুলিয়ে দেয়। প্রথম আক্রমণেই ইতিহাসের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা ঘটিয়ে নতুন ইতিহাসের মধ্যে নিক্ষেপ করে পুরো জনগোষ্ঠীকে। অন্তত- সতেরো, আঠারো, উনিশ শতকের দখলদারদের কর্মপ্রক্রিয়া তেমনই দেখি সর্বত্র। বিশ শতকে কি আলাদা? কিংবা একবিংশ শতকে? ইরাক বা আফগানিস্তানে ইউরোপীয় ও মার্কিন আগ্রাসন ও দখলদারিত্ব কি এ দেশগুলোর অতীত ও বর্তমানকে পুরো ধ্বংস করে দিয়ে নতুন করে নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু করেনি? অবশ্য, একবিংশ শতকের দুনিয়ায় একটি জনগোষ্ঠীকে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েও নতুন নির্মাণ সম্ভব কি-না সে অন্য তর্ক। কিন্তু বিশ শতকের আগে অল্প আয়াসে ইতিহাসের সঙ্গে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার ঘটনা অহরহই আমরা ঘটতে দেখেছি। বিশ শতকে চেক দেশে সোভিয়েত দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে সোচ্চার লেখক মিলান কুন্ডেরা হয়তো ইতিহাস ও স্মৃতিকেন্দ্রিক এই বিপদের কথা মাথায় রেখেই বলেছিলেন, 'প্রতিপত্তির বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রাম প্রকারান্তরে ভুলে যাওয়ার বিরুদ্ধে মনে রাখারই সংগ্রাম।' এ কথার তাৎপর্য বুঝতে হলে তেমন ঔপনিবেশিক আমলের কথাই আমাদের মনে আনতে হবে। তেমন প্রসঙ্গ উঠলে স্পষ্ট বুঝতে পারি, আমাদের দেশে স্মৃতির বিরুদ্ধে বিস্মৃতির জয় হয়েছে। এবং সঙ্গতকারণেই আধিপত্যবাদী ধারণা ও মতাদর্শের কাছে মানুষের সংগ্রাম পরাজিত হয়েছে।
ইংরেজ কীভাবে বাংলা গদ্য তৈরি করল_ সে গল্পটা শুনুন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও শ্রীরামপুরের ব্যাপ্টিস্ট মিশন উভয়ে নিজ নিজ কাজের সূত্রে বাংলা শিখতে চাইল। কিন্তু ভাষা শিখতে হলে তো গদ্যের বই থাকা চাই। অনেক খুঁজে পেতেও কোনো গদ্যের বই পাওয়া গেল না। জানা গেল, বাংলা গদ্যের অস্তিত্বই নেই। ফলে, তারা কতিপয় সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতকে নিয়োগ করলেন বাংলা গদ্য তৈরি করার জন্য। তারা সংস্কৃতর আদলে বাংলা গদ্য তৈরি করে দিলেন। এ বর্ণনার ফাঁকগুলো লক্ষ্য করার মতো। সাহিত্যে মোটাদাগে মধ্যযুগ বলে যা পরিচিত; সে যুগে কাহিনী, কবিতা, দর্শন, প্রবন্ধ সবই কাব্যে লেখা হতো। বাংলায় যেমন ইংরেজিতেও তেমন। রুশ ভাষাতেও ব্যতিক্রম নেই। সঙ্গত কারণে বাংলায় লেখা কাব্যগুলো তখনকার প্রধান সাহিত্য। কিন্তু তখন তো লোকে চিঠি চালাচালি করত, দলিল-দস্তাবেজ লিখত, সামাজিক আরও নানা কাজে গদ্যের ব্যবহার না থাকার কারণ নেই। পরবর্তীকালের এমন গদ্যের প্রচুর নমুনা আবিষ্কৃত ও প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু সেদিকে ইংরেজদের মন গেল না। তখন লোকে নিশ্চয়ই ছন্দে ছন্দে কথা বলত না। গদ্যেই বলত। সে কথা শোনার অবকাশও নেই ইংরেজদের। ভাষা শিখতে হবে, অতএব সাধারণের ভাষা শিখে লাভ কী? নতুন একটি ভাষা তৈরি করে তা শিখে নেওয়াই তো সবচেয়ে সহজ। লোকের মুখের ভাষা, ব্যবহারিক চিঠিপত্র, দলিলের ভাষা বাদ দিয়ে তারা নতুন ভাষা তৈরির দায়িত্ব দিলেন ভিনভাষী পণ্ডিতদের। তারা সংস্কৃত গড়নে প্রাকৃতজনের ভাষাকে এমনই এক রূপ দিলেন এবং বাংলা ভাষায় সংস্কৃতের অমোচনীয় ছাপ মেরে দিলেন যে, তা থেকে রেহাই পেতে বাংলাকে আজও লড়াই করতে হচ্ছে। ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো আফ্রিকায় স্থানীয় ভাষাগুলোকে লণ্ডভণ্ড করে ধ্বংস করে দিয়েছে। স্থানীয় অধিবাসীরা ইংরেজি বা স্প্যানিশ বা পর্তুগিজ বা ফরাসিকেই গ্রহণ করেছেন। লাতিন আমেরিকায় স্থানীয় ভাষাগুলোর স্থান জবরদখল করেছে স্প্যানিশ। বাংলায় কি ব্যতিক্রম ঘটেছে? এখানে ভাষাকে ধ্বংস করে দেবার বদলে গড়ে দিয়েছে ঔপনিবেশিক শক্তি? এ প্রশ্ন নিশ্চয় উঠবে ভবিষ্যতে; উঠতে শুরু করেছে।
শুধু ভাষা কেন, ক্রমে তো জানা গেল, ইংরেজ দার্শনিকদের চিন্তা চাউর হওয়ার আগে এখানে শক্তিশালী দর্শনের ধারা ছিল। ইতিহাস, একেবারে পাক্কা লিখিত ইতিহাসও ছিল। কবিতা তো ছিলই, নাটকও ছিল। সত্যি কথা বলতে, উপন্যাসও ছিল। সাহিত্যের ক্রমপরিবর্তনের ধারায় কোনো আঙ্গিক হয়তো রূপ বদল করছিল, কোনো আঙ্গিক হয়তো খোলস বদল করে নতুনরূপে প্রকাশিত হওয়ার অপেক্ষায় ছিল। শেষ পর্যন্ত আমাদের আখ্যান-উপাখ্যান উপন্যাসের রূপ পেত কি না_ সে প্রশ্ন অবান্তর। পাঁচালি শেষ পর্যন্ত নাটক হয়ে উঠত কি না_ সে প্রশ্নও ওঠে না। কারণ, ইতিহাসে সে সুযোগ ছিল না। কেননা, একেবারে ছিন্নমূল করে দিয়ে আমাদের সাহিত্যের আধুনিকতার যাত্রা শুরু হয়েছিল। পরবর্তীকালে যখন সাহিত্যের ইতিহাস রচিত হলো, আমরা দেখলাম উপনিবেশের ভিত্তিহীন মিথ্যার বেসাতি। সব প্রণতি ঔপনিবেশিক শক্তির পদতলে চলে গেল। কিন্তু ভিত্তিহীনতার ওপর কি অট্টালিকা তৈরি হয়? যদি আধুনিক যুগের বাংলা সাহিত্যের বিপুল সম্ভারের দিকে তাকাই, তবে দেখব বিশালায়তন অট্টালিকাগুলোই দাঁড়িয়ে আছে সামনে। যদি রায় দেওয়া হয়_ এ ভিত্তিহীন, তবে রায়টা গ্রহণযোগ্য হবে না। এর ভিত্তি উপনিবেশ ও দুই শত বছরের মতাদর্শ। সত্যি বলতে, আমরা তো আমাদের সমাজে, রাষ্ট্রে উপনিবেশের বহু অবদান ও ক্ষত বহন করে চলেছি। তাহলে, সাহিত্যের একার দোষ দেব কেন? আমরা তো সিরাজুদ্দৌলার সেই বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা ফেরত আনতে চাই না। তাহলে, উপন্যাসের জায়গায় কি ফেরত আনা সম্ভব আখ্যান বা উপাখ্যানকে? নাটকের জায়গায় পাঁচালিকে? সতের শতকে যেখানে ছিল বাংলা গদ্য, সেখান থেকে আবার শুরু করা যায়? রাষ্ট্র ও রাজনীতি অফেরতযোগ্য পথে চলে, কিন্তু সাহিত্য তো চলে না। অনেকেই অবশ্য বলেন, আমাদের দেশে ইতিহাসের পথযাত্রা স্পাইরাল। পুরনো ঘটনা নাকি ফিরে ফিরে আসে। তারপরও সবাই এ কথা মানেন যে, রাষ্ট্রের ইতিহাসকে পুরনো খাতে ফেরত আনবার উপায় নেই। সে সম্ভাবনা ক্ষীণ। কিন্তু সাহিত্য তো ব্যক্তি-লেখকের অভিরুচির কাছে দায়বদ্ধ। তাই হয়তো আমরা দেখব, অতিসাম্প্রতিক কালে সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপটে কোনো সাহিত্যিক পাঁচালি লিখছেন। উপন্যাসের চাইতে আখ্যান রচনাকে শ্রেয়তর মনে করছেন। মঙ্গলকাব্যকে পুনর্নির্মাণ করতে চাইছেন। প্রাচীন বাংলার জনজীবনকে আঁকতে চাইছেন। বর্ণনায়-বিষয়ে পালা-পাঁচালি-যাত্রার ছাপ রেখে যেতে চাইছেন। শ্রীচৈতন্য থেকে শুরু করে লালন ও তার পরবর্তীকালে চিন্তাচর্চাকে স্পর্শ করতে চাইছেন। সাহিত্যিক প্রচেষ্টা হিসেবে এগুলোর মূল্য ব্যাপক। আমাদের সাহিত্যের ইতিহাসে যে মিসিং লিংকগুলো আছে সেগুলো পূরণ করার চেষ্টা এগুলো। সাহিত্যমানের বিচারে এগুলো গুরুত্বপূর্ণ_ সন্দেহ নেই। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে এগুলো আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ঔপনিবেশিক শক্তি ও তার তাঁবেদাররা যে মিথ্যা, বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ইতিহাস তৈরি করেছে; তার ভ্রান্তিগুলো ধরিয়ে দেওয়াটাও গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাসের মধুর ও তিক্ত ভুলগুলো থেকে তো শিখতেই হবে আমাদের। আর যদি আমরা ক্রমাগত ক্ষতগুলো আড়াল করেই চলি, সেগুলো আরোগ্যহীন ব্যাধিতে রূপান্তরিত হবে।
বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম উপন্যাসের সূত্রে যদি ১৮৬৫ সালকে আমাদের উপন্যাসের সূচনাকাল বলে গণ্য করি, তবে সেটা দুঃখজনক কথা। সাহিত্যের জনপ্রিয়তম ধারাটির সঙ্গে তুলনীয় কোনো আঙ্গিক আমাদের তাহলে নেই। দেবেশ রায় লিখেছিলেন, দস্তয়েভস্কির উপন্যাস আলোচনা করতে গিয়ে মিখাইল বাখতিন রুশ লোক-আখ্যানের সূত্র উল্লেখ করতে পেরেছিলেন। যেসব জাতি কখনও ঔপনিবেশিক শক্তির শিকারে পরিণত হয়নি, তাদের সবার ক্ষেত্রেই প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় গীতিকা, আখ্যানই উপন্যাসের পথে যাত্রা করেছে। আমাদের ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটিয়েছে উপনিবেশ। কিন্তু উপনিবেশের বিধিলিপি আজ অব্দি মেনে চলার কোনো দায় কি আমাদের আছে? এখন যদি সাহিত্যের ছেড়ে আসা ইতিহাসের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের কাজ শুরু হয়, তবে দোষ কোথায়? উপন্যাসের একটা বড় চাহিদা তো জাতীয়, স্থানীয় বৈশিষ্ট্য গ্রহণ করা। একই সঙ্গে সাম্প্রতিক হয়ে ওঠা। যদি তা-ই হয়, তবে পাঁচালি, মঙ্গলকাব্য, আখ্যান, গীতিকবিতা থেকে বাংলা উপন্যাস যদি শক্তি সঞ্চয় করে, তবে তা আশাব্যঞ্জক ঘটনা বলেই গণ্য হবে।
আমরা ছিলাম কাক। ঔপনিবেশিক শক্তি আমাদের ময়ূরপুচ্ছ পরিয়ে গেছে। আমরা তো শত শত বছর ওই মিথ্যা ময়ূর সেজে থাকতে পারি না। ময়ূরপুচ্ছ নিশ্চয় আমরা পরব। কিন্তু ভেতরে ভালো কাক হওয়ার বাসনাটা কি এতকাল পরেও আসবে না?
তাহলে আবারও যদি এই প্রশ্ন তুলি যে, উপনিবেশ কী করেছে? উপনিবেশ দেশে দেশে কী করে মূলত? উপনিবেশ মূলত ইতিহাস ভুলিয়ে দেয়। প্রথম আক্রমণেই ইতিহাসের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা ঘটিয়ে নতুন ইতিহাসের মধ্যে নিক্ষেপ করে পুরো জনগোষ্ঠীকে। অন্তত- সতেরো, আঠারো, উনিশ শতকের দখলদারদের কর্মপ্রক্রিয়া তেমনই দেখি সর্বত্র। বিশ শতকে কি আলাদা? কিংবা একবিংশ শতকে? ইরাক বা আফগানিস্তানে ইউরোপীয় ও মার্কিন আগ্রাসন ও দখলদারিত্ব কি এ দেশগুলোর অতীত ও বর্তমানকে পুরো ধ্বংস করে দিয়ে নতুন করে নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু করেনি? অবশ্য, একবিংশ শতকের দুনিয়ায় একটি জনগোষ্ঠীকে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েও নতুন নির্মাণ সম্ভব কি-না সে অন্য তর্ক। কিন্তু বিশ শতকের আগে অল্প আয়াসে ইতিহাসের সঙ্গে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার ঘটনা অহরহই আমরা ঘটতে দেখেছি। বিশ শতকে চেক দেশে সোভিয়েত দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে সোচ্চার লেখক মিলান কুন্ডেরা হয়তো ইতিহাস ও স্মৃতিকেন্দ্রিক এই বিপদের কথা মাথায় রেখেই বলেছিলেন, 'প্রতিপত্তির বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রাম প্রকারান্তরে ভুলে যাওয়ার বিরুদ্ধে মনে রাখারই সংগ্রাম।' এ কথার তাৎপর্য বুঝতে হলে তেমন ঔপনিবেশিক আমলের কথাই আমাদের মনে আনতে হবে। তেমন প্রসঙ্গ উঠলে স্পষ্ট বুঝতে পারি, আমাদের দেশে স্মৃতির বিরুদ্ধে বিস্মৃতির জয় হয়েছে। এবং সঙ্গতকারণেই আধিপত্যবাদী ধারণা ও মতাদর্শের কাছে মানুষের সংগ্রাম পরাজিত হয়েছে।
ইংরেজ কীভাবে বাংলা গদ্য তৈরি করল_ সে গল্পটা শুনুন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও শ্রীরামপুরের ব্যাপ্টিস্ট মিশন উভয়ে নিজ নিজ কাজের সূত্রে বাংলা শিখতে চাইল। কিন্তু ভাষা শিখতে হলে তো গদ্যের বই থাকা চাই। অনেক খুঁজে পেতেও কোনো গদ্যের বই পাওয়া গেল না। জানা গেল, বাংলা গদ্যের অস্তিত্বই নেই। ফলে, তারা কতিপয় সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতকে নিয়োগ করলেন বাংলা গদ্য তৈরি করার জন্য। তারা সংস্কৃতর আদলে বাংলা গদ্য তৈরি করে দিলেন। এ বর্ণনার ফাঁকগুলো লক্ষ্য করার মতো। সাহিত্যে মোটাদাগে মধ্যযুগ বলে যা পরিচিত; সে যুগে কাহিনী, কবিতা, দর্শন, প্রবন্ধ সবই কাব্যে লেখা হতো। বাংলায় যেমন ইংরেজিতেও তেমন। রুশ ভাষাতেও ব্যতিক্রম নেই। সঙ্গত কারণে বাংলায় লেখা কাব্যগুলো তখনকার প্রধান সাহিত্য। কিন্তু তখন তো লোকে চিঠি চালাচালি করত, দলিল-দস্তাবেজ লিখত, সামাজিক আরও নানা কাজে গদ্যের ব্যবহার না থাকার কারণ নেই। পরবর্তীকালের এমন গদ্যের প্রচুর নমুনা আবিষ্কৃত ও প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু সেদিকে ইংরেজদের মন গেল না। তখন লোকে নিশ্চয়ই ছন্দে ছন্দে কথা বলত না। গদ্যেই বলত। সে কথা শোনার অবকাশও নেই ইংরেজদের। ভাষা শিখতে হবে, অতএব সাধারণের ভাষা শিখে লাভ কী? নতুন একটি ভাষা তৈরি করে তা শিখে নেওয়াই তো সবচেয়ে সহজ। লোকের মুখের ভাষা, ব্যবহারিক চিঠিপত্র, দলিলের ভাষা বাদ দিয়ে তারা নতুন ভাষা তৈরির দায়িত্ব দিলেন ভিনভাষী পণ্ডিতদের। তারা সংস্কৃত গড়নে প্রাকৃতজনের ভাষাকে এমনই এক রূপ দিলেন এবং বাংলা ভাষায় সংস্কৃতের অমোচনীয় ছাপ মেরে দিলেন যে, তা থেকে রেহাই পেতে বাংলাকে আজও লড়াই করতে হচ্ছে। ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো আফ্রিকায় স্থানীয় ভাষাগুলোকে লণ্ডভণ্ড করে ধ্বংস করে দিয়েছে। স্থানীয় অধিবাসীরা ইংরেজি বা স্প্যানিশ বা পর্তুগিজ বা ফরাসিকেই গ্রহণ করেছেন। লাতিন আমেরিকায় স্থানীয় ভাষাগুলোর স্থান জবরদখল করেছে স্প্যানিশ। বাংলায় কি ব্যতিক্রম ঘটেছে? এখানে ভাষাকে ধ্বংস করে দেবার বদলে গড়ে দিয়েছে ঔপনিবেশিক শক্তি? এ প্রশ্ন নিশ্চয় উঠবে ভবিষ্যতে; উঠতে শুরু করেছে।
শুধু ভাষা কেন, ক্রমে তো জানা গেল, ইংরেজ দার্শনিকদের চিন্তা চাউর হওয়ার আগে এখানে শক্তিশালী দর্শনের ধারা ছিল। ইতিহাস, একেবারে পাক্কা লিখিত ইতিহাসও ছিল। কবিতা তো ছিলই, নাটকও ছিল। সত্যি কথা বলতে, উপন্যাসও ছিল। সাহিত্যের ক্রমপরিবর্তনের ধারায় কোনো আঙ্গিক হয়তো রূপ বদল করছিল, কোনো আঙ্গিক হয়তো খোলস বদল করে নতুনরূপে প্রকাশিত হওয়ার অপেক্ষায় ছিল। শেষ পর্যন্ত আমাদের আখ্যান-উপাখ্যান উপন্যাসের রূপ পেত কি না_ সে প্রশ্ন অবান্তর। পাঁচালি শেষ পর্যন্ত নাটক হয়ে উঠত কি না_ সে প্রশ্নও ওঠে না। কারণ, ইতিহাসে সে সুযোগ ছিল না। কেননা, একেবারে ছিন্নমূল করে দিয়ে আমাদের সাহিত্যের আধুনিকতার যাত্রা শুরু হয়েছিল। পরবর্তীকালে যখন সাহিত্যের ইতিহাস রচিত হলো, আমরা দেখলাম উপনিবেশের ভিত্তিহীন মিথ্যার বেসাতি। সব প্রণতি ঔপনিবেশিক শক্তির পদতলে চলে গেল। কিন্তু ভিত্তিহীনতার ওপর কি অট্টালিকা তৈরি হয়? যদি আধুনিক যুগের বাংলা সাহিত্যের বিপুল সম্ভারের দিকে তাকাই, তবে দেখব বিশালায়তন অট্টালিকাগুলোই দাঁড়িয়ে আছে সামনে। যদি রায় দেওয়া হয়_ এ ভিত্তিহীন, তবে রায়টা গ্রহণযোগ্য হবে না। এর ভিত্তি উপনিবেশ ও দুই শত বছরের মতাদর্শ। সত্যি বলতে, আমরা তো আমাদের সমাজে, রাষ্ট্রে উপনিবেশের বহু অবদান ও ক্ষত বহন করে চলেছি। তাহলে, সাহিত্যের একার দোষ দেব কেন? আমরা তো সিরাজুদ্দৌলার সেই বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা ফেরত আনতে চাই না। তাহলে, উপন্যাসের জায়গায় কি ফেরত আনা সম্ভব আখ্যান বা উপাখ্যানকে? নাটকের জায়গায় পাঁচালিকে? সতের শতকে যেখানে ছিল বাংলা গদ্য, সেখান থেকে আবার শুরু করা যায়? রাষ্ট্র ও রাজনীতি অফেরতযোগ্য পথে চলে, কিন্তু সাহিত্য তো চলে না। অনেকেই অবশ্য বলেন, আমাদের দেশে ইতিহাসের পথযাত্রা স্পাইরাল। পুরনো ঘটনা নাকি ফিরে ফিরে আসে। তারপরও সবাই এ কথা মানেন যে, রাষ্ট্রের ইতিহাসকে পুরনো খাতে ফেরত আনবার উপায় নেই। সে সম্ভাবনা ক্ষীণ। কিন্তু সাহিত্য তো ব্যক্তি-লেখকের অভিরুচির কাছে দায়বদ্ধ। তাই হয়তো আমরা দেখব, অতিসাম্প্রতিক কালে সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপটে কোনো সাহিত্যিক পাঁচালি লিখছেন। উপন্যাসের চাইতে আখ্যান রচনাকে শ্রেয়তর মনে করছেন। মঙ্গলকাব্যকে পুনর্নির্মাণ করতে চাইছেন। প্রাচীন বাংলার জনজীবনকে আঁকতে চাইছেন। বর্ণনায়-বিষয়ে পালা-পাঁচালি-যাত্রার ছাপ রেখে যেতে চাইছেন। শ্রীচৈতন্য থেকে শুরু করে লালন ও তার পরবর্তীকালে চিন্তাচর্চাকে স্পর্শ করতে চাইছেন। সাহিত্যিক প্রচেষ্টা হিসেবে এগুলোর মূল্য ব্যাপক। আমাদের সাহিত্যের ইতিহাসে যে মিসিং লিংকগুলো আছে সেগুলো পূরণ করার চেষ্টা এগুলো। সাহিত্যমানের বিচারে এগুলো গুরুত্বপূর্ণ_ সন্দেহ নেই। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে এগুলো আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ঔপনিবেশিক শক্তি ও তার তাঁবেদাররা যে মিথ্যা, বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ইতিহাস তৈরি করেছে; তার ভ্রান্তিগুলো ধরিয়ে দেওয়াটাও গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাসের মধুর ও তিক্ত ভুলগুলো থেকে তো শিখতেই হবে আমাদের। আর যদি আমরা ক্রমাগত ক্ষতগুলো আড়াল করেই চলি, সেগুলো আরোগ্যহীন ব্যাধিতে রূপান্তরিত হবে।
বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম উপন্যাসের সূত্রে যদি ১৮৬৫ সালকে আমাদের উপন্যাসের সূচনাকাল বলে গণ্য করি, তবে সেটা দুঃখজনক কথা। সাহিত্যের জনপ্রিয়তম ধারাটির সঙ্গে তুলনীয় কোনো আঙ্গিক আমাদের তাহলে নেই। দেবেশ রায় লিখেছিলেন, দস্তয়েভস্কির উপন্যাস আলোচনা করতে গিয়ে মিখাইল বাখতিন রুশ লোক-আখ্যানের সূত্র উল্লেখ করতে পেরেছিলেন। যেসব জাতি কখনও ঔপনিবেশিক শক্তির শিকারে পরিণত হয়নি, তাদের সবার ক্ষেত্রেই প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় গীতিকা, আখ্যানই উপন্যাসের পথে যাত্রা করেছে। আমাদের ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটিয়েছে উপনিবেশ। কিন্তু উপনিবেশের বিধিলিপি আজ অব্দি মেনে চলার কোনো দায় কি আমাদের আছে? এখন যদি সাহিত্যের ছেড়ে আসা ইতিহাসের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের কাজ শুরু হয়, তবে দোষ কোথায়? উপন্যাসের একটা বড় চাহিদা তো জাতীয়, স্থানীয় বৈশিষ্ট্য গ্রহণ করা। একই সঙ্গে সাম্প্রতিক হয়ে ওঠা। যদি তা-ই হয়, তবে পাঁচালি, মঙ্গলকাব্য, আখ্যান, গীতিকবিতা থেকে বাংলা উপন্যাস যদি শক্তি সঞ্চয় করে, তবে তা আশাব্যঞ্জক ঘটনা বলেই গণ্য হবে।
আমরা ছিলাম কাক। ঔপনিবেশিক শক্তি আমাদের ময়ূরপুচ্ছ পরিয়ে গেছে। আমরা তো শত শত বছর ওই মিথ্যা ময়ূর সেজে থাকতে পারি না। ময়ূরপুচ্ছ নিশ্চয় আমরা পরব। কিন্তু ভেতরে ভালো কাক হওয়ার বাসনাটা কি এতকাল পরেও আসবে না?
Sunday, April 8, 2012
অবশ্যই যা বলতে হবে :: গুন্টার গ্রাস
নোবেল বিজয়ী ঔপন্যাসিক ও সাহিত্যিক গুন্টার গ্রাসের 'হোয়াট মাস্ট বি
সেইড' কবিতাটি এখন বিশ্বজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রে। ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি
হামলার প্রস্তুতির বিপক্ষে সবচেয়ে কার্যকর প্রতিবাদ হিসেবে এ কবিতার কথাই
উচ্চারিত হচ্ছে। এটা বিশ্বজুড়ে এতটাই প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পেরেছে যে,
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুও আর চুপ থাকতে পারেননি।
বলেছেন, একই পাল্লায় ইসরায়েল ও ইরানকে মেপে গ্রাস এক লজ্জাজনক ঘটনার জন্ম
দিয়েছেন। তার মতে, এই কবিতা ইসরায়েলের কথা যতটা বলেছে, তার চেয়ে বেশি বলেছে
গ্রাসের নিজের কথা। নেতানিয়াহুর মতে, ইসরায়েল নয়, ইরানই বিশ্বশান্তির জন্য
হুমকি। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ব্যক্তিগত আক্রমণ করতেও ছাড়েননি। বলেছেন,
এই গুন্টার গ্রাসই ছয় দশক ধরে গোপন রেখেছিলেন যে তিনি নাৎসি সংগঠন ওয়েপেন
এসএস-এর সদস্য ছিলেন। তার পক্ষে একমাত্র ইহুদি রাষ্ট্রটিকে বিশ্বশান্তির
জন্য হুমকি মনে করা বিস্ময়কর ঘটনা নয়। গুন্টার গ্রাসের জন্ম ১৯২৭ সালে। তার এই কবিতাটি সুডয়েটসে শাইটুংয়ে প্রথম প্রকাশিত হয়।
কেন আমি চুপ করে আছি?
সোজাসাপ্টা নয়তো ভঙ্গিভাট্টা করেই
তব্দা হয়ে আছি দীর্ঘ সময়,
যেন টিকে থাকার প্রান্তসীমায়
বড়জোর পাদটীকা হয়ে বেঁচে আছি।
দুর্বলকে ভয় দেখিয়ে কাত করো-
সংগঠিত আর আহ্লাদি এমন নির্দেশে
শানানো হচ্ছে প্রথম হামলার অধিকার,
এতে উন্মূল হয়ে যাবে ইরানিরা
কারণ ওদের কোনো বর্তুল ভবনে নাকি
সন্দেহজনক বোমা রাখা আছে।
কেন আমি নিজেকে বলছি_
ওই অন্য দেশটিকে নাম ধরে ডাকো
যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ_ তারা নিভৃতে, নীরবে
তৈরি করেছে পারমাণবিক বোমা।
কিন্তু সে বোমাই কেন অনিয়ন্ত্রিত বলে গণ্য হবে,
শুধু পরীক্ষিত হয়নি বলে?
আর সবার নীরবতার নিচে
চাপা পড়ে আছে আমার নীরবতাও
অপমানিত-লাঞ্ছিত
মুখ খুললেই মিথ্যা দমন ও দোষারোপ
বিধান দেয়াই আছে_
অ্যান্টি-সেমেটিক দণ্ড ঝুলবে মাথার ওপর।
আমার নিজের দেশ
ক্ষমাহীন নিজস্ব অপরাধে
যখন তখন গালি খায় আর
জরিমানা গোনে,
কেবলই বিশুদ্ধ বাণিজ্যিক স্বার্থে
ক্ষিপ্র ঠোঁটে ঘোষিত হয়েছে পুনর্বাসিত বলে
আমার দেশ ডুবোজাহাজ দেবে ইসরায়েলকে
যার মাথায় থাকবে মারাত্মক ক্ষেপণাস্ত্র।
মারা হবে সেখানে, যেখানে
একটা একাকী আণবিক বোমার অস্তিত্বও অপ্রমাণিত
এখন অপ্রমাণই হতে চলেছে অকাট্য যুক্তি
ফলে আমি বলি, কথাটা বলতেই হবে এখন
কিন্তু কেন আমি একটু আগেও চুপ করে ছিলাম?
আমি ভেবেছি আমার অতীত, শরীরে অমোচনীয় কলঙ্করেখা
ভেবেছি_ ইসরায়েলের মতো দেশ_
এখন আর সবসময় যার সঙ্গে আমার সংযোগ
মেনে নেবে সত্যের সর্বজনীন ঘোষণা
কেন এখনই, এই শেষকালে ঠেকে
শেষ কালিটুকুতে বলছি আমি_
আণবিক ইসরায়েল ইতিমধ্যে বিপন্ন করে তুলেছে
ভঙ্গুর বিশ্বশান্তির শেষ আশাটুকু?
কেননা, এটা এখন বলতেই হবে
আগামীকাল হয়তো বড্ড দেরি হয়ে যাবে
আর এ-ও এক সঙ্গত কারণ যে আমরা,
জার্মানরা ইতিমধ্যে অনেক ভারাক্রান্ত হয়ে আছি
ফলে অপরাধ করার জন্য যে কোনো অজুহাতে অস্ত্র দেওয়া
দুষ্কর্মে সজ্ঞান সহযোগিতা বলেই গণ্য হবে
আর পারছি না
পশ্চিমের ভণ্ডামি দেখে দেখে পরিশ্রান্ত আমি
তবুও আশা থাকছে, হয়তো অনেকে নীরবতার জঞ্জাল থেকে
ছিন্ন হয়ে ভাববে আসন্ন বিপদের কথা,
বিরুদ্ধে দাঁড়াবে সহিংসতার।
ইসরায়েলের আণবিক শক্তির
স্থায়ী ও অপ্রতিরোধ্য বাড় নিয়ে
আর ইরানের আণবিক শক্তি নিয়েও
রফা হবে, আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতায়
দুই দেশের সম্মতিক্রমে
কেবল তখনই ইসরায়েলি আর ফিলিস্তিনিরা
ওই অঞ্চলে বসবাসরত সকল মানুষ
প্রতারণায় অধিকৃত হয়ে
যারা ঘনিষ্ঠভাবে বাস করে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ শত্রুর সঙ্গে
তখনই কেবল তারা আমাদের সহায় হতে পারে।
সোজাসাপ্টা নয়তো ভঙ্গিভাট্টা করেই
তব্দা হয়ে আছি দীর্ঘ সময়,
যেন টিকে থাকার প্রান্তসীমায়
বড়জোর পাদটীকা হয়ে বেঁচে আছি।
দুর্বলকে ভয় দেখিয়ে কাত করো-
সংগঠিত আর আহ্লাদি এমন নির্দেশে
শানানো হচ্ছে প্রথম হামলার অধিকার,
এতে উন্মূল হয়ে যাবে ইরানিরা
কারণ ওদের কোনো বর্তুল ভবনে নাকি
সন্দেহজনক বোমা রাখা আছে।
কেন আমি নিজেকে বলছি_
ওই অন্য দেশটিকে নাম ধরে ডাকো
যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ_ তারা নিভৃতে, নীরবে
তৈরি করেছে পারমাণবিক বোমা।
কিন্তু সে বোমাই কেন অনিয়ন্ত্রিত বলে গণ্য হবে,
শুধু পরীক্ষিত হয়নি বলে?
আর সবার নীরবতার নিচে
চাপা পড়ে আছে আমার নীরবতাও
অপমানিত-লাঞ্ছিত
মুখ খুললেই মিথ্যা দমন ও দোষারোপ
বিধান দেয়াই আছে_
অ্যান্টি-সেমেটিক দণ্ড ঝুলবে মাথার ওপর।
আমার নিজের দেশ
ক্ষমাহীন নিজস্ব অপরাধে
যখন তখন গালি খায় আর
জরিমানা গোনে,
কেবলই বিশুদ্ধ বাণিজ্যিক স্বার্থে
ক্ষিপ্র ঠোঁটে ঘোষিত হয়েছে পুনর্বাসিত বলে
আমার দেশ ডুবোজাহাজ দেবে ইসরায়েলকে
যার মাথায় থাকবে মারাত্মক ক্ষেপণাস্ত্র।
মারা হবে সেখানে, যেখানে
একটা একাকী আণবিক বোমার অস্তিত্বও অপ্রমাণিত
এখন অপ্রমাণই হতে চলেছে অকাট্য যুক্তি
ফলে আমি বলি, কথাটা বলতেই হবে এখন
কিন্তু কেন আমি একটু আগেও চুপ করে ছিলাম?
আমি ভেবেছি আমার অতীত, শরীরে অমোচনীয় কলঙ্করেখা
ভেবেছি_ ইসরায়েলের মতো দেশ_
এখন আর সবসময় যার সঙ্গে আমার সংযোগ
মেনে নেবে সত্যের সর্বজনীন ঘোষণা
কেন এখনই, এই শেষকালে ঠেকে
শেষ কালিটুকুতে বলছি আমি_
আণবিক ইসরায়েল ইতিমধ্যে বিপন্ন করে তুলেছে
ভঙ্গুর বিশ্বশান্তির শেষ আশাটুকু?
কেননা, এটা এখন বলতেই হবে
আগামীকাল হয়তো বড্ড দেরি হয়ে যাবে
আর এ-ও এক সঙ্গত কারণ যে আমরা,
জার্মানরা ইতিমধ্যে অনেক ভারাক্রান্ত হয়ে আছি
ফলে অপরাধ করার জন্য যে কোনো অজুহাতে অস্ত্র দেওয়া
দুষ্কর্মে সজ্ঞান সহযোগিতা বলেই গণ্য হবে
আর পারছি না
পশ্চিমের ভণ্ডামি দেখে দেখে পরিশ্রান্ত আমি
তবুও আশা থাকছে, হয়তো অনেকে নীরবতার জঞ্জাল থেকে
ছিন্ন হয়ে ভাববে আসন্ন বিপদের কথা,
বিরুদ্ধে দাঁড়াবে সহিংসতার।
ইসরায়েলের আণবিক শক্তির
স্থায়ী ও অপ্রতিরোধ্য বাড় নিয়ে
আর ইরানের আণবিক শক্তি নিয়েও
রফা হবে, আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতায়
দুই দেশের সম্মতিক্রমে
কেবল তখনই ইসরায়েলি আর ফিলিস্তিনিরা
ওই অঞ্চলে বসবাসরত সকল মানুষ
প্রতারণায় অধিকৃত হয়ে
যারা ঘনিষ্ঠভাবে বাস করে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ শত্রুর সঙ্গে
তখনই কেবল তারা আমাদের সহায় হতে পারে।
ভাষান্তর : মাহবুব মোর্শেদ
Saturday, April 7, 2012
শহরভেদে জীবনযাত্রার ব্যয়
বিশ্বব্যাপী বাজারদরের নানা বিষয় নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে
যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টিক পত্রিকা। তাতে চমৎকৃত হওয়ার মতো বেশ কিছু তথ্য
আছে। কিন্তু চমকপ্রদ তথ্যের বাইরে আটলান্টিকের অনুসন্ধানের বিষয় শহরে শহরে
জীবনযাত্রার ব্যয়ভার কীভাবে বাড়ে। তবে বাজার নিয়ে সেসব তাত্তি্বক আলোচনায়
যাওয়ার আগে কিছু তথ্য নিয়ে আলোচনা করা যাক। আটলান্টিক জানাচ্ছে,
ম্যানহাটানের একজন আয়ার আয় নাকি বছরে ২ লাখ ডলার। আয়াদের বলা হয় ন্যানি।
তবে এই ন্যানিরা বাচ্চা দেখাশোনার জন্য নিযুক্ত সাধারণ আয়া নন। তারা বাচ্চা
দেখাশোনা তো করেনই, এমনকি চার রকমের বাহারি রান্নায়ও দক্ষ। কিন্তু
ম্যানহাটানের ন্যানিরা কি শুধু তাদের গুণের জন্যই এত বেতন পান?
রান্নাবান্না জানা, বাচ্চাদের প্রতি যত্নশীল ন্যানি তো পাওয়াই যায়। সবাই তো
আর বছরে ২ লাখ ডলার আয় করেন না। কিন্তু ম্যানহাটানেই ন্যানিদের এই রমরমা
কেন। উত্তরটা খুব সোজা। ম্যানহাটানের ধনীরা ন্যানিদের ওই বেতন দিতে সক্ষম।
উন্নত ও আধুনিক যোগাযোগ পদ্ধতির কারণে বিশ্ববাজারে জিনিসপত্রের দাম
মোটামুটি একই। এটা হতেই পারে না যে, পেরুর রাজধানী লিমায় সোনার দাম একরকম
আর যুক্তরাষ্ট্রে অন্য। সোনার দামে হেরফের হলে ব্যবসায়ীরা মুনাফা তৎক্ষণাৎ
তুলে নিতে চেষ্টা করেন। আর বৈশ্বিক চাপে সোনার দাম মোটামুটি এককাতারে নেমে
আসে। গাড়ি হোক কিংবা পিকাসোর ছবি। তার দাম নিউইয়র্কে যেমন, সেনঝেনেও তেমন
হতে বাধ্য। বাংলাদেশেও আমরা অহরহ বিশ্ববাজারের গল্প শুনি। বিশ্ববাজারে
তেলের দাম বাড়লে আমাদের এখানেও পাল্লা দিয়ে বাড়ে। গাড়ির দাম বাড়লেও একই
কথা। তবে আমাদের বাজার দাম কমলে ক্রেতাদের সঙ্গে রসিকতা করে। নিজে থেকে দাম
আর কমে না। এই যে বিশ্ববাজারের সমান দরে আমরা জিনিসপত্র কিনছি তবু আমাদের
জীবনযাত্রার ব্যয় কীভাবে জুরিখ বা ওয়াশিংটনের একজন ক্রেতার ব্যয় থেকে কম
থাকছে? জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধির সূত্রটিকে বলা হয় বালাসা-স্যামুয়েলশন
এফেক্ট। বেলা বালাসা আর পল স্যামুয়েলশন_ এ দুই অর্থনীতিবিদ এই তত্ত্বটি
দিয়েছিলেন। আটলান্টিক বলছে, একে সহজভাবে ন্যানি এফেক্ট নামে অভিহিত করা
যায়। এই তত্ত্ব বলছে, তেলের দাম, সোনার দাম, স্টকে কোম্পানির শেয়ারের দাম,
কিংবা পিকাসোর ছবির দাম জায়গায় জায়গায় খুব বেশি হেরফের হয় না। কিন্তু যে
জিনিস স্থানীয়ভাবে তৈরি হয়ে স্থানীয়ভাবেই বাজারজাত হয় তার ভিত্তিতেই
জীবনযাত্রার ব্যয়ভার বেড়ে যায়। ঢাকায় একজন আয়ার খরচ আর নিউইয়র্কের আয়ার খরচ
এক হবে না। চুল কাটা, রেস্টুরেন্টে খাবারের দাম থেকে শুরু করে স্থানীয়ভাবে
যা কিছু কিনে আমরা ভোগ করি, সব মিলিয়ে এই প্রভেদটা সৃষ্টি হয়। কিন্তু
প্রশ্ন হলো, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত জিনিসের দাম কখন বাড়তে থাকে। ওই ন্যানি
এফেক্ট তত্ত্ব বলছে, এটা আবার নির্ভর করে বাইরের নিয়ামকের ওপর। স্থানীয়
বাজারে উৎপাদিত কতটা পণ্য বাইরে যায় তার ওপর নির্ভর করে স্থানীয় সেবার দাম
কতটা বাড়বে। যেমন ভারতে ব্যয়ভার ক্রমাগত বাড়ছে। কারণ দেশটিতে উৎপাদিত পণ্য
বাইরে রফতানি হয়ে যাচ্ছে বিপুল পরিমাণে। স্থানীয়ভাবে এমন প্রতিষ্ঠান তৈরি
হচ্ছে যা লাভজনক। তারা এমন ব্যক্তিদের নিয়োগ দিচ্ছে যাদের ক্রয়ক্ষমতা বেশি।
তারা বাজারে গিয়ে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে তুলছেন। বেশি দামকে অনুমোদন
করছেন। কিন্তু ন্যানি এফেক্টের বাইরেও আছে অনেক কিছু। হয়তো বাড়ির দাম ততটা
বাড়ার কথা নয়। কিন্তু বাড়ছে। এমন নগর পরিকল্পনা হচ্ছে যে, লোকজন বেশি দামে
বাড়ি কিনতে বাধ্য হচ্ছে। জ্বালানি নীতির কারণেও হেরফের হচ্ছে বাজারে।
ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণের দক্ষতার ওপরও নির্ভর করে অনেক কিছু। সব মিলিয়ে
জীবনযাত্রায় ব্যয়ভার বেড়ে যায় বা স্থিতাবস্থায় থাকে। কিন্তু এত সব
তথ্য-তত্ত্বের বোধহয় অনেক কিছুই খাটবে না ঢাকার ক্ষেত্রে। কেননা এখানে
বাজার অনেক সময়ই বাজারের নিয়মে চলে না। নিয়ামক অন্য কিছু হলে তথ্য ও
তত্ত্বের বদলে অন্য ব্যবস্থার খোঁজ পড়ে। কিন্তু সে ব্যবস্থাও এখানে দুর্লভ।
Subscribe to:
Posts (Atom)