Monday, August 22, 2011

ছুটি


ছুটি পেলে লোকে কোথায় যায়, এ প্রশ্নের সঙ্গে নাগরিকতার প্রশ্ন যেমন জড়িত, তেমনি জড়িত জীবনাচারের প্রশ্নও। বিদেশে, বিশেষত পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে ছুটি পেলে লোকে বেড়াতে যায়, আর দেশে ছুটি পেলে লোকে বাড়িতে যায়। বছরের বিশেষ দীর্ঘ ছুটির প্রসঙ্গ পরে। জানা যায়, 'উইকএন্ড' বলে যে সাপ্তাহিক ছুটির দিন বিদেশিরা পালন করে তাতেও এক ধরনের মহাসমারোহ থাকে। আমাদের 'ছুটির দিনে'র সঙ্গে উইকএন্ডের পার্থক্য শুধু ভাষাতেই নয়। উইকএন্ড আসার আগেই প্রস্তুতি শুরু হয়। উইকএন্ড এলে গাড়ি নিয়ে সপরিবারে দূরের পথে বেরিয়ে পড়া বা কোনো জম্পেশ পার্টিতে মজা করার আয়োজন থাকেই। এমন উইকএন্ড পাশ্চাত্যের মধ্যবিত্ত জীবনে দুর্লক্ষ্য যেদিন তারা বাঁধভাঙা উৎসবে যোগ দেয় না। হৈ-হুল্লোড়ে উইকএন্ড কাটিয়ে উইকডেইজগুলোতে আবার কাজে ডুবে যাওয়ার চমৎকার এক রীতি পালন করে তারা। কিন্তু আমাদের দেশে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে ছুটির দিন একেবারেই আলাদা। ঘরের চার দেয়ালে বন্দি হয়ে বোকাবাক্সের সামনে বসে কোথা দিয়ে ছুটির দিন চলে যায় অনেক পরিবারই সে খবর রাখে না। তবে কি বাঙালি স্বভাবে ঘরকুনো? বোধহয় তা না, ছুটির দিনে বাইরে যেতে হলে যে সচ্ছলতা দরকার অনেক পরিবারে তা নেই। আগে লোকে বায়ু পরিবর্তনের জন্য সমুদ্রতীরে যেত এমন উদাহরণ সাহিত্যে পাওয়া যায়। কিন্তু বায়ু পরিবর্তনের মধ্যে একধরনের বাধ্যবাধকতা থাকত। স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের জন্যই ডাক্তাররা সাধারণত বায়ু পরিবর্তনের দাওয়াই দিতেন। রোগীর সঙ্গে আত্মীয়রাও তাতে বেড়ানোর সুযোগ পেতেন। কলকাতার পত্রপত্রিকাগুলো দেখলে বোঝা যায়, সাপ্তাহিক ছুটির দিনে তেমন বাইরে বের না হলেও পূজার লম্বা ছুটিতে তারা দূরে বেড়াতে যাওয়ার একটা অভ্যাস ইতিমধ্যে রপ্ত করেছেন। কোথায় কীভাবে যাওয়া যায় এ নিয়ে পত্রিকাগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে সেখানে। কিন্তু ঢাকায় এখনও অনেকের কাছে ছুটি মানে বেড়াতে যাওয়া নয়, বাড়িতে যাওয়া। ঈদের ছুটিতে এখন অনেকে কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙামাটি বেড়াতে যায়। শোনা যায়, ঈদে নাকি সেখানকার হোটেল-মোটেলে জায়গা পাওয়াই ভার। কিন্তু খুব অল্প লোকের কাছেই ছুটিতে বেড়াতে যাওয়ার গুরুত্ব আছে। শহরবাসীর অধিকাংশই বরং গ্রামে ফিরে যাওয়ার জন্যই উদগ্রীব। কোটি মানুষের শহর আছে আমাদের সত্য, কিন্তু সাকুল্যে লাখো মানুষের ফেরার ব্যবস্থা নেই। তাই যেদিন আগাম টিকিট বিক্রি করার কথা সেদিন টিকিট হাওয়া। মানুষের প্রয়োজন টিকিটের চেয়ে বহুগুণ। টিকিট কালোবাজারে গেল না সাদাবাজারে গেল তা দেখার অবকাশ নেই। টিকিট চাই, বাড়ি যেতে হবে। অনেকে যেতে পারেন, অনেকেই পারেন না। যারা যেতে পারেন না, তারা স্বেচ্ছায় থেকে যাওয়ার দলে নন; যেতে না পারার দলে। তাই ঈদের আনন্দ তাদের মনে বিষাদ ও বেদনার সুর জাগায়। এমন বিষাদ কতজনের মনে কাজ করে সে হিসাব কে করবে? কিন্তু ঈদের সময় অনেকেই শহরে থাকেন। বাড়ি না যাওয়া এসব মানুষ যানজটমুক্ত শহরে দিগ্গি্বদিক ঘুরতে থাকেন। তাদের বিনোদনের সামান্য কিছু ব্যবস্থা থাকে বাইরে। বাকিটা ঘরের ভেতরে টেলিভিশনের সামনে। সত্যি কথা বলতে, ছুটি কাটাতেও বোধহয় জানি না আমরা। সামার ভ্যাকেশন বলে একটা ব্যাপার আছে পাশ্চাত্যে। গ্রীষ্মের ছুটি। এ সময় স্কুল বন্ধ, অনেকের অফিসও। সপরিবারে কাছে বা দূরে সাগরে-বনে-পাহাড়ে চলে যায় সেখানকার মানুষ। সামার ভ্যাকেশনের আগে পত্রপত্রিকায় ছাপা হতে থাকে এবার ছুটিতে কোন বইগুলো পড়লে ভালো লাগবে। বিক্রি বেড়ে যায় বইয়ের। ঘর থেকে বেরিয়ে লোকে বই পড়ে। আড্ডায়, হুল্লোড়ে জীবন উপভোগ করে। লম্বা ছুটিকে কাজে লাগায়। আমাদের কর্মক্ষেত্রগুলোতে ছুটি কম নয়। কিন্তু সব ছুটিই ছন্নছাড়া। কোনো ছুটি তিনদিনের কোনোটি একদিনের। ছুটি ছড়ানো বছরভর। সে ছুটিতে কিছু করার চিন্তা করাই মুশকিল। আবার যখন স্কুলগামী বাচ্চাদের ছুটি তখন অফিসগামী বাবার কাজের চাপ। ফলে সপরিবারে কোথাও দীর্ঘ সময়ের জন্য বেড়াতে যাওয়ার প্রসঙ্গই ওঠে না। আমাদের ছড়ানো-ছিটানো ছুটিগুলো যদি একসূত্রে বেঁধে দেওয়া হতো তবে হয়তো কিছু পরিকল্পনা করা যেত। কিন্তু তেমন ছুটি আমাদের দেশে হবে না। কারণ আমরা কাজপাগল জাতি! রাজ্যের যত কাজ শুধু আমরাই করি। পাশ্চাত্যের লোকেরা কাজ করে না, তারা শুধু বসে বসে লম্বা ছুটি কাটায়!

No comments:

Post a Comment