জাফরুল্লাহ চৌধুরীর জন্ম ১৯৪১ সালের ২৭ ডিসেম্বর। শৈশব কেটেছে কলকাতায়।
পরে পরিবারের সঙ্গে ঢাকায় চলে আসেন। পড়াশোনা করেন নবকুমার ইনস্টিটিউট ও
ঢাকা কলেজে। ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা করার সময় ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে
জড়িত হন। ১৯৬৪ সালে এমবিবিএস শেষ করার পর জেনারেল ও ভাসকুলার সার্জারি
বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষার জন্য লন্ডনে যান। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ফিরে আসেন
দেশে। মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের চিকিৎসার জন্য স্থাপন করেন ৪৮০ শয্যার
একটি ফিল্ড হাসপাতাল। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে তিনি স্থাপন করেন
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। চিকিৎসাসেবার ডিমিস্টিফিকেশনের ধারণা থেকে স্থাপিত
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিশেষ স্বীকৃতি পেয়েছে।
গ্রাম ও মফস্বল অঞ্চলে চিকিৎসাসেবা বিস্তারে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বিশেষ
অবদান রয়েছে। জনস্বাস্থ্য ক্ষেত্রে অবদানের জন্য তিনি পেয়েছেন আন্তর্জাতিক
পাবলিক হেলথ হিরো পুরস্কার, স্বাধীনতা পদক, রাইট লাইভলিহুড পুরস্কার,
র্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার, সুইডিশ ইয়ুথ প্রাইজসহ নানা পুরস্কার ও
সম্মাননা। ১৯৮২ সালে বাংলাদেশের জাতীয় ওষুধনীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে তার
ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে
স্বাস্থ্য, চিকিৎসা ও সমাজ-রাজনীতির নানা প্রসঙ্গ নিয়ে সমকালের সঙ্গে কথা
বলেছেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মাহবুব মোর্শেদ।
সমকাল : ২০১২ সালে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ৪০ বছর পূর্ণ হলো। এ উপলক্ষে নানা আয়োজন আমাদের চোখে পড়েছে। দীর্ঘ যাত্রায় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। র্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার পেয়েছেন আপনি।
জাফরুল্লাহ চৌধুরী : র্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার প্রথম আমাকে দিতে চাওয়া হয়েছিল ১৯৭৫-৭৬ সালের দিকে। আমি তখন পুরস্কার নিইনি; কারণ এ পুরস্কারের অর্থায়ন করত রকফেলার ফাউন্ডেশন। আমি তখন রকফেলারের বিরুদ্ধে কথা বলতাম। আমি বলেছিলাম, রকফেলারের টাকায় দেওয়া পুরস্কার আমি নিতে পারি না। প্রশ্ন উঠতে পারে, ১৯৮৫ সালে তাহলে আমি পুরস্কারটা নিলাম কেন? '৮৫তে যখন আবার পুরস্কারের প্রস্তাব এলো তখন আমি দৈনিক বাংলার সম্পাদক আহমেদ হুমায়ুন, আহমদ শরীফের সঙ্গে কথা বললাম। আমি ওষুধ নীতি প্রণয়নের সঙ্গে জড়িত ছিলাম, বাংলাদেশের পরিবর্তনের অনেক আন্দোলন-সংগ্রামে আমার অংশগ্রহণ ছিল_ এসব কারণে আমাদের বিরুদ্ধে নানা শক্তি সক্রিয় ছিল, সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকেও নিরাপত্তার নামে নানা হয়রানির শিকার হতে হতো। তখন অনেকে বললেন, তুমি পুরস্কারটা নাও। এটা নিয়ে তো তুমি দাসখত লিখে দিচ্ছ না। কিন্তু পুরস্কারটা নিলে তোমার আন্তর্জাতিক খ্যাতির কারণে হয়রানির হাত থেকে বাঁচতে পারবে। বলতে গেলে, কৌশলগত কারণে আমি পুরস্কারটা নিলাম। যে রকফেলার অস্ত্র তৈরির জন্য এত টাকা ব্যয় করে তারা কীভাবে জনস্বাস্থ্যের উন্নতি চাইতে পারে? যারা আমাদের ওষুধনীতির বিরোধিতা করে, তারা কীভাবে আমাদের উদ্যোগকে স্বীকৃতি দিতে চায়? আমি এসব কথা বলেছি। আমাদের সীমিত ক্ষমতা ও সীমাবদ্ধতা নিয়ে আমরা চেষ্টা করেছি। গণস্বাস্থ্য ছোট সংগঠন। তবে ছোট হলেও এর সবচেয়ে বড় কাজ হলো, সাধারণ মানুষের কাছে আমরা পেঁৗছাতে পেরেছি। সাধারণ মানুষের আওয়াজ আমরা শুনেছি। তারা কী চায়, তাদের পথ কোনটা_ সে সম্পর্কে ধারণা পেয়েছি। আমরা যারা উচ্চ লেখাপড়া করি, দেশ-বিদেশে গিয়ে বিভিন্ন উচ্চ ডিগ্রি আনি, তারা মানুষের কথা বলি বটে কিন্তু সে কথা বলি বিদেশ থেকে শিখে আসা পদ্ধতিতে। সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলনের সঙ্গে আমরা বিভিন্ন সময় জড়িত ছিলাম বলে আমাদের একটা অন্তর্গত অহমিকাও আছে।
সমকাল : ১৯৭২ সালে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের যাত্রা শুরু।
জাফরুল্লাহ চৌধুরী : আমাদের শুরু আসলে ১৯৭১ সালে । যুদ্ধের সময়। আমার জন্ম উচ্চবিত্ত পরিবারে। প্রগতিশীল আন্দোলনে যুক্ত হয়েছি তরুণ বয়সে। আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি। আমরা ইনোভেটর ছিলাম। তখন আমরা ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা রাস্তার ওপর লিখে দিয়েছিলাম, 'আইয়ুব শাহি মুর্দাবাদ'। এসব দিয়েই আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল। একসময় শিক্ষা পরিবর্তনের আন্দোলন করেছি। এগুলোর মধ্যেও পড়াশোনার আগ্রহটা ছিল। মনে হয়েছিল, আমি পূর্ব পাকিস্তানের এক নম্বর ডাক্তার হবো। শুধু পূর্ব পাকিস্তান কেন, পুরো পাকিস্তানেরই এক নম্বর ডাক্তার হবো। তখন ভাসকুলার সার্জন পাকিস্তানে কেউ ছিল না। আমার মনে হলো, যদি ভাসকুলার সার্জন হই তবে পাকিস্তানিদের আমার কাছেই আসতে হবে। মধ্যবিত্তের সুবিধাবাদী চিন্তা-ভাবনা। ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে স্বাভাবিকভাবেই শেখ মুজিব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চাইলেন। কিন্তু পাকিস্তানিরা যখন তাকে প্রধানমন্ত্রী করতে চাইল না তখন আমরা অপেক্ষায় ছিলাম কখন স্বাধীনতার ঘোষণা আসবে। একটা সন্দেহও ছিল যে, হয়তো স্বাধীনতার ঘোষণা আসবে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ শুরু হলো। মওলানা ভাসানীর চিঠি পেয়ে ফিরে এলাম। আমরা বললাম, যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিক যেমন লাগবে, হাসপাতালও লাগবে। খালেদ মোশাররফ বলল, আমার হাসপাতাল লাগবে না। আমার ৫ হাজার সৈনিক আসবে, ৫ হাজার মরবে_ আমরা প্রাণের তোয়াক্কা করি না। আপনি ফিরে গিয়ে অস্ত্রের ব্যবস্থা করেন। আইআরএ_ আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির সঙ্গে পরিচিত হয়ে যোগাযোগ গড়ে তোলেন। আপনি হাসপাতাল নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। পরে তাজউদ্দীন সাহেবকে রাজি করাতে পারলাম। কিন্তু হাসপাতাল হলে চালাবে কে? সুবিধাবাদী মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে ক'জন গিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে? ক'জন ডাক্তার গিয়েছিল? আপনি ইতিহাসটা খুলে দেখবেন। খুবই ন্যক্কারজনক অধ্যায় এটা। তাজউদ্দীন সাহেব আমাকে বলেছিলেন, দেশ স্বাধীন হবে কিন্তু আমি থাকব না। আমি হারিয়ে যাব। আর আপনি সমাজতন্ত্র করতে এসেছেন তো, আপনার স্বপ্নও সফল হবে না। আমি বললাম, বিলাত থেকে ডাক্তার-নার্স নিয়ে আসি। আমরা ভেবেছিলাম, যুদ্ধ অনেকদিন চলবে। নয় মাসেই যে এত সুস্থ শিশুর জন্ম হবে তা আমরা ভাবিনি। তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, বিলাত থেকে নার্স আনা যাবে না। ওরা মানবদরদি, কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে সবকিছু ফেয়ার নয়। ওদের আনলে অনেক সমস্যা হবে। তারা আমাদের সঙ্গে কোনো বিষয়ে একমত না-ও হতে পারে, তারা মারাও যেতে পারে। এই পরিস্থিতিই আমাদের অলটারনেটিভ চিন্তা করতে বাধ্য করল। তখন আমি ভাবলাম, আমার কী দরকার? সার্জন হিসেবে আমার দরকার কয়েক জোড়া হাত। যারা আমাকে সাহায্য করতে পারে। এটা করার জন্য তো সময় লাগার কথা নয়। চিকিৎসা ক্ষেত্রে ডিমিস্টিফিকেশনের জন্ম সেখানে।
সমকাল : ডিমিস্টিফিকেশন কী?
জাফরুল্লাহ চৌধুরী : উচ্চবিত্ত সুবিধাবাদী শ্রেণী সমাজকে শাসন করার জন্য বিভিন্ন বিষয়কে ক্রমাগত মিস্টিফাই করে তোলে। কিন্তু যদি আমরা উল্টোভাবে চিন্তা করি? এমপি সাহেবের জন্য দামি গাড়ি আনতে হবে। কেন আনতে হবে? তার কি গাড়ি নেই, তাহলে এতদিন কীভাবে চলত? এতদিন যেভাবে চলেছে সেভাবে এখন কেন চলতে পারে না? তাকে কেন বেতন দিতে হবে? তাকে তো আমরা ভোটে দাঁড়াতে বলিনি। বেতন নিলে তো স্বেচ্ছাসেবী মনোভাব থাকে না, মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আকাঙ্ক্ষা থাকে না। তখন শাসনের মনোবৃত্তিই প্রধান হয়ে ওঠে। ঢাকা শহর থেকে দেশ শাসন করার ইচ্ছা জাগে। ডিমিস্টিফিকেশন একটা সহজ কাজ। আদি থেকে মানুষের চিন্তায় মিস্টিফিকেশন বা রহস্যায়ন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আলোটা চলে গেলে মানুষ ভেবেছে কোনো অতিপ্রাকৃতিক শক্তি বোধহয় সূর্যটা ঢেকে দিয়েছে। কিন্তু পরে মানুষ আবিষ্কার করল, পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরছে বলেই দিনরাত হয়। এভাবেই ডিমিস্টিফিকেশন রহস্যভেদের সূচনা ঘটে। চিকিৎসা ক্ষেত্রে ডিমিস্টিফিকেশনের শুরুটা কোথায়? পৃথিবীর আদি চিকিৎসক সব মেয়ে। বাস্তবতার কারণেই মেয়েরা পৃথিবীর প্রথম চিকিৎসক। কারণ তাদের বাচ্চা ধারণ করতে হয়। বাচ্চা জন্ম দিতে হয়। বাচ্চা প্রসব করলে রক্তপাত হয়, সে রক্তপাত বন্ধের উপায়ও তাদের বের করতে হয়েছে। তাকে আবিষ্কার করতে হয়েছে কিসে রক্তপাত থামবে। কোন গাছের পাতা দিলে রক্ত থেমে যায়। কী খেলে ব্যথা কমে। আফিমের জন্ম হয়েছিল ব্যথা কমানোর ওষুধ হিসেবে। যখন মেয়েরা ডাক্তার ছিল, তখন চিকিৎসা ছিল সেবা। কিন্তু পুরুষরা যখন ডাক্তার হলো তখন তারা একে ব্যবসায় পরিণত করে ফেলল। তারা বলল, যে মেয়েরা চিকিৎসা করে তারা ডাকিনী, উইচ। ইউরোপের মতো জায়গায় ধাত্রীদের পুড়িয়ে মারা হলো। আর মেয়েদের জন্য চিকিৎসা শাস্ত্র নিষিদ্ধ করে দেওয়া হলো। বহু শতক পর্যন্ত মেয়েরা ডাক্তারি পড়তে পারত না। চিকিৎসা খুব রহস্যাবৃত কোনো শাস্ত্র নয়। এটা খুব সহজে বোঝা সম্ভব। থার্মোমিটার ডিমিস্টিফিকেশনের একটা সূচনা ঘটিয়েছে। এর সাহায্যে কোনো অনুমান ছাড়াই আমরা খুব সহজে জ্বর মাপতে পারছি। আরেকটা বড় ঘটনা ব্লাডপ্রেসার মাপার যন্ত্র। সবচেয়ে দরকারি মেডিকেল অ্যাপারেটাস। আপনি যদি কানে শোনেন আর অক্ষর পড়তে পারেন তাহলেই আপনি ব্লাডপ্রেসার মাপতে পারবেন। এই যে প্যাথলজি, এতে আমরা কী দেখি। রক্তে কিছু কেমিক্যাল মিশিয়ে আমরা রঙের খেলা দেখি। ব্লাড সেলগুলো দেখি। এতে কঠিন রহস্যাবৃত কাজটা কোথায়? আগে দেখতে হবে আমি কার পক্ষে আছি? আমি কি চিকিৎসা ব্যবস্থাকে রহস্যাবৃত করতে চাই, নাকি এর রহস্য ভেদ করতে চাই? আমি মানুষকে জ্ঞান দিতে চাই, নাকি তাকে অন্ধকারে রাখতে চাই। শারীরবৃত্ত সম্পর্কে জানানো খুব কঠিন কিছু না। ডিমিস্টিফিকেশন হলো হেলথ কেয়ারের মর্মকথা। এর মাধ্যমে জনসাধারণের কাছে চিকিৎসা ব্যবস্থা পেঁৗছানো সম্ভব। বাংলাদেশকে যদি আজ স্বাস্থ্যকরভাবে গড়ে তুলতে হয়, স্বাস্থ্যসেবাকে গ্রাম পর্যন্ত পেঁৗছানোর কথা ভাবা হয় তাহলে ডিমিস্টিফিকেশন ছাড়া উপায় নেই। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের মূল অবদানটা এখানে। আমরা সবকিছুকে সহজ-সরল করে দিচ্ছি। আমরা কোনো বুজরুকি করছি না। চিকিৎসা ব্যবস্থার মৌলিক ধারণাগুলো আমরা ছড়িয়ে দিচ্ছি। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আমরা খালি পায়ে চলা মানুষদের দক্ষ করে তুলছি। কিন্তু এ ব্যবস্থাটাকে সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্বটা সরকারের। আমি মনে করি, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের হাতেই ন্যস্ত থাকা উচিত। এটা এনজিও পারবে না, আর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এটা চাইবে না।
সমকাল : কোনো সরকার কি এ ধারণাটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে?
জাফরুল্লাহ চৌধুরী : বাংলাদেশের জন্ম থেকে আমরা বিভিন্ন শাসকের কাছে পেঁৗছাবার চেষ্টা করেছি। মুজিব ভাইকে বুঝিয়েছি। তিনি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের নামটি ঠিক করে দিয়েছিলেন। তার প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় গ্রাম পর্যায়ে চিকিৎসাসেবা পেঁৗছে দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল। জিয়াউর রহমানের ১৯ দফায় চিকিৎসাসেবার কথা ছিল। এরশাদেরও পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, এই সরকারগুলো চালিয়েছে উচ্চবিত্তের লোকেরা। তারা তো সাধারণ মানুষের জন্য কিছু করতে চায়নি। তারা তো বুঝেছে এসব করলে তাদের ছেলেমেয়েদের মাতবরি থাকবে না। এবার প্রধানমন্ত্রী ১৮ বার ডাক্তারদের সতর্ক করে দিলেন। বললেন, গ্রামে যেতে হবে। কিন্তু তার কথা তো কেউ আমলে নিচ্ছে না। আমার মতে, নিয়োগ প্রক্রিয়াতেই সমস্যা আছে। ডাক্তারদের নিয়োগপত্রে যদি উল্লেখ থাকে তাকে অমুক গ্রামে পোস্টিং দেওয়া হলো, অত তারিখে তাকে কাজে যোগদান করতে হবে, নয়তো এই নিয়োগপত্র বাতিল বলে গণ্য হবে। সঙ্গে যদি লেখা থাকত, তিন বছর ওই কর্মস্থলে থাকার পর তোমার পোস্টগ্র্যাজুয়েট শিক্ষার সুযোগ সরকার নিশ্চিত করবে; তাহলে ডাক্তাররা গ্রামে যেতে বাধ্য থাকত, উৎসাহিতও হতো। পাশাপাশি এমবিবিএস করার পর তিন বছর অতিবাহিত না হলে কেউ পোস্টগ্র্যাজুয়েট করতে পারবে না_ এমন নিয়ম চালু হলে ডাক্তারদের মধ্যে এগিয়ে যাওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতাও চলত না। আমার মতে, এমন নিয়ম চালু হলে ৯০% ডাক্তার গ্রামে যাবে। ডাক্তারদের যদি মোটরসাইকেল দেওয়া হয় এবং ইউনিয়ন হেলথ কেন্দ্রে তাদের নিয়োগ করা হয় তাহলে তারা সেখান থেকে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে সেবা দিতে পারবে। ডাক্তারদের আমরা চাকরি দেই ট্রেনিং না দিয়ে। এটা কেন হবে? বহু বছর আগে এক বছর ইন্টার্নশিপের রেওয়াজ শুরু হয়েছিল। তখন মেডিকেল সায়েন্স ছিল অনেক ছোট পরিসরে বিস্তৃত। এখন এর আওতা বাড়লেও এক বছরের ইন্টার্নশিপই চালু আছে। ইন্টারশিপের মেয়াদ দু'বছর না হোক, আঠারো মাস তো করতে হবে। এক বছর মেডিকেল কলেজে প্রশিক্ষণ দিয়ে ছয় মাসের জন্য যদি ডাক্তারদের ইউনিয়নগুলোতে পাঠানো হয় তাহলে তো গ্রামে চিকিৎসাসেবা পেঁৗছাতে পারে। গণস্বাস্থ্য এটা করে। এক বছরের ইন্টার্নশিপের ৮ মাস আমরা ঢাকায় রাখি আর চার মাসের জন্য গ্রামে পাঠিয়ে দেই। তারা যে আপত্তি করে না তা নয়। কিন্তু উপভোগও করে কাজটা। প্রকৃতির মধ্যে, মানুষের মধ্যে কাজ করার আনন্দটাও তারা পায়। আমরা তো সংবিধানে বলেছি, সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা পেঁৗছাব। নূ্যনতম সেবাটুকু পেঁৗছাতে হলে কিছু উদ্যোগ তো নিতে হবে।
সমকাল : আপনি ১৯৮৫ সালে বলেছিলেন বাংলাদেশের ২৫% মানুষ মৃত্যুর আগে ডাক্তারের দেখা পায় না।
জাফরুল্লাহ চৌধুরী : আমি এখনও বলি। বাংলাদেশের ৫০% মানুষ মরার আগ পর্যন্ত ডাক্তারের দেখা পায় না। একদিক থেকে এটা ভালো, তাদের নিঃস্ব হতে হয় না। যারা চিকিৎসাসেবা পায় তাদের অবস্থা কি ভালো? সম্প্রতি পত্রিকায় বেশ কিছু খবর পেলাম চিকিৎসারত অবস্থায় মৃত্যুর। পত্রিকাগুলো চিকিৎসারত অবস্থায় মৃত্যুর খবর দিলেও কোন ওষুধ ব্যবহার করা হয়েছে সেটা লেখে না। ওষুধ বা ইনজেকশনের নাম লিখলে অনেক ইন্টারেস্টিং স্টোরি বেরিয়ে আসতে পারে। চিকিৎসা ব্যবস্থায় ডিমিস্টিফিকেশনের সবচেয়ে বড় উপায় কি জানেন? প্রতিটি চিকিৎসাধীন মৃত্যুর ব্যাপারে ডেথ অডিট হতে হবে। অন্যান্য দেশে এটা আছে_ একে বলা হয় করোনার্স কোর্ট। একজন ডাক্তার সেখানে ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি দেখেন, হাসপাতালে যে চিকিৎসা হয়েছে তা ঠিকমতো হয়েছে কি-না। মৃত্যু স্বাভাবিক ব্যাপার, কিন্তু ওষুধের ভুলে যদি মৃত্যু হয় তাহলে এই ব্যবস্থায় সেটা বেরিয়ে আসতে পারে। ভুলের পুনরাবৃত্তি রোধ করা যেতে পারে। দেখতে হবে, চিকিৎসা নিতে আসা ব্যক্তি সময়মতো চিকিৎসা পেয়েছে কি-না। আমাদের দেশে ডেথ অডিট চালু হলে মানুষের ক্ষোভ চলে যাবে। ডাক্তাররাও নিজেদের ভুল থেকে শিখতে পারবে।
সমকাল : ১৯৮২ সালে গৃহীত ওষুধ নীতি কি এখন অনুসৃত হচ্ছে?
জাফরুল্লাহ চৌধুরী : না, হচ্ছে না। ১৯৯৪ সালে খালেদা জিয়া সরকারের শেষ দিকে এটি পরিবর্তিত হয়েছে। সরকারের নিয়ন্ত্রণ শিথিল করা হয়েছে। অথচ এ ওষুধনীতির কারণেই স্কয়ারসহ দেশীয় কোম্পানিগুলোর এত বড় উত্থান ঘটেছে। আমাদের নিজস্ব কারখানা গড়ে উঠেছে। ১৯৯৪ সালে ১১৭টি ওষুধ সরকারের নিয়ন্ত্রণে রেখে বাকিগুলো নিয়ন্ত্রণের বাইরে দিয়ে দেওয়া হলো। ফলে কোম্পানিগুলো নানা অজুহাতে ওষুধের দাম বাড়াতে থাকল। ওষুধের ব্যয় সাধারণের নাগালের বাইরে যেতে থাকল। বাজার সবসময় নির্ধারক হতে পারে না। এখানে সরকারের নিয়ন্ত্রণের দরকার আছে। ওষুধের লাভের মাত্রা যখন বাড়তে থাকে খারাপ ওষুধও তত বাড়তে থাকে। ১৯৯৪ সালের আগে খারাপ ওষুধের কারণে মৃত্যুর ঘটনা ততটা ঘটেনি। পরে অনেক ঘটেছে।
সমকাল : গণফার্মেসি থেকে তো আপনারা কম দামের ওষুধ উৎপাদন করেছেন।
জাফরুল্লাহ চৌধুরী : গণফার্মেসির ওষুধ এত কম দামের যে লোকে এতে আস্থা পায় না। আমরা লাভ কম করি। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো কমিশন দেয় অনেক বেশি। ফলে তাদের ওষুধ বিক্রির ব্যাপারেই আগ্রহ বেশি।
সমকাল : এখন সরকার একটি স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ন করার কথা ভাবছে। এর আগে কি কোনো স্বাস্থ্যনীতির চিন্তা করা হয়েছিল?
জাফরুল্লাহ চৌধুরী : ১৯৯০ সালে স্বাস্থ্যনীতি করা হয়েছিল। সে নীতি প্রণয়নের সঙ্গে আমি জড়িত ছিলাম। সেটি ছিল অনেক জনবান্ধব। সে নীতিটি গৃহীত হয়নি। কিন্তু দেশের জন্য তেমন একটি নীতিই আজ সবচেয়ে জরুরি। সে নীতিটি পার্লামেন্টে পাস হলেও কার্যকর হয়নি। কেন কার্যকর হয়নি সে কারণগুলো আপনাদের জানতে হবে। জানাতেও হবে মানুষকে।
সমকাল : ২০১২ সালে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ৪০ বছর পূর্ণ হলো। এ উপলক্ষে নানা আয়োজন আমাদের চোখে পড়েছে। দীর্ঘ যাত্রায় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। র্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার পেয়েছেন আপনি।
জাফরুল্লাহ চৌধুরী : র্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার প্রথম আমাকে দিতে চাওয়া হয়েছিল ১৯৭৫-৭৬ সালের দিকে। আমি তখন পুরস্কার নিইনি; কারণ এ পুরস্কারের অর্থায়ন করত রকফেলার ফাউন্ডেশন। আমি তখন রকফেলারের বিরুদ্ধে কথা বলতাম। আমি বলেছিলাম, রকফেলারের টাকায় দেওয়া পুরস্কার আমি নিতে পারি না। প্রশ্ন উঠতে পারে, ১৯৮৫ সালে তাহলে আমি পুরস্কারটা নিলাম কেন? '৮৫তে যখন আবার পুরস্কারের প্রস্তাব এলো তখন আমি দৈনিক বাংলার সম্পাদক আহমেদ হুমায়ুন, আহমদ শরীফের সঙ্গে কথা বললাম। আমি ওষুধ নীতি প্রণয়নের সঙ্গে জড়িত ছিলাম, বাংলাদেশের পরিবর্তনের অনেক আন্দোলন-সংগ্রামে আমার অংশগ্রহণ ছিল_ এসব কারণে আমাদের বিরুদ্ধে নানা শক্তি সক্রিয় ছিল, সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকেও নিরাপত্তার নামে নানা হয়রানির শিকার হতে হতো। তখন অনেকে বললেন, তুমি পুরস্কারটা নাও। এটা নিয়ে তো তুমি দাসখত লিখে দিচ্ছ না। কিন্তু পুরস্কারটা নিলে তোমার আন্তর্জাতিক খ্যাতির কারণে হয়রানির হাত থেকে বাঁচতে পারবে। বলতে গেলে, কৌশলগত কারণে আমি পুরস্কারটা নিলাম। যে রকফেলার অস্ত্র তৈরির জন্য এত টাকা ব্যয় করে তারা কীভাবে জনস্বাস্থ্যের উন্নতি চাইতে পারে? যারা আমাদের ওষুধনীতির বিরোধিতা করে, তারা কীভাবে আমাদের উদ্যোগকে স্বীকৃতি দিতে চায়? আমি এসব কথা বলেছি। আমাদের সীমিত ক্ষমতা ও সীমাবদ্ধতা নিয়ে আমরা চেষ্টা করেছি। গণস্বাস্থ্য ছোট সংগঠন। তবে ছোট হলেও এর সবচেয়ে বড় কাজ হলো, সাধারণ মানুষের কাছে আমরা পেঁৗছাতে পেরেছি। সাধারণ মানুষের আওয়াজ আমরা শুনেছি। তারা কী চায়, তাদের পথ কোনটা_ সে সম্পর্কে ধারণা পেয়েছি। আমরা যারা উচ্চ লেখাপড়া করি, দেশ-বিদেশে গিয়ে বিভিন্ন উচ্চ ডিগ্রি আনি, তারা মানুষের কথা বলি বটে কিন্তু সে কথা বলি বিদেশ থেকে শিখে আসা পদ্ধতিতে। সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলনের সঙ্গে আমরা বিভিন্ন সময় জড়িত ছিলাম বলে আমাদের একটা অন্তর্গত অহমিকাও আছে।
সমকাল : ১৯৭২ সালে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের যাত্রা শুরু।
জাফরুল্লাহ চৌধুরী : আমাদের শুরু আসলে ১৯৭১ সালে । যুদ্ধের সময়। আমার জন্ম উচ্চবিত্ত পরিবারে। প্রগতিশীল আন্দোলনে যুক্ত হয়েছি তরুণ বয়সে। আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি। আমরা ইনোভেটর ছিলাম। তখন আমরা ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা রাস্তার ওপর লিখে দিয়েছিলাম, 'আইয়ুব শাহি মুর্দাবাদ'। এসব দিয়েই আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল। একসময় শিক্ষা পরিবর্তনের আন্দোলন করেছি। এগুলোর মধ্যেও পড়াশোনার আগ্রহটা ছিল। মনে হয়েছিল, আমি পূর্ব পাকিস্তানের এক নম্বর ডাক্তার হবো। শুধু পূর্ব পাকিস্তান কেন, পুরো পাকিস্তানেরই এক নম্বর ডাক্তার হবো। তখন ভাসকুলার সার্জন পাকিস্তানে কেউ ছিল না। আমার মনে হলো, যদি ভাসকুলার সার্জন হই তবে পাকিস্তানিদের আমার কাছেই আসতে হবে। মধ্যবিত্তের সুবিধাবাদী চিন্তা-ভাবনা। ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে স্বাভাবিকভাবেই শেখ মুজিব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চাইলেন। কিন্তু পাকিস্তানিরা যখন তাকে প্রধানমন্ত্রী করতে চাইল না তখন আমরা অপেক্ষায় ছিলাম কখন স্বাধীনতার ঘোষণা আসবে। একটা সন্দেহও ছিল যে, হয়তো স্বাধীনতার ঘোষণা আসবে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ শুরু হলো। মওলানা ভাসানীর চিঠি পেয়ে ফিরে এলাম। আমরা বললাম, যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিক যেমন লাগবে, হাসপাতালও লাগবে। খালেদ মোশাররফ বলল, আমার হাসপাতাল লাগবে না। আমার ৫ হাজার সৈনিক আসবে, ৫ হাজার মরবে_ আমরা প্রাণের তোয়াক্কা করি না। আপনি ফিরে গিয়ে অস্ত্রের ব্যবস্থা করেন। আইআরএ_ আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির সঙ্গে পরিচিত হয়ে যোগাযোগ গড়ে তোলেন। আপনি হাসপাতাল নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। পরে তাজউদ্দীন সাহেবকে রাজি করাতে পারলাম। কিন্তু হাসপাতাল হলে চালাবে কে? সুবিধাবাদী মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে ক'জন গিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে? ক'জন ডাক্তার গিয়েছিল? আপনি ইতিহাসটা খুলে দেখবেন। খুবই ন্যক্কারজনক অধ্যায় এটা। তাজউদ্দীন সাহেব আমাকে বলেছিলেন, দেশ স্বাধীন হবে কিন্তু আমি থাকব না। আমি হারিয়ে যাব। আর আপনি সমাজতন্ত্র করতে এসেছেন তো, আপনার স্বপ্নও সফল হবে না। আমি বললাম, বিলাত থেকে ডাক্তার-নার্স নিয়ে আসি। আমরা ভেবেছিলাম, যুদ্ধ অনেকদিন চলবে। নয় মাসেই যে এত সুস্থ শিশুর জন্ম হবে তা আমরা ভাবিনি। তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, বিলাত থেকে নার্স আনা যাবে না। ওরা মানবদরদি, কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে সবকিছু ফেয়ার নয়। ওদের আনলে অনেক সমস্যা হবে। তারা আমাদের সঙ্গে কোনো বিষয়ে একমত না-ও হতে পারে, তারা মারাও যেতে পারে। এই পরিস্থিতিই আমাদের অলটারনেটিভ চিন্তা করতে বাধ্য করল। তখন আমি ভাবলাম, আমার কী দরকার? সার্জন হিসেবে আমার দরকার কয়েক জোড়া হাত। যারা আমাকে সাহায্য করতে পারে। এটা করার জন্য তো সময় লাগার কথা নয়। চিকিৎসা ক্ষেত্রে ডিমিস্টিফিকেশনের জন্ম সেখানে।
সমকাল : ডিমিস্টিফিকেশন কী?
জাফরুল্লাহ চৌধুরী : উচ্চবিত্ত সুবিধাবাদী শ্রেণী সমাজকে শাসন করার জন্য বিভিন্ন বিষয়কে ক্রমাগত মিস্টিফাই করে তোলে। কিন্তু যদি আমরা উল্টোভাবে চিন্তা করি? এমপি সাহেবের জন্য দামি গাড়ি আনতে হবে। কেন আনতে হবে? তার কি গাড়ি নেই, তাহলে এতদিন কীভাবে চলত? এতদিন যেভাবে চলেছে সেভাবে এখন কেন চলতে পারে না? তাকে কেন বেতন দিতে হবে? তাকে তো আমরা ভোটে দাঁড়াতে বলিনি। বেতন নিলে তো স্বেচ্ছাসেবী মনোভাব থাকে না, মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আকাঙ্ক্ষা থাকে না। তখন শাসনের মনোবৃত্তিই প্রধান হয়ে ওঠে। ঢাকা শহর থেকে দেশ শাসন করার ইচ্ছা জাগে। ডিমিস্টিফিকেশন একটা সহজ কাজ। আদি থেকে মানুষের চিন্তায় মিস্টিফিকেশন বা রহস্যায়ন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আলোটা চলে গেলে মানুষ ভেবেছে কোনো অতিপ্রাকৃতিক শক্তি বোধহয় সূর্যটা ঢেকে দিয়েছে। কিন্তু পরে মানুষ আবিষ্কার করল, পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরছে বলেই দিনরাত হয়। এভাবেই ডিমিস্টিফিকেশন রহস্যভেদের সূচনা ঘটে। চিকিৎসা ক্ষেত্রে ডিমিস্টিফিকেশনের শুরুটা কোথায়? পৃথিবীর আদি চিকিৎসক সব মেয়ে। বাস্তবতার কারণেই মেয়েরা পৃথিবীর প্রথম চিকিৎসক। কারণ তাদের বাচ্চা ধারণ করতে হয়। বাচ্চা জন্ম দিতে হয়। বাচ্চা প্রসব করলে রক্তপাত হয়, সে রক্তপাত বন্ধের উপায়ও তাদের বের করতে হয়েছে। তাকে আবিষ্কার করতে হয়েছে কিসে রক্তপাত থামবে। কোন গাছের পাতা দিলে রক্ত থেমে যায়। কী খেলে ব্যথা কমে। আফিমের জন্ম হয়েছিল ব্যথা কমানোর ওষুধ হিসেবে। যখন মেয়েরা ডাক্তার ছিল, তখন চিকিৎসা ছিল সেবা। কিন্তু পুরুষরা যখন ডাক্তার হলো তখন তারা একে ব্যবসায় পরিণত করে ফেলল। তারা বলল, যে মেয়েরা চিকিৎসা করে তারা ডাকিনী, উইচ। ইউরোপের মতো জায়গায় ধাত্রীদের পুড়িয়ে মারা হলো। আর মেয়েদের জন্য চিকিৎসা শাস্ত্র নিষিদ্ধ করে দেওয়া হলো। বহু শতক পর্যন্ত মেয়েরা ডাক্তারি পড়তে পারত না। চিকিৎসা খুব রহস্যাবৃত কোনো শাস্ত্র নয়। এটা খুব সহজে বোঝা সম্ভব। থার্মোমিটার ডিমিস্টিফিকেশনের একটা সূচনা ঘটিয়েছে। এর সাহায্যে কোনো অনুমান ছাড়াই আমরা খুব সহজে জ্বর মাপতে পারছি। আরেকটা বড় ঘটনা ব্লাডপ্রেসার মাপার যন্ত্র। সবচেয়ে দরকারি মেডিকেল অ্যাপারেটাস। আপনি যদি কানে শোনেন আর অক্ষর পড়তে পারেন তাহলেই আপনি ব্লাডপ্রেসার মাপতে পারবেন। এই যে প্যাথলজি, এতে আমরা কী দেখি। রক্তে কিছু কেমিক্যাল মিশিয়ে আমরা রঙের খেলা দেখি। ব্লাড সেলগুলো দেখি। এতে কঠিন রহস্যাবৃত কাজটা কোথায়? আগে দেখতে হবে আমি কার পক্ষে আছি? আমি কি চিকিৎসা ব্যবস্থাকে রহস্যাবৃত করতে চাই, নাকি এর রহস্য ভেদ করতে চাই? আমি মানুষকে জ্ঞান দিতে চাই, নাকি তাকে অন্ধকারে রাখতে চাই। শারীরবৃত্ত সম্পর্কে জানানো খুব কঠিন কিছু না। ডিমিস্টিফিকেশন হলো হেলথ কেয়ারের মর্মকথা। এর মাধ্যমে জনসাধারণের কাছে চিকিৎসা ব্যবস্থা পেঁৗছানো সম্ভব। বাংলাদেশকে যদি আজ স্বাস্থ্যকরভাবে গড়ে তুলতে হয়, স্বাস্থ্যসেবাকে গ্রাম পর্যন্ত পেঁৗছানোর কথা ভাবা হয় তাহলে ডিমিস্টিফিকেশন ছাড়া উপায় নেই। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের মূল অবদানটা এখানে। আমরা সবকিছুকে সহজ-সরল করে দিচ্ছি। আমরা কোনো বুজরুকি করছি না। চিকিৎসা ব্যবস্থার মৌলিক ধারণাগুলো আমরা ছড়িয়ে দিচ্ছি। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আমরা খালি পায়ে চলা মানুষদের দক্ষ করে তুলছি। কিন্তু এ ব্যবস্থাটাকে সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্বটা সরকারের। আমি মনে করি, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের হাতেই ন্যস্ত থাকা উচিত। এটা এনজিও পারবে না, আর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এটা চাইবে না।
সমকাল : কোনো সরকার কি এ ধারণাটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে?
জাফরুল্লাহ চৌধুরী : বাংলাদেশের জন্ম থেকে আমরা বিভিন্ন শাসকের কাছে পেঁৗছাবার চেষ্টা করেছি। মুজিব ভাইকে বুঝিয়েছি। তিনি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের নামটি ঠিক করে দিয়েছিলেন। তার প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় গ্রাম পর্যায়ে চিকিৎসাসেবা পেঁৗছে দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল। জিয়াউর রহমানের ১৯ দফায় চিকিৎসাসেবার কথা ছিল। এরশাদেরও পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, এই সরকারগুলো চালিয়েছে উচ্চবিত্তের লোকেরা। তারা তো সাধারণ মানুষের জন্য কিছু করতে চায়নি। তারা তো বুঝেছে এসব করলে তাদের ছেলেমেয়েদের মাতবরি থাকবে না। এবার প্রধানমন্ত্রী ১৮ বার ডাক্তারদের সতর্ক করে দিলেন। বললেন, গ্রামে যেতে হবে। কিন্তু তার কথা তো কেউ আমলে নিচ্ছে না। আমার মতে, নিয়োগ প্রক্রিয়াতেই সমস্যা আছে। ডাক্তারদের নিয়োগপত্রে যদি উল্লেখ থাকে তাকে অমুক গ্রামে পোস্টিং দেওয়া হলো, অত তারিখে তাকে কাজে যোগদান করতে হবে, নয়তো এই নিয়োগপত্র বাতিল বলে গণ্য হবে। সঙ্গে যদি লেখা থাকত, তিন বছর ওই কর্মস্থলে থাকার পর তোমার পোস্টগ্র্যাজুয়েট শিক্ষার সুযোগ সরকার নিশ্চিত করবে; তাহলে ডাক্তাররা গ্রামে যেতে বাধ্য থাকত, উৎসাহিতও হতো। পাশাপাশি এমবিবিএস করার পর তিন বছর অতিবাহিত না হলে কেউ পোস্টগ্র্যাজুয়েট করতে পারবে না_ এমন নিয়ম চালু হলে ডাক্তারদের মধ্যে এগিয়ে যাওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতাও চলত না। আমার মতে, এমন নিয়ম চালু হলে ৯০% ডাক্তার গ্রামে যাবে। ডাক্তারদের যদি মোটরসাইকেল দেওয়া হয় এবং ইউনিয়ন হেলথ কেন্দ্রে তাদের নিয়োগ করা হয় তাহলে তারা সেখান থেকে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে সেবা দিতে পারবে। ডাক্তারদের আমরা চাকরি দেই ট্রেনিং না দিয়ে। এটা কেন হবে? বহু বছর আগে এক বছর ইন্টার্নশিপের রেওয়াজ শুরু হয়েছিল। তখন মেডিকেল সায়েন্স ছিল অনেক ছোট পরিসরে বিস্তৃত। এখন এর আওতা বাড়লেও এক বছরের ইন্টার্নশিপই চালু আছে। ইন্টারশিপের মেয়াদ দু'বছর না হোক, আঠারো মাস তো করতে হবে। এক বছর মেডিকেল কলেজে প্রশিক্ষণ দিয়ে ছয় মাসের জন্য যদি ডাক্তারদের ইউনিয়নগুলোতে পাঠানো হয় তাহলে তো গ্রামে চিকিৎসাসেবা পেঁৗছাতে পারে। গণস্বাস্থ্য এটা করে। এক বছরের ইন্টার্নশিপের ৮ মাস আমরা ঢাকায় রাখি আর চার মাসের জন্য গ্রামে পাঠিয়ে দেই। তারা যে আপত্তি করে না তা নয়। কিন্তু উপভোগও করে কাজটা। প্রকৃতির মধ্যে, মানুষের মধ্যে কাজ করার আনন্দটাও তারা পায়। আমরা তো সংবিধানে বলেছি, সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা পেঁৗছাব। নূ্যনতম সেবাটুকু পেঁৗছাতে হলে কিছু উদ্যোগ তো নিতে হবে।
সমকাল : আপনি ১৯৮৫ সালে বলেছিলেন বাংলাদেশের ২৫% মানুষ মৃত্যুর আগে ডাক্তারের দেখা পায় না।
জাফরুল্লাহ চৌধুরী : আমি এখনও বলি। বাংলাদেশের ৫০% মানুষ মরার আগ পর্যন্ত ডাক্তারের দেখা পায় না। একদিক থেকে এটা ভালো, তাদের নিঃস্ব হতে হয় না। যারা চিকিৎসাসেবা পায় তাদের অবস্থা কি ভালো? সম্প্রতি পত্রিকায় বেশ কিছু খবর পেলাম চিকিৎসারত অবস্থায় মৃত্যুর। পত্রিকাগুলো চিকিৎসারত অবস্থায় মৃত্যুর খবর দিলেও কোন ওষুধ ব্যবহার করা হয়েছে সেটা লেখে না। ওষুধ বা ইনজেকশনের নাম লিখলে অনেক ইন্টারেস্টিং স্টোরি বেরিয়ে আসতে পারে। চিকিৎসা ব্যবস্থায় ডিমিস্টিফিকেশনের সবচেয়ে বড় উপায় কি জানেন? প্রতিটি চিকিৎসাধীন মৃত্যুর ব্যাপারে ডেথ অডিট হতে হবে। অন্যান্য দেশে এটা আছে_ একে বলা হয় করোনার্স কোর্ট। একজন ডাক্তার সেখানে ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি দেখেন, হাসপাতালে যে চিকিৎসা হয়েছে তা ঠিকমতো হয়েছে কি-না। মৃত্যু স্বাভাবিক ব্যাপার, কিন্তু ওষুধের ভুলে যদি মৃত্যু হয় তাহলে এই ব্যবস্থায় সেটা বেরিয়ে আসতে পারে। ভুলের পুনরাবৃত্তি রোধ করা যেতে পারে। দেখতে হবে, চিকিৎসা নিতে আসা ব্যক্তি সময়মতো চিকিৎসা পেয়েছে কি-না। আমাদের দেশে ডেথ অডিট চালু হলে মানুষের ক্ষোভ চলে যাবে। ডাক্তাররাও নিজেদের ভুল থেকে শিখতে পারবে।
সমকাল : ১৯৮২ সালে গৃহীত ওষুধ নীতি কি এখন অনুসৃত হচ্ছে?
জাফরুল্লাহ চৌধুরী : না, হচ্ছে না। ১৯৯৪ সালে খালেদা জিয়া সরকারের শেষ দিকে এটি পরিবর্তিত হয়েছে। সরকারের নিয়ন্ত্রণ শিথিল করা হয়েছে। অথচ এ ওষুধনীতির কারণেই স্কয়ারসহ দেশীয় কোম্পানিগুলোর এত বড় উত্থান ঘটেছে। আমাদের নিজস্ব কারখানা গড়ে উঠেছে। ১৯৯৪ সালে ১১৭টি ওষুধ সরকারের নিয়ন্ত্রণে রেখে বাকিগুলো নিয়ন্ত্রণের বাইরে দিয়ে দেওয়া হলো। ফলে কোম্পানিগুলো নানা অজুহাতে ওষুধের দাম বাড়াতে থাকল। ওষুধের ব্যয় সাধারণের নাগালের বাইরে যেতে থাকল। বাজার সবসময় নির্ধারক হতে পারে না। এখানে সরকারের নিয়ন্ত্রণের দরকার আছে। ওষুধের লাভের মাত্রা যখন বাড়তে থাকে খারাপ ওষুধও তত বাড়তে থাকে। ১৯৯৪ সালের আগে খারাপ ওষুধের কারণে মৃত্যুর ঘটনা ততটা ঘটেনি। পরে অনেক ঘটেছে।
সমকাল : গণফার্মেসি থেকে তো আপনারা কম দামের ওষুধ উৎপাদন করেছেন।
জাফরুল্লাহ চৌধুরী : গণফার্মেসির ওষুধ এত কম দামের যে লোকে এতে আস্থা পায় না। আমরা লাভ কম করি। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো কমিশন দেয় অনেক বেশি। ফলে তাদের ওষুধ বিক্রির ব্যাপারেই আগ্রহ বেশি।
সমকাল : এখন সরকার একটি স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ন করার কথা ভাবছে। এর আগে কি কোনো স্বাস্থ্যনীতির চিন্তা করা হয়েছিল?
জাফরুল্লাহ চৌধুরী : ১৯৯০ সালে স্বাস্থ্যনীতি করা হয়েছিল। সে নীতি প্রণয়নের সঙ্গে আমি জড়িত ছিলাম। সেটি ছিল অনেক জনবান্ধব। সে নীতিটি গৃহীত হয়নি। কিন্তু দেশের জন্য তেমন একটি নীতিই আজ সবচেয়ে জরুরি। সে নীতিটি পার্লামেন্টে পাস হলেও কার্যকর হয়নি। কেন কার্যকর হয়নি সে কারণগুলো আপনাদের জানতে হবে। জানাতেও হবে মানুষকে।