বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'কপালকুণ্ডলা' উপন্যাসটি পড়া থাকুক বা না থাকুক, উপন্যাসের একটি লাইন অনেকেরই জানা। 'পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছো?' নবকুমার সহযাত্রীদের রান্নাবান্নার সহযোগিতা করার জন্য বনে গিয়েছিল। তার ফিরে আসার দেরি দেখে সহযাত্রীরা ভেবেছিল, নবকুমারকে বাঘে খেয়েছে। তারা নদীর ধারের নির্জন বনে নবকুমারকে রেখে বাড়ি ফিরেছিল। আর নবকুমার বনে বনে ঘুরতে ঘুরতে সহসা এ প্রশ্নের মুখে পড়েছিল যে, সে পথ হারিয়েছে কি-না? প্রশ্ন করেছিল কপালকুণ্ডলা, উপন্যাসের নায়িকা। এই প্রশ্নের পর নবকুমারের জীবন ও 'কপালকুণ্ডলা' উপন্যাস উভয়ের মোড় ঘুরে গিয়েছিল। কিন্তু সে কাহিনীর পিছু ধাওয়া করা এখন আমাদের উদ্দেশ্য নয়। পথিকের পথ হারানোর এই কৌতুক ও শ্লেষপূর্ণ বাক্য কেন আমাদের সমাজে এত জনপ্রিয় হলো সেটাই প্রকারান্তরে আমাদের জিজ্ঞাস্য। বাঙালির সমাজ-ইতিহাস গভীর অভিনিবেশ সহকারে পর্যালোচনা করেন তাদের অনেকেই বলেন, বাঙালি পথহারা। অর্থাৎ যে পথে এই জাতির চলার কথা ছিল সে পথে তারা এগিয়ে যেতে পারেনি। কি রাষ্ট্রে, কি রাজনীতিতে, কি ব্যবসায়, কি শিল্পায়নে, কি সাহিত্যে বাঙালির নাকি প্রভূত উন্নতি করার কথা ছিল। কিন্তু বাঙালি তেমন কিছু করতে পারেনি। আজকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক জাতির বাঙালির চেয়ে কম সম্ভাবনা ও মেধা নিয়ে উন্নতির শিখরে পেঁৗছে গেছে। কিন্তু বাঙালির ভাগ্য যে লাউ সেই কদুই রয়ে গেছে। কারণ, আমরা নাকি পথভ্রষ্ট। ভুল পথে এগোতে গিয়ে সহসা থমকে পেছনে ফিরে কেঁচে গণ্ডূষ করাই নাকি আমাদের রীতি। বাংলাদেশ আকারে ছোট। এখানে শহর হোক কি গ্রাম সেখানে পথ হারিয়ে ফেলা বড় কষ্টকর। নিতান্তই শিশু ও ভুলোমন না হলে বাংলাদেশে কোথাও পথ হারানো কষ্টের কাজ। তারপরও 'পথহারা পথিক' আমাদের প্রিয় শব্দবন্ধ। আমাদের কত কবিতা গানে যে পথ হারানোর কথা আছে সে নিয়ে বিশাল গবেষণা হতে পারে। অনেকের মনে পড়বে কবি রবীন্দ্রনাথের গানের সেই বাণী_ 'আমি পথ ভোলা এক পথিক এসেছি/ সন্ধ্যাবেলার চামেলি গো/সকাল বেলার মলি্লকা/আমায় চেন কী?' পথিক নিজেই বলছেন এখানে যে, তিনি পথ হারিয়েছেন। কিন্তু পথ খোঁজার কোনো চেষ্টা নেই, তিনি বরং মলি্লকা-চামেলিরা তাকে চিনতে পারল কি-না এ নিয়েই চিন্তিত। বেশ বোঝা যাচ্ছে, পথ হারানো আমাদের কাছে কতটা প্রার্থিত, কতটা আয়াসসাধ্য এবং কত রোমান্টিক ব্যাপার। কেউ কেউ বলেন, বাঙালির যৌথ অবচেতনার ভেতরই নাকি পথ হারানোর ব্যাপারটি কাজ করে। জাতিগতভাবে পথ হারাবার কোনো সমাধান নেই, ফলে ব্যক্তিগতভাবে পথ হারাতেই আমাদের আনন্দ। আমাদের মহাজনরা যে পথে পথ হারিয়েছেন, সে পথেই পথ হারাতে পেরে আমরাও খুশি। কিন্তু মহাজনরা যদি শুনতেন যে, বাঙালির অন্যতম বৃহত্তম নগরী ঢাকায় পথ নিজেই হারাতে বসেছে, তবে কী ভাবতেন? সোমবারের সমকালে সচিত্র একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, পথিকের পথ দখল হয়ে গেছে। কোথাও গাড়ি পার্কিং, কোথাও হকার, কোথাও নর্দমা, কোথাও ডাস্টবিন। কত কি যে পথিকের পথ দখল করে বসে আছে! এ শহরে কেউ যদি হেঁটে গন্তব্যে পেঁৗছাতে চায় তবে সে কাজ যে কতটা ক্লেশকর হবে তা একবার পথে নামলেই বোঝা যায়। শহরে সত্যি পায়ে চলার পথ নেই। গাড়ি চলার পথ কি আছে? সে প্রশ্নের সুরাহা করতে হলে আরও বড় আলোচনা ফাঁদতে হবে। পত্রিকায় ইদানীং কিছু লেখা চোখে পড়ল, তাতে লেখক বলছেন, ঢাকায় সাইকেল চালাবার ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। এমন দখল হওয়া রাস্তায় বসে সাইকেল চালানোর চিন্তা_ ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখার মতো ঘটনাই বটে। বাংলার পথিক এতদিনে এসে পথ হারাইয়াছে, এই ঢাকা শহরে। আগে পথ ছিল, পথিক পথে দিকদিশা হারাইতো। আমাদের মহাজনরা তাকেই বলতেন পথ হারানো। এখন পথিক সত্যই পথ হারাইয়াছে। কিন্তু মহাজনরা
নাই, এ হারানো সংবাদ নিয়া
কে লিখিবে?
No comments:
Post a Comment