Monday, September 20, 2010
গরু-ভীতি
'গ রু অত্যন্ত শান্ত স্বভাবের গৃহপালিত পশু। ইহার একটি মাথা, দুইটি কান ও একটি লেজ আছে। লেজের মাথায় একগুচ্ছ কেশ দিয়া গরু মশা-মাছি তাড়ায়।' এমনিভাবেই অত্যন্ত উপকারী এ প্রাণীটি নিয়ে বাংলার ঘরে ঘরে ছেলেমেয়েরা প্রথম রচনা লিখতে শুরু করে। পৃথিবীতে এত কিছু থাকতে শিক্ষকমণ্ডলী কেন রচনা লেখার হাতেখড়ি দিতে গরুর কথা স্মরণ করেন তা বের করা মুশকিল। গরুদের প্রতি গুরুদের এই অভাবিত ভক্তির কারণে বাংলার শহর-গ্রাম নির্বিশেষে সবার কাছেই গরু পরিচিত প্রাণী। শুধু পরিচিত নয়, রচনার ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়, গরুর উপকারের শেষ নেই। 'ইহার চামড়া হইতে জুতা, ব্যাগ প্রভৃতি তৈরি হয়। গরুর দুগ্ধ প্রতিদিন আমরা পান করি। দুগ্ধ হইতে মিষ্টান্নও প্রস্তুত হয়। অর্থনীতিতে গরুর অবদান বলিয়া শেষ করা যায় না।' এমন উপকারী প্রাণী যখন বিপদে পড়ল, যখন অ্যানথ্রাক্সে মারা পড়তে থাকল একে একে, তখন অনেকে একে গরু জাতির সমস্যা হিসেবেই দেখতে শুরু করেছিলেন। ভেবেছিলেন, মানবজাতিকে এ রোগ স্পর্শ করবে না। কিন্তু ক্রমে মানবজাতিকেও অ্যানথ্রাক্স আক্রমণ করল। বলা হলো, অ্যানথ্রাক্স হলো পরিচিত তড়কা। মনে হলো, অনেকে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন, যেন 'ওহ তড়কা, সেরে যাবে।' কিন্তু তড়কা না সেরে তড়াক তড়াক করে বেড়েই চলেছে। প্রথম প্রথম মেদভুঁড়ি নিয়ে চিন্তিত লোকেরা ভেবেছিলেন, ভালোই হলো, অ্যানথ্রাক্সের ভয় কাজে লাগিয়ে কিছুদিন মেদ কমিয়ে নিই। আবার যারা শখের ভেজিটারিয়ান তারা ভাবলেন, অবশেষে সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ দেখা দিয়েছে। মুরগি ব্যবসায়ীরা কিছুদিন জমজমাট ব্যবসা করলেন। বার্ড ফ্লুর সময় সবাই যেভাবে মুরগির বাজারের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে গরুর বাজারের দিকে ছুটেছিলেন, তার উল্টোটা ঘটল এবার। দেখতে দেখতে এক মাস অতিক্রান্ত হলো। এখন ধীরে ধীরে মালুম হচ্ছে, রোগটি নানা স্থানে ছড়িয়ে পড়ছে। গরু ব্যবসায় মন্দা, মাংস ব্যবসায় মন্দা, চামড়া ব্যবসায় মন্দা, শোনা যায় দুধ খেতে গিয়েও লোকে এখন ভাবছেন, অ্যানথ্রাক্স হবে কি-না। ভীতির মা-বাপ নেই, ছড়াতে থাকলে থামে না। শোনা যাবে কিছুদিনের মধ্যে গরুর চামড়ায় প্রস্তুত স্যান্ডেলও পরতে চাইছেন না ভীত মানুষজন। গুজবের চেয়ে শক্তিশালী ভীতি এখন সারাদেশে। গরুর মাংসের দোকানে মাছি উড়ছে, ক্রেতা আসছে না। বিক্রেতা বাহারি রান, সিনা ঝুলিয়ে ঘুমাচ্ছেন। আর মাংস ব্যবসায়ী সমিতি বলেছে, ১৫ দিনের মধ্যে গরুগুলোকে ভ্যাকসিন দিন, নইলে কঠোর কর্মসূচি। দুগ্ধ, চামড়া, জুতা ব্যবসায়ীরা অনুরূপ দাবি নিয়ে মাঠে নামবেন বোঝা যাচ্ছে স্পষ্ট। ঈদুল আজহা এলে গরু মোটাতাজা করা কৃষক, ব্যাপারিদের দাবি কেমন হবে একটু ভাবা যেতে পারে। দেশের অর্থনীতিতে বড় প্রভাব পড়বে সেটি নিশ্চিত করে বলে দেওয়া যায়। কোরবানির আগে সমস্যার সমাধান না হলে কী উপায় হবে সে ভাবনা এখনই ভাবতে হবে। ফলে দেরি না করে এখনই ভ্যাকসিন দিতে হবে। সব গরুকে ভ্যাকসিন দিয়ে অ্যানথ্রাক্স তাড়াতে হবে। মানুষের দেহে সংক্রমিত জীবাণুর ধ্বংসের যাবতীয় আয়োজনও শেষ করতে হবে। দায়িত্বশীলরা এই ক্ষেত্রে বসে থাকলে চলবে না। কিন্তু প্রশ্ন অন্যত্র। আর প্রশ্নটা মাংস ব্যবসায়ীদের কাছেই, সব গরু তো আর অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত নয়। আর তারাও নিশ্চয়ই রোগাক্রান্ত গরু জবাই করছেন না। নিশ্চয়, রোগমুক্ত গরু নিয়মমতো জবাই করে, ভালো মাংসই সাজিয়ে রাখছেন দোকানে। কিন্তু লোকে ভরসা পাচ্ছে না কেন? লোকের ভরসা তো আর পুলিশ ডেকে বাড়ানো যাবে না। মাংসের খাঁ খাঁ করা দোকানে ক্রেতা ফিরিয়ে আনতে হলে ক্রেতাদের আস্থা বাড়াতে হবে। গরুকে ভ্যাকসিন দিলে মানুষের আস্থা বাড়বে কি?
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment