Saturday, March 26, 2011

নিউ মিডিয়া :: আগের মতো থাকবে না কিছুই


চোখের সামনের পৃথিবীটা বদলে যাচ্ছে। কিছুদিন আগেও বদলটা চোখে পড়ত না। মনে হতো, বদলটা যেন অন্তঃসলীলা ফল্গুধারার মতো। সমাজ, রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান আগের মতোই থাকবে। বদলটা হবে ভেতরে ভেতরে। মানুষের মনোজগতে একটা প্রবল বিপ্লব ঘটে যাবে। বাইরে সে বিপ্লবের ছিটেফোঁটাও দেখা যাবে না। কেন এই ধারণা হয়েছিল অনেকের? কেউ বিশ্বাসই করতে পারেননি, সারাদিন ফেসবুকে বসে বন্ধুদের সঙ্গে অকারণে চ্যাট করে যে ছেলেটি বা মেয়েটি, পারলে নাওয়া-খাওয়া সব কম্পিউটারের সামনেই সেরে ফেলে, সে ছেলেটি বসে বসে ফেসবুক বা টুইটারের স্টেটাসে বড় বড় কথা বলবে। বলবে, পৃথিবীটা পরিবর্তিত হয়ে গেছে। কিন্তু কাজের কাজ সে কিছুই করবে না। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে নিজের জন্য একটা ভালো চাকরি ঠিকই সে জোগাড় করে নেবে। কিন্তু এই আত্মকেন্দ্রিক প্রজন্ম দেশ-জাতি নিয়ে কখনোই চিন্তা করবে না। কিছু ব্যতিক্রম সামনে ছিল। যেমন ১৯৯৯ সালে ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশনের মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক ভণ্ডুল করেছিল যারা, তারা সংগঠিত হয়েছিল ইন্টারনেট মাধ্যম ব্যবহার করেই। মেক্সিকোর জাপাতিস্তা আর্মি অব ন্যাশনাল লিবারেশনের উদাহরণও সামনে ছিল। আরও উদাহরণ তৈরি হচ্ছিল একে একে। কিন্তু খানিকটা বুদবুদ দেখিয়ে থেমে যাচ্ছিল সেগুলো। কিন্তু এবার যা ঘটল উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে, তার তুলনা আর কোনো কিছুর সঙ্গেই চলে না। রাষ্ট্রের চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণে ছিল সবকিছু। দেশগুলোর গণমাধ্যম কথা বলছিল হরেদরে শাসকেরই সুরে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, নিরাপত্তা বাহিনী, বিদেশি বন্ধু, শাসক শ্রেণী_ সব মিলিয়ে এক দুর্ভেদ্য অচলায়তন গড়ে উঠেছিল। এ অচলায়তন কখনও ভাঙবে, কেউ যেন বিশ্বাসই করতে পারেননি। লৌহবাসরের অন্তরালে চলছিল স্বৈরতান্ত্রিক শাসন। কখন যে লৌহবাসর ভেদ করে মনসার প্রতিনিধি ঢুকে গিয়েছিল তা কেউ জানতে পারেনি। কিন্তু যখন বিস্ফোরণ ঘটল তখন সবাই জানল, এই লৌহবাসরও অভেদ্য নয়। আরব বিশ্বের তরুণরা হঠাৎ জেগে উঠল। বলল, কিছুই আর আগের মতো থাকবে না। সত্যিই পুরনো সবকিছু ভেঙে যেতে থাকল একে একে। অনেক কিছুই পরিবর্তিত হয়ে গেল সপ্তাহের মাথায়। যে ব্যাপারগুলো অপরিবর্তিত রয়ে গেছে, সবাই বলছেন, সেগুলোও শিগগিরই বদলাবে। আল কায়দার মতো সন্ত্রাস সৃষ্টি করে নয়, মতাদর্শের প্রবল শক্তিতে নয়_ আরব বিশ্বে তরুণরা জেগে উঠেছে প্রযুক্তির শক্তিতে। তাদের ভাষায়, আমরা সংগঠিত হয়েছি ফেসবুকের মাধ্যমে, কর্মসূচি জানান দিয়েছি টুইটারের মাধ্যমে, আর বিশ্বকে আমাদের কথা জানিয়েছি ইউটিউবের মাধ্যমে। ইন্টারনেট_ ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব এখন সশস্ত্র যুদ্ধের হাতিয়ারের চেয়ে শক্তিশালী তবে? তা-ই তো মনে হচ্ছে।
বস্তুত বহুদিন ধরেই বিশ্বের অন্য সব অঞ্চলের মতো আরব বিশ্বের তরুণরাও পরস্পরকে জানছিল, বুঝছিল। পরস্পরের ভাষা বোঝার চেষ্টা করছিল। এই বোঝাটা আজকের বাস্তবতায় পেঁৗছাত না যদি তাদের পরস্পরের মধ্যকার বোঝাপড়া বা দেশ-জাতি সম্পর্কে তাদের বোধবুদ্ধি জাগানোর দায়িত্বটা পালন করত ওল্ড মিডিয়া, যাকে আমরা আদর করে গণমাধ্যম বলে থাকি। আদরের নাম গণমাধ্যম হলেও শাসকের, বিনিয়োগকারীর স্বার্থ-ভাষা ও বক্তব্যের বাইরে গণমাধ্যম কিছু বলে না। ফলে নতুন যুগ নিয়ে আসার জন্য যে জরুরি প্রস্তুতি তা পুরনো গণমাধ্যম ও যোগাযোগ মাধ্যমে সম্ভব হতো না, হয়ওনি। কিন্তু নিউ মিডিয়া একেবারেই আলাদা। পুরনো প্রিন্ট মিডিয়া বা অ্যানালগ ইলেকট্রনিক মিডিয়াও কাজ করে এক থেকে বহুতে। তৈরি সংবাদ, ভাষ্য ও বিশ্লেষণ এক থেকে বহুতে যায়। একটি কোম্পানি সংবাদ তৈরি করে তার কর্মীদের মাধ্যমে, সে সংবাদ যখন পাঠক গ্রহণ করে তখন তারা একক ভোক্তা। এ থেকে বিচ্ছিন্ন বহুতে সংবাদ সঞ্চারিত হয়। কিন্তু নতুন মাধ্যমগুলো একেবারেই আলাদা। একটি সংবাদ এক থেকে বহুতে যায়, আবার বহু থেকে বহুতে যায়। একটি সংবাদের সঙ্গে সঙ্গে পাঠকের মত ছড়াতে থাকে। ব্লগে, ফেসবুকে, টুইটারে সংবাদের বিশ্লেষণ ছড়িয়ে পড়ে। ফলে কোনো বড় পত্রিকার সংবাদও ইন্টারনেট মাধ্যমে এসে তার দুর্বলতা, চালাকি ও রাজনীতির তাৎপর্য হারিয়ে ফেলে। পাঠক-দর্শক-শ্রোতারা সমস্বরে এর প্রতিক্রিয়া জানাতে জানাতে এর একটা রূপান্তর ঘটান। আবার ব্লগ-ফেসবুক-ইউটিউব ব্যবহার করে যে কেউ সাংবাদিক-বিশ্লেষক হয়ে যেতে পারেন। লিখে, ছবি তুলে, রেকর্ড করে সেটি ছড়িয়ে দিতে পারেন। সংবাদ তৈরি করতে পারেন। সবার হাতে যখন সংবাদ বা ভাষ্য নির্মাণের ক্ষমতা ছড়িয়ে পড়ে তখন সেটিকে বলা হচ্ছে ডিজিটাল ডেমেক্রেসি। এ গণতন্ত্র শুধু তথ্যমাধ্যমের নয়, গণতন্ত্র সর্বত্র। রাষ্ট্রে গণতন্ত্র নেই, কিন্তু রাষ্ট্রে তো ইন্টারনেট ছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্য চলবে না। ইন্টারনেট দেশে এলে তরুণরা তা ব্যবহার করবেই। যতই নিষেধাজ্ঞা থাকুক, তারা ঠিকই বের করে নেবে মত প্রকাশ ও যোগাযোগের উপায়। পরস্পরের কথা জানতে পারলে আজ হোক বা কাল রাস্তায় নেমে পড়বেই। আর এত মানুষ যখন রাস্তায় নেমে আসে কোনো ইন্ধন, প্রচারণা ছাড়াই তখন পুরনো যা কিছু তা টিকে থাকবে কী করে?
আরব বিশ্বের পরিবর্তন নিউ মিডিয়া ও নতুন ধারার যোগাযোগের একটা দিক। সামাজিক পরিবর্তনের বাইরেও আছে এর হাজারো মাত্রা।
উন্নত দেশগুলোর পুরনো মিডিয়া বা গণমাধ্যম এখন নিউ মিডিয়ায় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। দেশগুলোতে ইন্টারনেট সেবা চমৎকার, ইন্টারনেট ব্যবহার করে পড়াশোনা-দেখার প্রযুক্তিও আমাদের থেকে উন্নত। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির কারণে সেখানে সুযোগও অবারিত। ফলে সেখানে নিউ মিডিয়া সব ম্যাজিক ঘটাচ্ছে। একটি বাচ্চা মেয়ের বোকা বোকা লিরিকের গান যখন নামিদামি গায়কের গান টপকে লিস্টে এক নম্বরে উঠে যায়, তখন বড় আর্টিস্টদের স্টারডম থমকে যায়। তেমনি নামি সাংবাদিকের কলামের চেয়ে ব্লগের কলাম যখন জনপ্রিয়তা ও বিশ্বাসযোগ্যতায় এগিয়ে থাকে তখন পত্রিকা থমকে যায়। গার্ডিয়ান, নিউইয়র্ক টাইমস তাই ব্লগ চালু করে এগিয়ে থাকতে চায়, সিএনএন-বিবিসি ইউটিউবে চ্যানেল খোলে, ফেসবুকে পেজ খোলে। নাগরিক সাংবাদিকতা বা সিটিজেন জার্নালিজমের জন্য আলাদা সময় বরাদ্দ রাখতে বাধ্য হয়। জাপানে ভূমিকম্প, ইরাকে সংঘর্ষ, লিবিয়ায় হামলা_ সর্বত্র নাগরিক সাংবাদিকতার জয়যাত্রা। ফলে আজকের বাস্তবতা হলো_ দেশে গণতন্ত্র থাকুক বা না থাকুক, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা থাকুক বা না থাকুক, মুক্ত ইন্টারনেট থাকলেই নিউ মিডিয়ায় কমবেশি গণতন্ত্র থাকবে। কারফিউ থাকলেও মানুষ কথা বলতে পারবে। এমনকি আচমকা রাস্তায় জড়ো হওয়ার মতো প্রস্তুতিও নিতে পারবে, রক্তচক্ষুর অন্তরালে। ডিজিটাল ডেমোক্রেসির বাইরে নিউ মিডিয়ার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো ইন্টারঅ্যাকটিভিটি। মত-পাল্টামত-বহুমতের উৎসার এই নিউ মিডিয়া। এর কাছে ছাপা কাগজ ক্রমে কুপোকাত হচ্ছে। আমাদের দেশে এমনকি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও ছাপা কাগজের সংবাদপত্র এখনও বিকাশমান। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে এমন কিছু শহর তৈরি হয়েছে যেখানে ছাপা সংবাদপত্র নেই। বড় বড় অনেক কাগজের সার্কুলেশন নেমে গেছে। অনেকে ব্যবসা গুটিয়ে শুধু অনলাইনেই পত্রিকা প্রকাশ শুরু করেছে। নিউ মিডিয়ার উত্থানের মাত্র কুড়ি বছরের মাথায় ডাকসাইটে পত্রিকা, ঐতিহ্যবাহী সাংবাদিকতার এমন পতনের কথা কেউ হয়তো ভাবেননি। বিশ্লেষকরা বলছেন, সামনে আরও পরিবর্তন আসছে। একটা জেনারেশন তৈরি হবে, যারা কম্পিউটারে, বইপত্র পড়ায় অভ্যস্ত হয়ে উঠবে শুধু। তাদের কাছে ছাপা কাগজের আলাদা গুরুত্ব আর থাকবে না। আমাদের দেশে ছাপা কাগজের কদর এখনও বেশি, কারণ ইন্টারনেট কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় ছড়ায়নি, তার গতিও বাড়েনি। কিন্তু ধীরে ধীরে অবস্থা পরিবর্তন হবে। কিছুই আর আগের মতো থাকবে না। বাংলাদেশের একজন তরুণের জন্য আজ ফেসবুক-ইউটিউব-টুইটার-ব্লগ যে বাস্তবতা, তার সঙ্গে সৌদি আরবের বা যুক্তরাষ্ট্রের তরুণটির বাস্তবতার খুব বেশি পার্থক্য নেই। প্রায় ১০ লাখ অগ্রসর-শিক্ষিত-সচ্ছল তরুণ আজ ফেসবুকের ভোক্তা। একটা নতুন জেনারেশন তৈরি হয়েছে। বিশ্বের সর্বসাম্প্রতিক চিন্তা-জ্ঞান ও তথ্যের সঙ্গে তাদের সহজ যোগাযোগ তৈরি হয়েছে। এ দেশের বাস্তবতায় তারা পথ চলে, কিন্তু মনোজগতে তারা আরেক বাস্তবতায় বাস করে। কখনো সে বাস্তব এ বাস্তবকে ছাপিয়ে উঠবে না এ নিশ্চয়তা কে দিতে পারে?
এ দেশে ব্লগ তৈরি হয়েছে, নিত্যনতুন নিউজ মিডিয়া তৈরি হচ্ছে, সংবাদ ও ভাষ্য তৈরি হচ্ছে, মত গড়ে উঠছে। পুরনো মিডিয়ার আভিজাত্য, ব্যবসা, রাজনীতি, বিজ্ঞাপন-বিপণন ব্যবস্থা এখনও বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়নি। কিন্তু হবে। তার জন্য প্রস্তুতি কি চলছে?
চলি্লশ বছরের স্বাধীন বাংলাদেশ গণতন্ত্র, মুক্তমত, নাগরিক অধিকারের যেসব স্বপ্ন অর্জনের জন্য অপেক্ষা করছে তার সঙ্গে দেখা হবে শিগগিরই। বিশ্বের অভিজ্ঞতা বলে, দুটি শক্তি_ তারুণ্য ও ইন্টারনেট সেটি সম্ভব করে তুলতে পারে। নিউ মিডিয়া সেই সব সম্ভবের উপায়। কিন্তু তাকে কাজে লাগাতে হবে।


লেখক : সাংবাদিক ও কথাশিল্পী

No comments:

Post a Comment