বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশে প্রত্যাশিত পাঠক সমাজ গড়ে ওঠেনি। এই তথ্যে হতাশা ও
আশাবাদ দুই-ই আছে। প্রতি ফেব্রুয়ারির বইমেলায় গত কয়েক বছর ধরে তিন
হাজারেরও বেশি বই প্রকাশিত হচ্ছে। প্রকাশকরা পয়সা খরচ করে বই প্রকাশ করছেন,
স্টল নিয়ে বসছেন, পাঠকরা মেলায় আসছেন, বছরভর বিপণনের নানা কসরত চলছে। পাঠক
যদি না-ই থাকে তবে এত এত বই প্রকাশিত হচ্ছে কেন? তার চেয়ে বড় কথা, এ দেশে
অন্তত ৫ থেকে ১০ জন লেখক আছেন যাদের বই ৫ হাজার কপির ওপরে চলে। একজন লেখকের
বই নিশ্চিতভাবেই ৩০ থেকে ৫০ হাজার কপি চলে। পাঠক সমাজ গড়ে ওঠেনি, এমন কথার
তাহলে ভিত্তি কোথায়? যে বইগুলোর পসার ভালো_ তালিকা করলে দেখা যাবে তাদের
সংখ্যা ২৫টির বেশি হবে না। অথচ বইমেলায় প্রকাশিত হচ্ছে তিন থেকে চার হাজার
বই। বিপুলসংখ্যক বইয়ের মধ্যে অনেকগুলোই হয়তো প্রকাশিত হওয়ার যোগ্য নয়,
পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতোও নয়। কিন্তু ঝাড়াই-বাছাই করে মেলায় কি
শ'খানেক বইও মিলবে না, যেগুলো পাঠকের মনোযোগ পেতে পারে। সকলেই স্বীকার
করবেন, পাঠক-নন্দিত বইগুলোর বাইরে অন্তত শ'খানেক, এমনকি তারও বেশি বই
পাঠকের দৃষ্টিতে পড়তেই পারত। জনপ্রিয় উপন্যাসের বাইরেও ভালো উপন্যাস
প্রকাশিত হয়। সাক্ষাৎকার, অনুবাদ, ভ্রমণ, জার্নাল, গল্প, কবিতাও প্রকাশিত
হয় এন্তার। অনেক প্রকাশক গুরুত্ব দিয়ে বিদগ্ধ চিন্তাবিদ, সাহিত্যিক,
সাংবাদিকদের প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। প্রকাশকদের সূত্রে জানা যায়, আগে
চিন্তাশীল বইগুলো নিশ্চিন্তে এক হাজার কপি বিক্রি হয়ে যেত। কিন্তু এখন এসব
বইয়ের গড় বিক্রি নেমে এসেছে তিনশ'-পাঁচশ' কপির কোটায়। বাজারের পরিস্থিতি
বলে, কিছু উপন্যাসের পাঠক বাড়লেও গড়ে পাঠক কমেছে। জনসংখ্যা বেড়েছে,
সাক্ষরতা বেড়েছে, উচ্চশিক্ষার হার বেড়েছে, সংবাদপত্রের পাঠক বেড়েছে_
সংখ্যাতত্ত্ব অনুসারে কিন্তু পাঠকও বাড়ার কথা। যে ধরনের বই আগে ২০ হাজার
কপি চলত সে বই এখন ৫০ হাজার চলার কথা। আর যে বই এক হাজার কপি চলত তা এখন
অন্তত দেড় হাজার তো চলবে? কিন্তু সংখ্যাটা ৫শ'তে নেমে আসবে কেন? ইলেকট্রনিক
মিডিয়ার বিকাশ ঘটেছে, ইন্টারনেট মাধ্যম এগিয়ে এসেছে_ নগরজীবনে বইয়ের
গুরুত্ব হ্রাস পেয়েছে, সবই সত্য। তবু বিদ্বৎসমাজের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বলে
বিবেচিত হওয়ার পরও একটি বইয়ের বিক্রি ৫শ'তে এসে ঠেকে যাবে, এ যেন
অবিশ্বাস্য এক হিসাব। কিন্তু ঘটছে বাস্তবে তা-ই। কেন এমন ঘটল? বইয়ের
প্রচারে কিন্তু কমতি নেই। সারাবছর বই নিয়ে প্রায় নিশ্চুপ থাকলেও
গণমাধ্যমগুলো কিন্তু ফেব্রুয়ারিতে বেশ সরব। প্রায় সব টিভিই বইমেলা থেকে
সরাসরি সম্প্রচার করে। লেখকদের সাক্ষাৎকার নেয়। বইয়ের প্রচ্ছদ দেখায়।
দৈনিকগুলোতে বিশেষ কর্নারে বইয়ের মেলা ও বইয়ের খবর প্রচারিত হয়। তবু বইয়ের
বিক্রি বাড়ছে না। কেন? একজন বললেন, টিভিগুলো বইমেলা থেকে সরাসরি সম্প্রচার
করে বটে। কিন্তু সেগুলো দেখে কি বোঝায় উপায় আছে কোন বইটি কিনব? জনপ্রিয়
বইগুলোর কথা সবাই জানে। কিন্তু অন্য বইগুলোর মধ্যে কোনটা ভালো, কোনটা
দরকারি তা বোঝার উপায় কি সত্যিই টিভির অনুষ্ঠানগুলোতে থাকে? বই কি লোকে
প্রচ্ছদ দেখে কেনে? নাকি লেখকের চেহারা দেখে কেনে? অধিকাংশ টিভি অনুষ্ঠানই
কিন্তু ভালো বইগুলোকে সামনে আনতে পারে না। অথবা ভালো বই বাছার কোনো
ব্যবস্থাই তাদের নেই। এমনকি সংবাদপত্রগুলোতেও ভালো বই, ভালো লেখকদের বই
বাছাই করে তার খবরের ব্যবস্থা কমই থাকে। কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে বই চেনার
জন্য গণমাধ্যমের উদ্যোগ তেমন কাজে আসে না। মেলায় গিয়ে একজন সাধারণ পাঠক ৩
হাজার বইয়ের সমুদ্রে পড়ে যান। নিরুপায় হয়ে তিনি হয়তো নাম জানা কয়েকজন
লেখকের বই কিনে ফেরেন। কিন্তু গণমাধ্যম যদি দায়িত্ব নিত তবে হয়তো পাঠক
হাজার হাজার বইয়ের বদলে একশ' ভালো বইয়ের ভেতর থেকে তার দরকারি বইটা বেছে
নিতে পারতেন। মেলার পর ভালো ২৫টা বই খুঁজে পাওয়া ভার, কিন্তু মেলার মধ্যে
একশ' বই বাছাই করাও অনেক কঠিন কাজ। কিন্তু কঠিন কাজটার দায়িত্ব
মিডিয়াগুলোকে তো নিতেই হবে। মিডিয়া না চেনালে মানুষ চিনবে কীভাবে আর
পাঠকই-বা বাড়বে কীভাবে?
No comments:
Post a Comment